Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভীত অনেকেই

সরকারি কর্মকর্তারাও আবেদন করছেন অ্যাসাইলামের!

সরকারি কর্মকর্তারাও আবেদন করছেন অ্যাসাইলামের!
বাংলাদেশ ছেড়ে বিভিন্ন কারণে অনেকেই আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছেন। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ইমিগ্র্যান্টরা এখানে আসেন। পাশাপাশি অ্যাসাইলামের মাধ্যমে অনেকেই এ দেশে থেকে যান। আগে মানুষ রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত হলে এ দেশে থাকার জন্য অ্যাসাইলাম আবেদন করতেন। এখনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তা করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা কিংবা তাদের পরিবারের কেউ অ্যাসাইলাম আবেদন করছেন। সরকারি কর্মকর্তারা চাকরিতে থাকাবস্থায়ই ছুটি নিয়ে অ্যাসাইলাম আবেদন করছেন। তারা নির্দ্বিধায় সরকারের বিরুদ্ধে নানা নেতিবাচক তথ্য দিচ্ছেন। যারা বিএনপি কিংবা জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন, তাদের কথা ভিন্ন। কারণ তারা প্রশাসনে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কাউকে কাউকে ওএসডিও করা হয়েছে। আবার অনেককে এমন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে, যেখানে তিনি যেতে চান না। এসব কারণে তারা অ্যাসাইলাম আবেদন করতেই পারেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, বর্তমান সরকারের আমলে যারা সরকারি চাকরিতে ভালো অবস্থানে আছেন, চাকরি করতে গিয়ে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বৈষম্য বা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন না, তাদের অনেকেও অ্যাসাইলাম আবেদন করছেন। এই আবেদন করতে গিয়ে তারা অবলীলায় সরকারের বিরুদ্ধে নানা তথ্য দিচ্ছেন। তারা একদিকে সরকারি চাকরির সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার তাকে নির্যাতন করছে কিংবা খারাপ কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছে বা বাধ্য করছে বলে অ্যাসাইলাম আবেদন করছেন। কেউ কেউ এমনটাও দাবি করছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এমন কাজও তাকে করানোর জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি করবেন না বলে এ দেশে চলে এসেছেন এবং এখানে আশ্রয় চাইছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের নেতিবাচক ইমেজ তৈরির ক্ষেত্রে তারা বড় ভূমিকা রাখছেন। দেশের একাধিক সরকারি চাকরিজীবী সম্প্রতি অ্যাসাইলাম কেস করায় এ নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, যারা সরকারি চাকরিতে থেকে ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে এসে পরিকল্পিতভাবে এখানে অ্যাসাইলাম ফাইল করছেন, তারা সবকিছু জেনেশুনেই করছেন। কারণ তারা জানেন, আগামী দিনে সরকার পরিবর্তন হলে তারা কঠিন সমস্যায় পড়তে পারেন। এমনকি নিজেদের অপকর্মের জন্য জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আসতে পারেন। তাই সময় থাকতেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে থাকতে চাইছেন। এ জন্য এখানে অ্যাসাইলাম আবেদন করছেন। আর বলছেন, দেশে থাকার পরিস্থিতি নেই। নিরাপত্তা যেমন নেই, সেই সঙ্গে আর্থিক নিশ্চয়তাও নেই। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের দেশ ছাড়তে হচ্ছে। তারা আমেরিকায় ভালো থাকবে। এ কারণেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে হলেও এখানে আশ্রয় চাইছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যারা সরকারি চাকরিতে থাকাবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে এখানে অ্যাসাইলাম আবেদন করছেন, তাতে এটাই প্রমাণিত হয়, দেশে তারা নির্যাতিত। এখানকার সরকারের কাছেও সেই বার্তা পৌঁছায়- যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও তার পরিবারই নিরাপদ নয়, সেখানে সাধারণ মানুষ কতটা নিরাপদ। কারণ অ্যাসাইলাম কেসগুলোতে যে ধরনের বর্ণনা দেওয়া হয়, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্রই উঠে আসে। এ ছাড়া অনেক মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তার নামও উঠে আসে, যাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করছেন, এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যরা উপকৃত হলেও চূড়ান্ত সর্বনাশ হচ্ছে দেশ ও সরকারের।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পান। তাদের জন্য পিয়ন থাকে, গাড়ি থাকে। আবার তারা একাধিক গৃহপরিচারিকাও রাখেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যারা অনেক উচ্চ বেতনে কাজ করেন, কেবল তাদের পক্ষেই গৃহপরিচারিকা রাখা সম্ভব। এখানে ড্রাইভার আছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। নিজেরাই গাড়ি চালান। ড্রাইভার রাখার সামর্থ্য বেশির ভাগ মানুষের নেই। যাদের সামর্থ্য আছে, তারাও নিজেরাই গাড়ি চালান। এখানে এটাই নিয়ম- নিজের কাজ নিজে করবেন। এখানকার মানুষ অন্যের ওপর নির্ভর করে চলে না। ফলে বাংলাদেশের আয়েশি জীবন ছেড়ে যখন মানুষ এখানে আসে, তখন তারা খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়ে।
সূত্র জানায়, অনেক সরকারি কর্মকর্তা উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশে চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্যই আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ থাকতে সফল হলেও অনেকে আবার সফল হচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ এখানে এসে কয়েক মাস থাকার পর যখন দেখেন, বাংলাদেশের জীবন আর এ দেশের জীবনের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, তখন তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়। কারণ এখানে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করা কঠিন। আর সংসারের যাবতীয় কাজ নিজেকেই করতে হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুরুষ রান্নাবান্নায় অভ্যস্ত নয়। কিন্তু তাদেরকে এখানে আসার পর রান্না করতে হয়। এমনও নজির আছে, এ দেশে থাকার স্বপ্ন নিয়ে এসে অ্যাসাইলাম আবেদনের পরিকল্পনা করলেও স্ত্রী খাপ খাওয়াতে না পারায় দেশে ফিরে গেছেন। আবার কেউ কেউ এখানকার কষ্টের জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে, অ্যাসাইলাম গ্র্যান্ট হতে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ কিংবা সরকারি ছুটির মেয়াদ বাড়াতে না পেরে কেস উইথড্র করে দেশে ফিরে গেছেন।
সূত্র জানায়, যখন একটি পরিবার এ দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা সম্মিলিতভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আসার পর জমানো টাকা খরচ করা এবং এখানকার জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে দোষারোপ করেন। প্রতিদিনই একজন আরেকজনকে বলেন, তুমি আমাকে এ দেশে নিয়ে এসেছ। আমার আর এ দেশে থাকার ইচ্ছা নেই। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অবনতি হতে থাকে। বিশেষ করে, নারীদের জীবন অনেক কঠিন হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায়। এ জন্য সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। সন্তানদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। যে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান, সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ বাবা-মায়ের ঝগড়ার কারণে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সন্তানেরা বাবা-মায়ের ঝগড়ার কারণে পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। তখন তারা একটু শান্তি পাওয়ার জন্য নানা খারাপ কাজে আসক্ত হয়ে পড়ে। আর যারা পারিবারিক অশান্তির মধ্যেও নিজেদের মানসিক অবস্থা ঠিক রেখে লেখাপড়া চালিয়ে যায়, তারা সাফল্য পায়।
