Thikana News
২৪ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

প্রশ্ন

প্রশ্ন
সোনিয়া তাসনিম : দুপুরের পর থেকে আকাশে হুড়মুড়িয়ে মেঘের দল উপস্থিত হতে শুরু করেছে। অভিমানী কন্যার মতো মুখ ভার করা বাদল স্তূপের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন অজান্তেই খারাপ করল আমার। ছিঁচকাঁদুনে মেয়েদের মতো ন্যাকামো শুরু হয়েছে সেই সকাল থেকে। একটু ছোঁয়া লাগল তো ব্যস! অভিমানের অশ্রু বিসর্জন যেন আর থামাথামির নামই নিতে চায় না একেবারে। চাঁছাছোলা জানালার গরাদের ফাঁক গলে দৃষ্টি বাইরের দিকে ফেলি। পাশেই বড় কামিনিগাছটা কেমন ঝাঁকড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সদ্য পরিণয়ের স্পর্শ যেন জেগেছে ওতে। সাদা সাদা ফুলে কেমন ছেয়ে গেছে ওর বসন। যৌবনের ভারে লাজুক রমণীর মতো ওর সলজ্জ চিবুক মৃত্তিকার আঁচল ছুঁই-ছুঁই করছে। 

উঠোনের কিনারা ঘেঁষে হলুদের চারার কচি হালকা সবুজ পাতার ছড়া বেরিয়েছে। বৃষ্টির জল জমে কেমন রুপালি আস্তরণ জেগে উঠেছে ওদের গাত্রে। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেই মোমের বিন্দুর মতো গড়িয়ে পড়বে অনায়াসে। রঙিন ঘুড়ির মতো খুদে ফড়িংরা ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। মনে হচ্ছে, অদৃশ্য সেই কারিগর নেপথ্যে বসে পুতুলনাচের মঞ্চে খেলা জমিয়ে তুলছেন নিখুঁতভাবে। তন্ময় হয়ে পড়ি। খুব চেনা দৃশ্য। আপনমনে মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকি। ছেলেবেলায় এদের এক-দুটো পাকড়ে নিয়ে পশ্চাদ্দেশে সুতো বেঁধে নিয়ে খেলা করতে কেমন অলীক এক আনন্দ অনুভব করতাম। অথচ আজ সেটাকে নিছকই ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। 

জীবন আসলেই বড্ড অদ্ভুত! সময়ের নাটাইয়ে সুতো ছেড়ে নেওয়ার সাথে সাথে ভাবনাচিন্তারও কতই-না পরিবর্তন আসে সত্যি! সামনেই মজা পুকুরের কোলজুড়ে আলো করে ফুটে রয়েছে বেগনে কচুরিপানার কুসুমরাজি। চঞ্চল মীনেদের দৌরাত্ম্যে সবুজ সাম্রাজ্যে মৃদু কম্পন জাগে হঠাৎ হঠাৎ। নাম না-জানা এক পাখি চোখ বুজে ঠায় হয়ে রয়েছে সেই কখন থেকে। থেকে থেকে ওর সুচালো ঠোঁট নামিয়ে নিচ্ছে জলে। কিছু হুটোপুটি, আবার সব নিশ্চুপ, আগের মতোই। থলকমল পুষ্পরাজির মাঝে চলছে কৃষ্ণভ্রমরের ব্যস্ত আনাগোনা। নিস্তব্ধতা আর নীরবতার মৌন সুতোর ফোঁড়ে যেন কোন এক অজানা নকশিকাঁথা বুনে চলেছে অলক্ষ্যে। অদূরে আউশের খেতে লেগেছে সবুজের ঢেউ। কচি ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে কোঁচর ভরে আনন্দ কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত গুটি কতক শিশু। ওদের ভিজে জবজবে চুলের আগায় মুক্তো কণার মতো জ্বলজ্বল করছে জলকণা। আচমকা এই পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে শরীরের বুকের বাম পাশে যেন ঘাপটি মেরে থাকা এক শিশুসত্ত্বা জেগে ওঠে আমার। খুব ইচ্ছে হয় আমিও দৌড়ে চলে যাই ওই অবারিত শ্যামলের বুকে। দু’হাতের মুঠো ভরে তুলে নিই রুপালিরঙা আঁশটে ঘ্রাণে মাতোয়ারা করা আনন্দে। লোভী বেড়ালের মতো আমার দৃষ্টি চকচক করে ওঠে। টিনের চালে টুপটাপ শব্দ বেজে ওঠে। পাকা জাম ঝরে পড়ছে বুঝি আবারও। আচমকা বৈরাগীর মতো শীতল বাতাস দৌড়ে যায় আঙিনায়। আলতো সমীরণে বাজে ওর মনের ছন্দ। চোখ বুজে অনুভব করছিলাম সেই দক্ষিণা।

