মোহাম্মদ সোহরাব আলী : ঢেঁকির কী সুন্দর শব্দ! এক পাড়ায় ঢেঁকি পাড়ালে অন্য পাড়া থেকে শোনা যেত। সেই শব্দের মধ্যে কী যে জাদু লুকিয়ে ছিল! ঢেঁকি পাড়ানোর শব্দ শুনে মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উদ্বেলিত হতো। কারণ ঢেঁকিতে কুটা চিড়া পাকা তালের সঙ্গে খেতে কী যে মজা লাগত।
আগে ভাদ্র মাসে বর্ষার সময় আউশ ধান কেটে নৌকায় করে আনা হতো। কিছু ধান নৌকায় থেকে যেত। সেই ধান পানিতে ভিজিয়ে রেখে বালিতে ভেজে ঢেঁকিতে কুটা হতো। সেই
চিড়া দেখতে অনেক সুন্দর লাগত। চিড়া পানিতে ভিজিয়ে রেখে শবরি কলা আর দুধ দিয়ে মেখে সঙ্গে একটু চিনি, গুড় বা খেজুরের পাটালি দিয়ে খাওয়া হতো। মা-বোনেরা আগে সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢেঁকিতে ধানপাড়া চাল বের করে তারপর ভাত রান্না করত। আগে গ্রামের প্রায় বাড়িতে একটা করে ঢেঁকি থাকত। এই ঢেঁকি দিয়ে কত কাজ যে করা হতো। আগে গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যেত। আতপ চাল পানিতে ভিজিয়ে রেখে ঢেঁকিতে কুটে পিঠা বানানো হতো। কারও বাড়িতে ঢেঁকি না থাকলে অন্য বাড়ি থেকে পাড়িয়ে নিয়ে আসা হতো। ঢেঁকিতে আগে মানুষ হলুদ কুটত। হলুদ পাড়িয়ে ছালন দিয়ে ছেঁকা হতো। আগে বিয়ে, সুন্নতে খাতনায় বরন দেওয়া হতো। কাঁচা হলুদ ঢেঁকিতে ছেঁচে পালান থেকে দূর্বাঘাস এনে সরিষার তেল একটা বাটিতে রেখে তার মধ্যে দূর্বাঘাস রেখে কলাপাতার ওপর কাঁচা হলুদ বাঁটা রাখাকে বরন বলা হতো।
কয়েকজন একসঙ্গে ঢেঁকি পাড়িয়ে বরন তৈরি করত। বরন তৈরির সময় কিছু গীত পরিবেশন করা হতো। যেমন এত দিনও ছিলে রে দুবলা আলানে-পালানে, আজ কেন আইছো রে দুবলা (যার বিয়ে হতো বা সুন্নতে খাতনা হতো, তার নাম ধরে বলা হতো) বরন বলিতে নারে। নানি-দাদিরা সেই রকম নাচানাচি করত। ঢেঁকি যে ঘরে থাকত, সেখানে লোকজন ভরে যেত। নেকড়ায় আগুন লাগিয়ে চালনের এক কোণায় রাখা হতো। একটা পাটা নিচে রাখা হতো। পাটার ওপর বরকে বসতে দিত। বরের মাথার ওপর একটা শাড়ি ধরে রাখা হতো। শাড়ির মধ্যে পান-সুপারি রাখা হতো। কেউ আবার বরের চারপাশে বদনা ভরে পানি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বরের বৃদ্ধাঙ্গুলে ঢেলে দিত। কেউ আবার জিজ্ঞাসা করত, কয় মাসের ভদ্য কাটলে? বলত, এক মাসের দু মাসের। এভাবে সাতবার বৃদ্ধাঙ্গুলে বদনায় করে পানি ঢালা হতো। শুকনো মরিচ ভেজে ঢেঁকিতে পাড়ানো হতো। ঢেঁকিতে মরিচ পাড়ানোর সময় সেই তলব বা ঝাঁজ বের হতো। এ সময় প্রায় লোকই হাঁচি দিত। ঢেঁকিতে কুটা যবের ছাতু কী যে স্বাদ লাগত! গরমের সময়ে ঢেঁকিতে যবের ছাতু কুটে বেশি করে ঠান্ডা পানি মিশিয়ে মানুষ পেটভরে খেত। পাকা আম দিয়ে যবের ছাতু খেতে সেই মজা লাগত। ঢেঁকিতে চিনি পাড়িয়ে চিনির ভাত রান্না করা হতো। চিনির ভাত ইলিশ মাছ দিয়ে খেলে কী যে মজা লাগত।
ঢেঁকিতে গম পাড়িয়ে গমের ভাত রান্না করা হতো। ঢেঁকিতে মসুর পাড়িয়ে ডাল বের করে রান্না করা হতো। সেই ডাল কাঁচা আম দিয়ে রান্না করলে কী যে স্বাদ লাগত। আগে বুড়ে ও কাউন ঢেঁকিতে পাড়িয়ে পায়েস রান্না করা হতো। সেই পায়েস কী যে স্বাদ লাগত। গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা কুসংস্কার ছিলÑকারও বাড়ির ওপর দিয়ে মধুর মাছি উড়ে গেলে ঢেঁকিতে গিয়ে পাড় দিত। তাদের বিশ্বাস, ঢেঁকিতে পাড় দিলে গাছে মধুর চাক বসত।
জেলেরা আগে গাছ থেকে গাব পেড়ে সেই গাব ঢেঁকিতে কুটে জাল দিত। আগে ঘরের বেড়া দেওয়া হতো তালাই দিয়ে। তালাইতে যাতে ঘুণে না ধরে, সে জন্য গাব ঢেঁকিতে কুটে তালাইতে দেওয়া হতো অর্থাৎ ঘরের বেড়ায় দেওয়া হতো। ঢেঁকিতে খাটি ব্যবহার করা হতো। সেই খাটি বানানো হতো বাঁশ বা কাঠ দিয়ে। কাঠের খাটি বাঁশের খাটির চেয়ে বেশি মজবুত হতো। ঢেঁকির খাটি যদি নটালি দেওয়ার সময় কারও হাতে অসাবধানতাবশত পাড় লাগত, তার হাতের আঙুল ছেঁচে যেত। তাদের ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো। ঢেঁকির খাটি ঢেঁকি ছাড়াও আরও কত কাজে ব্যবহার করা হতো। যেমন ঢেঁকির খাটি দিয়ে বাড়ি দিয়ে খুঁটি মাটিতে গাড়া হতো। ঢেঁকির খাটি দিয়ে জমির মাটির দলা ভাঙা হতো। ঢেঁকির খাটি দিয়ে শিয়ালকে আঘাত করা হতো। খাটাশকে লক্ষ্য করেও ঢেঁকির খাটি ছুড়ে মারা হতো।
রাতে গ্রামের বাড়িতে ডাকাত পড়লে কেউ কেউ আবার লাঠি, ইটে, মুগুর বা ঢেঁকির খাটি দিয়ে ডাকাত তাড়া করত। কেউ আবার কোরবানির ঈদে ছাগল কোরবানি দিলে ঢেঁকির খাটির ওপর ছাগলের মাথা রেখে জবাই করত। ঢেঁকির খাটির ওপর খড় রেখে তা দা দিয়ে ছোট করে কাটা হতো। অনেক সময় আখের ডম খাটির ওপর রেখে কাটা হতো। ঢেঁকির কান্তা বানানো হতো বাঁশ বা কাঠ দিয়ে। একটা বাঁশের পার্ট আরেকটা বাঁশের পার্টের মধ্যে ঢুকিয়ে কী সুন্দর করে কান্তা বানানো হতো। ঢেঁকি পাড়ানোর সময় ঢেঁকির কান্তা কেরাত কেরাত শব্দ করত। শব্দ যেন না হয়, এ জন্য (বাকি অংশ ৪৫-এর পাতায়)