বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদধন্য একুশ শতকের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সবকিছুকে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই শেষে গ্রহণ বা বর্জন করে। সনাতনী আবেগ-উচ্ছ্বাস আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় আঁচড় কাটতে পারে না। তাই নতুন প্রজন্মের অনেক হিন্দুধর্মাবলম্বী পিতৃ প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষার খাতিরে হিন্দুদের ধর্মাবতার রাম চন্দ্রের সস্ত্রীক বনবাসের সিদ্ধান্তের বিরূপ সমালোচনা করতে পিছপা হয় না। আবার কিশোর ইসমাইল (আ.) এর অধোবধনে ও বিনা বাক্যব্যয়ে নবতিপর বৃদ্ধ পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর স্বপ্নাদেশের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশের সিদ্ধান্তেরও অনেকে বিরূপ সমালোচনা করে থাকে। যাহোক, সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে বন্ধ্যাত্ব কোনো দম্পতি বা যুগলের কাম্য নয়। পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়া কিংবা পাশ্চাত্যের আদলে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড হিসেবে শয্যাসঙ্গী হওয়ার পর প্রত্যেক যুগলই নির্দিষ্ট সময়ে সংসারে নতুন মুখের আগমন প্রত্যাশা করে। কিন্তু কোনো অজানা কারণে নতুন মুখের আগমন বিলম্বিত হলে নব যুগলের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তাদের পরিচিতজনদের মুখে মেঘ উড়তে শুরু করে এবং নানা গুঞ্জনে পারিপাশির্ক আবহাওয়া ভারী হয়ে ওঠে। পরিণয় কিংবা বন্ধুত্বের সূত্রে আবদ্ধ যুগলদেও ক্ষেত্রে জগৎ-সংসারে সন্তানসন্ততি বিশ্ববিধাতার কত বড় আশীর্বাদ, তা বন্ধ্যা যুগলরা সম্যক উপলব্ধি করে থাকেন। তাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে পারিপাশিক আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বাচ্চা জন্মদানের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা উভয়কে ২২ জোড়া হারে সর্বমোট ৪৪ জোড়া ক্রোমোজম বা কালারড বডি প্রদান করতে হয়। আবার মহিলাদের ২২ জোড়া ক্রোমোজমের প্রকৃতি সর্বদা ঠিক এবং একে ইংরেজি X বর্ণ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। আর পুরুষের ২২ জোড়া ক্রোমোজমের মধ্যে ২১ জোড়ার প্রকৃতি সর্বদা ঠিক থাকে এবং এদের ইংরেজি X বর্ণ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। আর মাঝে মাঝে ১ জোড়া ক্রোমোজমের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয় এবং একে ইংরেজি Y বর্ণ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। আর ওই পরিবর্তিত ক্রোমোজমের কারণে নবজাতক শিশুটি বালক হয়। অথচ সনাতনী ব্যবস্থায় এবং নিরক্ষর সমাজব্যবস্থা কন্যাসন্তান জন্মের দায়ভার সর্বদা প্রসূতির ঘাড়ে চাপিয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, পিতা-মাতার উর্বর শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিথুন প্রক্রিয়ায় পরস্পর নিষিক্ত হলেই মাতৃগর্ভে ভ্রমণের সঞ্চার হয়। কোনো দম্পতি বা যুগলের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উর্বর না হলে তাদের সারা জীবন বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ বহন করতে হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নানা উপায়ে ভ্রমণ সঞ্চারের চেষ্টা করলেও বিশ্ববিধাতার অপরিসীম ও স্বাভাবিক অনুকম্পার তুলনায় তা আদৌ হিসাবে আসে না। অনবদ্য কারণে অনস্বীকার্য, প্রকৃত প্রস্তাবে পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্ব অর্জনের ক্ষমতা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ রহমত বা অনুকম্পা। অর্থবিত্ত কিংবা ধন-দৌলত কিংবা পার্থিব প্রভাব-প্রতিপত্তির বিনিময়ে এই রহমত হাসিল করা যায় না। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে বিজ্ঞানমনস্কতার দোহাই দিয়ে এবং প্রাগ্রসরতার বুলি আওড়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী নামক ঘৃণ্য নরকের কীট বেশ কিছুকাল থেকে সুকৌশলে স্বর্গীয় পিতৃত্ব ও মাতৃত্বকে নিয়ে ব্যাপক হারে ব্যবসা শুরু করেছে। অনুন্নত-উন্নত-উন্নয়নশীল তথা গোটা বিশ্বে তারা স্বর্গীয় পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের পসরা সাজিয়ে বসিয়েছে।
