Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বর্ষা ঋতু

রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বর্ষা ঋতু
তিরিশের দশকে রোমান্টিক কবি ছাড়াও অনেক বিদ্রোহী কবিও বাংলার বর্ষার, বিশেষত আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষায় মুগ্ধ হয়ে নানা ধরনের কবিতা লিখে গিয়েছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, এমনকি বিপ্লববাদী সুকান্তকেও এই বাংলার বর্ষার রূপ প্রভাবিত করেছিল। চল্লিশের আন্দোলনের দশকেও সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে’ ধরনের গান, যা পঞ্চাশের দশকেও সারা বাংলা মাতিয়ে রেখেছিল।
আমাদের বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বর্ষা ঋতু। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে এই বর্ষা দ্বারা তিনি কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তার রচিত কবিতা, গান, এমনকি ছোটগল্পের মধ্যেও বর্ষার বর্ণনা ও উপমা কতখানি সুন্দর ও যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন। তা সত্ত্বেও এ কথা উল্লেখ করা অসংগত নয় যে রবি ঠাকুর ছাড়াও অন্যান্য কবি-লেখকও বাংলার বর্ষার রূপে চমৎকৃত হয়ে অনেক অমর রচনা করে গেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ও তার অনুরাগী কিন্তু আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও ‘ইলশে গুঁড়ি’র মতো কবিতা রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তখনকার ভারতের সবচেয়ে বড় শহরে বাস করতেন। তাই তাকে শহুরে কবি বলে মনে হওয়ার একটা প্রবণতা স্বাভাবিকভাবে এসে যায়। কিন্তু এই প্রবণতা দূর হয়ে যায়, যখন দেখা যায় তাকে পৈতৃক জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য অধুনা বাংলাদেশের শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসর অঞ্চলে বারবার যাতায়াত করতে হয়েছে। ঘন ঘন এত বার আসা-যাওয়ার ফলে গ্রাম-বাংলার বর্ষা, বর্ষণ ও নদ-নদীর সঙ্গে তার নিবিড় পরিচিতি ঘটে। ফলে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ তার মনের মধ্যে স্থায়ী একটি আসন গড়ে তোলে। আমৃত্যু তিনি তা মনের গভীরে যত্ন করে রেখেছিলেন। তার নানা কথায়, কাহিনিতে, কবিতায় ও গানে তা একটু একটু করে ঢেলে দিয়েছেন। বৃষ্টিবাদল ও বর্ষাকাল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই অনুভূতি কেবল বিচিত্রই নয়, প্রশস্তও। এর মধ্যে আছে কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝা, আষাঢ়-শ্রাবণের অনর্গল বৃষ্টির স্রোতোধারা এবং মহা ভাদরের ধীর জলের গাম্ভীর্য।
বৃষ্টিজলে টইটম্বুর নদী তাকে অমোঘভাবে টানত। তাই শিলাইদহতে তার দৃষ্টিনন্দন কুঠিবাড়ি থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রায়ই বোটে চেপে এ নদী থেকে অন্য নদীতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দরকারমতো নদীর ঘাটে বোট বেঁধেছেন। এই নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা নদীর সঙ্গে যেন তার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায়। তাই পদ্মাতেই তার বিচরণ সর্বাধিক।
বৃষ্টির ধ্বনি তাকে এতই আকৃষ্ট করত যে ছেলেবেলায় তিনি ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এলো বান’ ছড়াটি লিখে ফেলেছিলেন। পরিণত বয়সে শিলাইদহ এলাকায় এসে তার যে বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়, তা তার ভাবনার জগতে গুণগত ও নান্দনিক পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। তার মনের গভীরে ভাববাদিতা ও জীবনবাদিতার একটা সমন্বয় সাধিত হয়। একদিকে অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে চারপাশ ঝাপসা হয়ে উঠলে তা কবির মনে বিষণ্নতা এনে দিয়েছে। অন্যদিকে ঝোড়ো হাওয়ায় গাছগাছালির হেলন-দুলন ও সেই মাতাল হাওয়ায় নদীর প্রবল ঢেউ তার চেতনায় প্রাণশক্তি জুগিয়েছে।
বৃষ্টিধোয়া মাটির সোঁদা গন্ধ, ফুলের সুবাস, বৃষ্টিকালীন ঝোড়ো হাওয়ায় নদীর উথালপাতাল ঢেউ তাকে মুগ্ধ করেছে। দুকূল জোড়া ভরা নদী তার অপরূপ লেগেছে। পালতোলা নৌকা, সোনালি ধান, ধানকাটা চাষি ও হালধরা মাঝি তার অনেক অমর কবিতায় স্থান পেয়েছে। আবার প্রকৃতির এই অপরূপ রূপের বিপরীতে গরিব, দুস্থ, নিঃস্ব, অসহায় চাষি ও সাধারণ জনজীবন তার কবিতায়, গানে, ছোটগল্পে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, এমনকি স্মৃতিচারণেও সমান গুরুত্বে উল্লেখিত হয়েছে।