ভুক্তভোগী এক সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেছে, তিনি দেশে একটি মন্ত্রণালয়ে অনেক বড় চাকরি করতেন। সপরিবারে এ দেশে আসার পর অ্যাসাইলাম ফাইল করেছেন। এখনো গ্র্যান্ট হয়নি। এ কারণে ওয়ার্ক পারমিটও পাননি, নেই আইডিও। ফলে এখানে অনেক কম বেতনে একটি দোকানে কাজ করছেন। তার স্ত্রী কাজ করেন দিনে আর তিনি করেন রাতে। সপ্তাহে এক বা দুই রাত তারা একসঙ্গে থাকেন। বাকি পাঁচ কিংবা ছয় দিন স্বামী রাতে কাজ করেন আর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাসায় থাকেন। স্ত্রীও দিনে পাঁচ থেকে ছয় দিন কাজ করেন। দুজনে যা বেতন পান, তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। আর আয় না থাকলে জমা টাকা ভেঙে খান। এখানে খাপ খাওয়াতে না পেরে মন চায় দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু ওই সরকারি কর্মকর্তা দেশে যেতে চান না। দেশ থেকে একের পর এক নোটিশ আসছে তার নামে। কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। কারণ তিনি এ দেশে থাকার জন্য আটঘাট বেঁধেই এসেছেন। তাই দেশে আর ফিরে যাবেন না।
এদিকে বেশির ভাগ মানুষের অ্যাসাইলাম কেস অ্যাপ্রুভ হতে সময় লাগে বলে তারা গাড়ির লাইসেন্সও করতে পারেন না। সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেল দিয়ে খাবার ডেলিভারি করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে বাসা ভাড়াও দিতে পারেন না। তখন দেশ থেকে টাকা এনে ভাড়া মেটান। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেসমেন্টে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
জানা গেছে, যেসব সরকারি কর্মকর্তা আমেরিকায় অ্যাসাইলাম কেস ফাইল করেন, তারা পরিকল্পিতভাবেই সরকারি পাসপোর্ট না করিয়ে সাধারণ পাসপোর্ট করান। সাধারণ পাসপোর্ট হলে তিনি সরকারি চাকরিতে না থাকলে কিংবা সরকার চাকরি থেকে বাদ দিলেও তার পাসপোর্ট স্যারেন্ডার করার বাধ্যবাধকতা নেই। সরকারি পাসপোর্ট নিলে তিনি যখন চাকরিতে থাকবেন না তখন তাকে সরকারি পাসপোর্ট স্যারেন্ডার করে সাধারণ পাসপোর্ট নিতে হবে। যারা পরিকল্পিতভাবে অ্যাসাইলাম করতে চান, তারা সাধারণ পাসপোর্ট করেন। সরকারের কাছ থেকে ভ্রমণ করার কথা বলে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ছুটি নেন। এখানে আসার পর ছুটি শেষ হয়ে গেলেও আর দেশে ফিরে যান না। তখন সরকার থেকে তাকে কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য নোটিশ করা হয়। এর পরও কাজে ফেরেন না। তিনি কাজে না ফেরা পর্যন্ত এ রকম নোটিশ ইস্যু হতে থাকে। তিনি দেশে ফিরে না গিয়ে এখানে থেকেই স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন যে একদিন তার এ দেশে সব হবে। অন্তত আর যা-ই হোক না কেন, সন্তানদের জীবন নিরাপদ ও নিশ্চিত।
অ্যাসাইলাম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে যারা সরকারি চাকরি করছেন, তারা অনেক ভালো ও নিরাপদে আছেন। প্রকৃত কারণ ছাড়া কারও গল্প শুনে বা অন্য কোনো কেসের উদাহরণ দেখে অ্যাসাইলাম আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের উচিত হবে না। অ্যাসাইলাম গ্র্যান্ট হওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কেউ এ দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পেয়ে যাবেন, এটাও মনে করার কারণ নেই। এ দেশে জমা টাকা দিয়ে চলার সুযোগও কম। কারণ বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে টাকা আনার সুযোগ নেই। বছরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত আনা যায়। তা দিয়ে একটি পরিবারের খরচের অর্ধেকও হবে না। সুতরাং অ্যাসাইলাম আবেদন করার আগে এ বিষয়ে জেনেবুঝে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

কমেন্ট বক্স