-বাবু, তোর চা...একটা নরম গলার স্বরে চোখ মেলে নিই। কচি ডগার মতো বাহুতে সাজানো বর্ণিল চুড়ির মাঝে জেগে ওঠা রিনরিন ছন্দের মতো কণ্ঠটা। যেন ফুরিয়ে গেলেও তার রেশ রয়ে যায় বহুক্ষণ। ঘরের মাঝে জমাটবাঁধা অন্ধকার দৌড়ে বেড়াচ্ছে ইতিউতি। বাইরে থেকে ভেজা মাটির ঘ্রাণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে চোখেমুখে। এক অদ্ভুত মাদকতা জড়ানো ওতে। দৃষ্টি কিছুটা সয়ে এলে ভালো করে তাকাই এবার। বছর দশেকের একটি মেয়ে। উদোম গায়ে লালরঙা ডুরে শাড়ি পেঁচানো। দুটি হাত ভরা লাল কাচের বাহুবন্ধনী। এই আঁধারের মাঝেও যেন ওসবে রবি কিরণ দ্যুতি নেচে বেড়াচ্ছে। কামরার আলো-ছায়ার প্রসাধনী ওর কৃষ্ণ বদনে এক অন্য রকম মায়ার আবেশ বুলিয়ে দিয়েছে। সুডৌল নাকের কোলে জোনাকির ন্যায় জ্বলজ্বল করছে নোলক শোভা। কচি চেহারাটার মাঝে কেমন যেন তুলির সূক্ষ্ম আঁচড় বুলিয়ে নেওয়া। দেখলে মনে হয় বুঝি...

-ওই বাবু, নে তোর চা নে...কণ্ঠে যেন বকুল ফুলের মতো অসহিষ্ণুতা ঝরে পড়ল। মাটির গালিচায় যেন গড়িয়ে পড়ল এক অনুনয়ের মাল্য। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে ওর হাত থেকে কাপটা নিয়ে নিই। কাপ না বলে ওটাকে নড়বড়ে মাটির ভাঁড় বলাই ভালো। হাতসহ সেটাকে নাকের কাছে আনতেই চমৎকার এক গন্ধ নাসারন্ধ্র ভেদ করে বুঝি মস্তিষ্কের খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে পড়ল। তাতে তৃপ্তির চুমুক দিতে দিতে দুষ্টুমি করে বলি

-আজ যে কেবল চা?
-হুম। ঘরে কিছু নাই আর...পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে নিতে নিতে উত্তর করে বানু। ওহ, বলা হয়নি, মেয়েটির নাম বানু। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের দপ্তরি রজত কাকার মেয়ে। ভারি মিষ্টি দেখতে। রজত কাকার মুখের ছাঁচেই যেন ওর মুখশ্রী গড়ে উঠেছে। সেই নাক, সেই চোখ, সেই হাসি! আমি আবারও ভাবনার সাগরে ডুব দিই। আচ্ছা! সবাই বলে, বাবার আদলে গড়া মেয়েরা নাকি ভাগ্যবতী হয়। কথাটা কি আসলেই সত্যি! তা না হলে...
-বাবু, পেয়ারা খাবি? খলবল করে ওঠা কণ্ঠে যেন গানের পাখি ভর করে থাকে সব সময়। বেশ লাগে ওই সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যেতে। আবারও একটু হেসে বলি
-খেতে পারি। তা, পরি বানু কি সত্যি আমায় পেয়ারা দেবে, আমায়?
আমার কথার জবাব পেলাম দ্রুতই। রক্তজবাপ্রতিম আঁচলের মাঝে থেকে সবুজ রঙের দুটো ডাসা পেয়ারা এগিয়ে দেয় বানু আমার দিকে। জ্যোৎস্নালোকের ন্যায় হাসি ফুটে ওঠে পাতার মতো পাতলা দুটো ওষ্ঠে। বলে, এই নেও...
হাত বাড়িয়ে অঞ্জলির মতো গ্রহণ করি ওর ভালোবাসার অর্ঘ্য। কপট রাগের ঢংয়ে জিজ্ঞাসা করি

-ফের চুরি করেছ বুঝি?
আমার প্রশ্নে কেমন ঝরা পাতার মতো মিইয়ে পড়ে বানু। জড়োসড়ো হয়ে কোনোমতে বলে
-মাপ করি দে রে বাবু, আর হবি নে...
‘হুম’ বলে একটু গম্ভীর হই। তাতে বুঝি আড়ষ্টতা বাড়ল ওর। এবার ঝেড়ে হাসি। বলি
-আচ্ছা, বেশ। তবে আর এমন নয়, বুঝলে? পড়োনি? চুরি করা মহাপাপ!
জবাবে মাথাটা একদিকে কাত হলো কেবল।
-এই দশটা টাকা ওদের গিয়ে দেবে, যাদের বাগানের ফল পেড়ে নিয়েছ। বুঝলে?
হাড়গিলের মতন টেবিলটার ওপর একটা দশ টাকার নোট রেখে বলি কথাটা।
-আইচ্ছা!