ঠিক বৃষ্টি যেমন মাটিকে ভেজায়, ফুলের কুঁড়িকে প্রস্ফুটিত করে, নদীকে প্লাবিত করে, তেমনি এই বৃষ্টি কবির মনের মাঝেও ফোটায় এক অনুভূতির ফুল। বৃষ্টি যখন ঝমঝম করে নাগাড়ে পড়তে থাকে, তখন কবিরও প্রাণভরে গান, কবিতা, কাহিনি লেখার আগ্রহ প্রবলভাবে বেড়ে যায়। তখন তার চিঠি, গদ্যের বদলে কবিতায় লিখতে ইচ্ছে হয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথ তখন গীতিকার রবীন্দ্রনাথে পরিণত হয়ে গেছেন।
বৃষ্টিঝরা রাতদিনের মায়াবী প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের বর্ষা ঋতুর গানে। অনেকের মতে, এই পর্যায়ের গানগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। গীতবিতানের প্রকৃতি পর্যায়ের মধ্যে বর্ষা ঋতুর গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ১৩৪ বা ১৩৫টির মতো হবে। যদিও এর সবগুলোই গ্রাম-বাংলায় বসে লেখা নয়, তবু অন্যান্য অঞ্চল থেকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতেও তার বর্ষণপ্রীতি পরিষ্কার বোঝা যায়।
শ্রাবণের বর্ষা যে রবীন্দ্রনাথের গানের একটি উৎস তার প্রমাণ মেলে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ নামের অতীব জনপ্রিয় একটি গানে। পদ্মা-শিলাইদহের প্রকৃতি ও পরিবেশ রবীন্দ্রনাথকে এতটা মজিয়ে রেখেছিল যে তিনি ভিন্ন ধরনের কবিতা বা গানেও নৌকাভরা সোনালি পাকা ধান, ছুটে চলা জলস্রোতের কথাও লিখে গিয়েছেন।
সাধারণত মেঘমেদুর, আকাশের দিকে তাকালে যেন একটা বিষণ্নতার ছায়া নেমে আসে। তাই পাঠক-শ্রোতা ভাবতেই পারেন বর্ষা ঋতু বিষাদ-বিষণ্নতার, বিরহ-বেদনার ঋতু। হোক না সে ভাববাদিতার বা ব্যক্তি-বিরহের। ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ গানটি যেন সে কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে বিষাদ বা বিষণ্নতা বর্ষা ঋতুর শেষ কথা নয়। এটি বোঝা যায়, ‘আজি বর্ষা রাতের শেষে’ গানটিতে, যেখানে ‘সজল মেঘের কোমল আলোয় অরুণ আলো মিশে’ হৃদয়কে যেন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ রকম আরেকটি গান ‘পুব হাওয়াতে দেয় দোলা, হৃদয় নদী কূলে কূলে’।
অন্যদিকে অবশ্য শ্রাবণ রাতের বিরামহীন বৃষ্টিধারা গভীর বিষণ্নতাও ছড়ায়, যেমন ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা’ গানে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী হয়ে যেন উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে, নিঃসীম শূন্যে’। আবার ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণ সখা বন্ধু হে আমার’ গানটির মধ্যে যেন বিচ্ছেদ-বেদনা ও মিলনাকাক্সক্ষার তীব্রতা পাশাপাশি সমানে সমান।
ভাববাদিতা বা অধ্যাত্মবাদিতার চেয়ে বাংলার বর্ষার জাগতিক রূপের তীব্রতা রবীন্দ্রনাথের মনকে আচ্ছন্ন করেছে বেশি। বোটে বসে কবি দেখেছেন নদীর চরে প্লাবনের দরুন কৃষকদের বাধ্য হয়ে কাঁচা ধান কেটে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। বন্যার কারণে অসময়ে এই কাঁচা ধান কাটার ক্ষতির হাহাকার। মানবজীবনের বিপর্যয়ের এই ছবি একান্তভাবেই অবিরাম বৃষ্টির ফল। কবি ভেবে পান না, মাঝে মাঝে প্রকৃতি কেন এমন অকরুণ হয়? কেন অসহায় মানুষের ভাগ্যেই এই দুর্ভোগ? পশুপক্ষীদের তো বাইরে বেরোতে হয় না। অথচ এই নিরপরাধ, অসহায় মানুষদের দুর্যোগের মধ্যেও ঠিকই বেরিয়ে পড়তে হয়। ঘরে বসে থাকা তাদের ভাগ্যে নেই।
ভরা পদ্মার ভয়ংকর প্রকৃতি, অবিরাম বর্ষণে বিপর্যস্ত মানবজীবনের চিত্র যেমন চিঠিতে, ডায়েরিতে তিনি ধরে রেখেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথের পদ্মা পর্বের ছোটগল্পে সেগুলো স্থান পেয়েছে। কখনো তা রোমান্টিকতায়, কখনো দুর্ভোগ-দুর্দশার প্রকাশ হিসেবে, যাতে তার জীবন ও বাস্তববাদী শিল্পীচরিত্র ফুটে উঠেছে। এমনকি তা কবিতাতেও ছড়িয়ে গেছে। ‘সোনার তরী’ রচনা প্রসঙ্গে তিনি এ সম্বন্ধে কিছু লিখে গেছেন, ‘ছিলাম তখন পদ্মার বোটে... বর্ষার পরিপূর্ণ পদ্মা খরবেগে বয়ে চলেছে’ ইত্যাদি।
তবে তার ছোটগল্পে এর বাস্তবতা অধিকতরভাবে ধরা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘পোস্টমাষ্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘একরাত্রি’, ‘মহামায়া’, ‘শাস্তি’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘মণিহারা’ এবং বেশি করে বলতে হয় ‘অতিথি’ গল্পটির কথা। এগুলোর মধ্যে পদ্মা, অবিরাম বৃষ্টি, ঝড়জলের একটা না একটা প্রসঙ্গ আছেই। তবে ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পটি শ্রাবণ মাসে লেখা হলেও ‘ছুটি’ পৌষে, ‘মহামায়া’ ফাল্গুনে এবং ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ অগ্রহায়ণে লেখা হয়েছে। তা হলেও এগুলোতে বর্ষা-বর্ষণ ও জলস্রোতের উপস্থিতি যোগ করার ব্যাপারে কোনো ঘাটতি লক্ষ করা যায় না।
তথ্যসূত্র : সঞ্চয়িতা, গীতবিতান এবং সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য পাতা।

কমেন্ট বক্স