১০ জুন সোমবার দিনটি অন্যরকম হতে পারতো, যদি বাংলাদেশ জিততো। জেতার তো কথাই ছিল। প্রথম ইনিংস শেষে স্কোর তা-ই জানান দিচ্ছিলো। কিন্তু শেষমেষ হারের পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশিকে। ৩৪ হাজার ধারণক্ষমতার নাসাউ কাউন্টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এদিন প্রায় ২২ হাজার ক্রিকেটপ্রেমী জড়ো হয়েছিলেন। পুরো স্টেডিয়াম ছেয়ে গিয়েছিল লাল-সবুজের পতাকায়। বিদেশের মাটিতে খেলার মাঠে এত বাংলাদেশির উপস্থিতি বোধহয় আর কোথাও হয়নি। 
বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে হারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, অবিশ্বাস্য সমর্থন ছিল আমাদের। ভাগ্য খারাপ। আমরা হেরে গেছি। 
শুধু খেলার মাঠে কেন, প্রবাসে আর কোথাও কখনো একসঙ্গে ২০ হাজারের বেশী বাংলাদেশি এক হয়েছে এমন নজীর নেই। নিউইয়র্কে সবচেয়ে বড় ফোবানা সম্মেলন হয়েছে নিউইয়র্কে মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ২০০০ সালে। সেসময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের বড় ধরনের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু তা কোনোভাবেই দশ হাজারের বেশী হবে না বলে জানা গেছে। এছাড়া গত চার দশকে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সমাবেশ হয়েছে। কোথাও ২০ হাজার বাংলাদেশিকে এক করা যায়নি। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেট তাদের এক করে দেখিয়েছে। সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জিতলে আগামীর ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু এই বিপুল বাংলাদেশিকে হতাশ করেছে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবে। তাই বলে এমন হার! 
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচে চার রানের জয় নিয়ে সুপার এইটে খেলা নিশ্চিত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ঠিক যেন গত দিনের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের পুনঃপ্রচার দেখা গেল একই মাঠে একই উইকেটে। শুরুতে ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা ১১৩ রান তোলে, জবাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ১০৯ রান তুলতে পারে পুরো ২০ ওভার ব্যাট করে। নিউইয়র্কের উইকেট ছিল আগের ম্যাচগুলোর মতোই, রান করার জন্য ছিল কষ্টকর এবং ব্যাটারদের সাবধানী ব্যাট করতে হয়েছে। তবুও ১১৩ রানের লক্ষ্যটা ইনিংসের পুরোটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ অতিক্রম করে ফেলবে কিন্তু শেষ চার ওভারে ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে চলে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শতভাগ জয়ের রেকর্ড ধরে রেখেছে।
ওদিকে বাংলাদেশ ২ ম্যাচ খেলে একটিতে জিতেছে, একটিতে হেরেছে, এখনও বাংলাদেশের সুপার এইটে খেলার সম্ভাবনা পুরোপুরি অক্ষত আছে।
টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, আপাত দৃষ্টিতে ম্যাচে মনে হচ্ছিল এটা ভুল সিদ্ধান্ত কিন্তু শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা নিজেদের করে নিয়েছে। ব্যবধান ছোট কিন্তু টুর্নামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্ট নিশ্চিত করে দক্ষিণ আফ্রিকা সুপার এইটে খেলা নিশ্চিত করেছে। ম্যাচের শুরু থেকেই বাংলাদেশ দাপুটে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, গত কয়েক মাসের মলিন বাংলাদেশ দলের ছাপ এই দলে ছিল না।
তানজিম সাকিব প্রায় একাই বাংলাদেশের পক্ষে এই ম্যাচের ছন্দ এনে দিয়েছিলেন, প্রথম ওভারেই রিজা হেন্ড্রিক্সের উইকেট তুলে নেন সাকিব, তানজিম সাকিবের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে হেন্ড্রিক্স গোল্ডেন ডাক নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। তৃতীয় ওভারে এসে কুইন্টন ডি কককে বোল্ড করেন সাকিব, এই ফাস্ট বোলারের রাউন্ড দ্য উইকেট বলের বাউন্স মিস করেন ডি কক।
উইকেট উৎসবে পরের ওভারে সাকিবের সাথে যোগ দেন তাসকিন আহমেদ। তাসকিন এইডেন মারক্রামকে বোল্ড করার সাথে সাথে নিউইয়র্কের স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে লাল সবুজ জার্সির একটা ঢেউ ওঠে। এর তিন বলের মধ্যে তানজিম সাকিবের বলে ত্রিস্তান স্টাবস ক্যাচ তুলে দেন ধরেন আরেক সাকিব, সাকিব আল হাসান, যিনি ম্যাচ জুড়েই ছিলেন নিষ্প্রভ। এর পরে দক্ষিণ আফ্রিকা ধীরে ধীরে ম্যাচে ফেরে, হেইনরিখ ক্লাসেনের সাথে জুটি গড়েন আগের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের নায়ক ডেভিড মিলার। পঞ্চম উইকেটে ৭৯ রানের জুটি গড়েন এ দুজন, এটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে পঞ্চম উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ রানের জুটি।