৩ জুলাইকে বিশ্বপিতৃত্ব দিবস (ওয়ার্ল্ড ফাদার’স ডে) নাম দিয়ে দিবসটি উপলক্ষে রং-বেরঙের ফুল, মুখরোচক আহার্য, বাহারি পোশাক-আশাক কেনাবেচার মাধ্যমে একশ্রেণির ব্যবসায়ী নামক লম্পট গোষ্ঠী বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা হাতড়ে নিচ্ছে। বিশ্ব পিতৃ দিবস, বিশ্ব মাতৃ দিবস, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ইত্যাদি শব্দচয়ন এবং চোখ-ধাঁধানো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বিশ্বজুড়ে মধ্যম বয়সী যুবক-যুবতীদের পকেট কাটার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। ব্যবসায়ী মহলের দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের যূপকাষ্ঠে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানসন্ততিদের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ মাথা ঠুকে মরছে। ভালোবাসা দিবস, পিতা দিবস, মাতা দিবস ইত্যাদি আমাদের নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় এমনতর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে যে তারা নিজেদের প্রকৃত দায়িত্ব-কর্তব্যবোধকে বিন্দুমাত্র আমলে নিচ্ছে না। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, বছরজুড়ে শয্যাসঙ্গী, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, নিজ প্রিয়তমা পত্নী, পুত্র-কন্যাকে নিয়ে আলাদাভাবে বাস করার পর শুধু বিশেষ বিশেষ দিবসে পিতা-মাতাকে ফুল দিয়ে বরণ এবং ভূরিভোজে আপ্যায়ন করলেই সন্তান হিসেবে পিতা-মাতার প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কড়ায়-গন্ডায় মিটে যায়। দিনে দিনে এই ভ্রান্ত ও অমূলক বিশ্বাস ক্রমশ ডালপালা মেলে বিশাল মহিরুহের আকার ধারণ করছে। ফলে বৃদ্ধাশ্রম, ওল্ডকেয়ার সেন্টার ইত্যাদিতে সারা দুনিয়া ভরে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত অসহায় পিতা-মাতার সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
অনস্বীকার্য যে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অসহায় সৃষ্টি মানবশিশু। এক সাগর অসহায়ত্ব ও পরনির্ভরশীলতাকে আশ্রয় করে প্রতিটি মানবশিশুর ধরাধামে আগমন ঘটে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বানরের শাবক প্রসবের অব্যবহিত পরপরই গাছের ডাল ধরে ঝুলতে শেখে। গরুর বাছুর জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উঠে দাঁড়াতে এবং যত্রতত্র চড়ে বেড়াতে পারে। অথচ শুধু হামাগুড়ি দিয়ে চলতে এবং আলতোভাবে হাঁটতেই প্রত্যেক মানবশিশুর দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। শিশুর সেবা-যত্ন, আহার-বিহার, ভরণপোষণ-শিক্ষাদান এবং তাদেরকে যুগোপযোগী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অবদানের তুলনা হয় না। এমনতর বাস্তবতার নিরিখে হজরত লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, হে বৎস! কখনো পিতা-মাতার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলো না। তাদের মর্মপীড়ার কারণ হয়-এ ধরনের উহ্ শব্দটিও মুখে উচ্চারণ করো না। আর তাদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনাকালে বলবে, রাব্বির হামহুমা কা’মা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা।
ইউরোপ, আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য বিশ্বে আত্মনির্ভরশীলতার দোহাই দিয়ে দিনে দিনে ইউনিট ফ্যামিলির সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি বাংলাদেশেও আজকাল বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সঙ্গে রাখা অনেকেই অহেতুক বিড়ম্বনা এবং ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অন্তরায় জ্ঞান করেন। আবার অনেক অতি যত্নশীল অভিভাবক বুড়ো পিতা-মাতাকে নিজেদের সন্তানসন্ততির অন্তর্নিহিত সহজাত গুণাবলির সুষম বিকাশের অন্তরায় ভেবে থাকেন। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী সিংহভাগ অভিভাবকই নিজেদের সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে পিতা-মাতাকে ওল্ডকেয়ার সেন্টারে প্রেরণ করছেন। আবার আমেরিকার সমাজব্যবস্থায় সন্তানদের আদর-আতিথ্যে বৃদ্ধ পিতা-মাতার শেষ বয়স কাটানো কিংবা মারা যাওয়ার নজির আদৌ মেলে না। তাই আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর যখন বর্তমানের অতি সাবধানী অভিভাবকেরা ৭০ বছর বয়সে পা দেবেন, তখন নিজেদের অবস্থা কী হবে, তা এখনই দয়া করে একটু ভেবে দেখুন। কারণ তখন বৃদ্ধাশ্রমে ও ওল্ডকেয়ারে থাকা লোকের সংখ্যা এত তুঙ্গে উঠবে এবং সর্বত্র আওয়াজ উঠবে ঠাঁই নাই ঠাঁই আমার ছোট তরী। সেই ন্যুব্জদেহ এবং কুব্জপৃষ্ঠধারী আপনার আর আমার আশ্রয় হবে আমেরিকার সড়ক, মহাসড়ক ও স্ট্রিটে। তদুপরি আমেরিকায় বর্তমানে যে হারে সিঙ্গেল ফাদার ও সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যা বাড়ছে, হয়তো-বা ৩০ বছর পর পরিবার বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা এবং কাঠফাটা রোদে পলিতকেশ-অশীতিপর-নবতিপর আমাদের অবস্থা কী হবে, তা ভাবতেই অজানা আশঙ্কায় অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। হে বিশ্বপ্রতিপালক, আমরা তোমার রহমত কামনা করছি। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ১৮ জুন ২০২৪