ঝলমলে হাসি দিয়ে খপ করে টাকাটা মুঠোতে পুরে নেয় বানু। ওর হাতের চুড়িগুলো কিন্নর কণ্ঠে যেন শরগোল করে ওঠে। বাইরে আঁধার প্রকট হয়ে উঠেছে। জোর বাতাস বইতে শুরু করেছে শটি বনের ঝোপে। কচু খেতের বিন্যস্ত ঝোপে এলোমেলো পায়ে হেঁটে যায় অনীল দূত। তারকানাথ বুড়োর জবানে ওঠা খিস্তির মতো অনেক দূরে কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল। টিনের চালে ধুপধাপ আওয়াজ শুরু হয় সহসা। বাতাসের কড়া শাসন উপেক্ষা করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্বল বেড়ার বেষ্টনীটা কোনোমতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। ওর ওপরে শুকোতে দেওয়া আমার গরাদের পাঞ্জাবিটা অপ্রত্যাশিত অস্তিত্বের মতোই সুরুৎ করে হারিয়ে গেল কোন অজানায়। সেই দিকে দেখে বিড়বিড় করে বলি
-বানু, এখন বাড়ি যাও। ঝড় আসছে তেড়ে।

‘বাড়ি?’ কেমন বিমর্ষ শোনাল ওর কথাটা। সাথে ও পিছু হটল কিছুটা। নিকষ তমসা ভেদ করে ওর মুখের মলিনতা আমার চোখ এড়াল না আজও। যদিও সব জানি, তবুও কেন জানি না কী মনে করে বলি
-কাল বুঝি আবারও খুব করে পড়েছে?

আমার প্রশ্নে বানু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। হতবাক হয়ে পড়ি। এই আলো-ছায়ার আবরণ, এই জল-বাতাসের তরঙ্গে যেন ওর সেই কান্নার ঢেউ মিশে গেল সহজেই। বানু প্রাণপণে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কচি হাত দুটো ব্যস্ত ওর চোখের জলের ধারাকে মুছে নিতে। কী করব বুঝতে পারি না। অসহায়ের মতো দেখে যাই কেবল। বানু ওর হাত দুটো এগিয়ে দেয় আমার দিকে। কোমল চামড়ার ওপর যন্ত্রণার নীলচে ছাপ ফুটে উঠেছে। শিউরে উঠে চোখ সরিয়ে নিই সেদিক থেকে। আমার প্রতিক্রিয়াতে নাকি অক্ষমতাতে জানি না, এবার যেন একটু হাসল বানু। কেমন শ্লেষ্মা মেশানো ওতে। চারদিকের কোলাহল ছাপিয়ে এবার ওর কথা আমার কানে এসে বাজে

-আইচ্ছা বাবু, ক তো? আমি কি সত্য, সত্যই বেজন্মা? মা বাইচ্যা থাকলে কি হেও আমারে নতুন মায়ের লাহান রোইজ এমুনডাই কইত?

কিছু বলি না। বধিরের মতো মৌনতার দরিয়ায় দাঁড় বাইতে থাকি। নিজেকে কেন যেন কাপুরুষের সমার্থক শব্দ বলেই মনে হলো। আমার নীরবতার অর্থকে ওই কোমল প্রাণটি কী বুঝল জানি না। বরাবরের মতোই ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাইরে ছুরির ফলার মতো বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে গেঁথে পড়ছে। ওতে বুঝি বিদ্ধ হচ্ছে বানুর করে নেওয়া প্রশ্নটিও। আমি ঝাপসা নয়নে বাইরে তাকাই। ওই তো বানু চলে যাচ্ছে ধীরে। কী দৃঢ় ওর পদক্ষেপ! কাকতাড়ুয়ার মতো ওর পরনের বসন উড়ছে আলুথালু হয়ে। তাতে বুঝি ছিটকে যাচ্ছে যত পঙ্কিলতা। প্রবল বাতাস ওর চলার গতিকে অবরুদ্ধ করে দিতে অক্ষম হচ্ছে। জোর বর্ষণ শুরু হয়েছে চারদিকে। মেঘের ক্রুদ্ধ শাসনে অবরুদ্ধ চরাচর। আর সেই জান্তব আক্রোশে চাপা পড়ে যাচ্ছে একটি অতি সরল অথচ নিদারুণ কঠিন এক প্রশ্ন।
 

কমেন্ট বক্স