উইকেটের আচরণ বিবেচনা করে ব্যাট করা এই জুটিটাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে লড়াই করার মতো একটা পুঁজি এনে দেয়। শেষ পর্যন্ত ক্লাসেন ৪৬ ও মিলার ২৯ রান তোলেন।
জবাব দিতে নেমে তানজিদ তামিমের ব্যাটে বাংলাদেশ ইতিবাচক শুরু পেলেও তামিম ৯ রান করে আউট হয়ে যান, যথারীতি ব্যর্থ হন লিটন দাস, নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাকিব আল হাসান। এই তিন জনের ব্যাট হাতে ব্যর্থতা বাংলাদেশকে বেশ ভোগাচ্ছে, সাথে সাকিব তো বল হাতেও এখন দায়িত্ব নিতে পারছেন না।
বাংলাদেশের ৫০ রানেই চার উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দায়িত্ব নিয়ে খেলেন তাওহীদ হৃদয় ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ৪৪ রানের জুটি গড়েন এ দুজন। হৃদয় আউট হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশ আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি। 
১৭তম ওভারে বার্টম্যানের বল রিয়াদের পায়ে লেগে ফাইন লেগ দিয়ে বাউন্ডারি পার হয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা আপিল করার সাথে সাথেই আঙ্গুল তোলেন আম্পায়ার। এতে করে লেগ বাই থেকে সম্ভাব্য চার রান বাতিল হয় বাংলাদেশের। রিয়াদ সাথে সাথে রিভিউ নিলে দেখা যায় লেগ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে দিয়ে যেত বলটা।
বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিক শিহাব আহসান খান বলেন, রিয়াদ রিভিউ নিয়ে বাঁচলেও আম্পায়ার আউট দেবার কারণে নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ একটা বাউন্ডারি পায়নি এবং বাংলাদেশ হেরেছে চার রানে।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার সঞ্জয় মানজ্রেকার একটা ভাবনা শেয়ার করে বলেন, এই সব ক্ষেত্রে পুরো বলের অ্যাকশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আম্পায়ার নিজের রায় জানাতে পারেন, এতে করে ঐ বলের রান বাতিল হবে না।
এই আলোচনায় তামিম ইকবালও একমত হন সঞ্জয়ের সাথে যদি ব্যাটার নট আউট থাকেন এবং সেটা চার হয় এটা রান দেয়া উচিৎ। এই চার রান বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক।
তামিম বলেন, আইসিসি এটা নিয়ে ভাবতে পারে, এটায় বদল আনা দরকার।
ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম জাফরও এক্স প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য খারাপ লাগছে। রিয়াদের লেগ বিফোরটি আউট ছিল না, সেটি থেকে আসা চার রানও বাতিল হয়ে গেল এমন এক সিদ্ধান্তে।
এরপরে তাওহীদ হৃদয় প্রায় লেগ স্ট্যাম্প ছুঁয়ে যাওয়া বলে আম্পায়ার্স কলে আউট হয়ে যান, ৩৪ বলে ৩৭ করা হৃদয়কে গোটা ম্যাচের সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী ব্যাটার মনে হচ্ছিল।
হৃদয় এমনভাবে ব্যাট করছিলেন মনেই হচ্ছিল না এই উইকেটে ব্যাট করা কঠিন কিছু। ২টি চার ২টি ছক্কায় সাজানো ইনিংস দেখে মনে হচ্ছিল তিনি জিতিয়েই মাঠ ছাড়বেন।
দুই ম্যাচে ১৪২ স্ট্রাইক রেটে ৭৭ রান তুলেছেন হৃদয়, এই উইকেটে ভিরাট বাবরের মতো ব্যাটাররাও রান তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। হৃদয় এই ম্যাচে পেস বোলারদের খুব ভালো সামলেছেন। কোনও শটেই তাকে দ্বিধাগ্রস্থ মনে হয়নি।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১১, এই জায়গা থেকে ২ বলে ৬ রান। এমন সময়ে রিয়াদ ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টায় সোজা বল তুলে মারেন, সেখান থেকে এইডেন মারক্রাম ম্যাচ জেতানো একটা ক্যাচ ধরেন, যা সহজেই টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা ক্যাচ। রিয়াদ অবিশ্বাস ও হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, জয় থেকে মাত্র ১ গজ দূরে ছিল বাংলাদেশ।
শেষ ওভারে কেশভ মহারাজ ৩টি ফুল টস বল দেন, বাংলাদেশের ব্যাটাররা একটিও কাজে লাগাতে পারেননি।
রিয়াদ করেছেন ২৭ বলে ২০ রান। রিয়াদ যেন এইসব মুহূর্তের জন্যই এখনো ক্রিকেট খেলছেন সেই ২০১৬ সালের ভারতের বিপক্ষে ব্যাঙ্গালোরের ম্যাচের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন অনেকেই, সেদিন প্রয়োজন ছিল ৩ বলে ২ রান।
 
                           
        
                            
                       
     
  
 

 
                                


 
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                     
                                         
                                        
                                    