Thikana News
২৪ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

চোখের ভাষা

চোখের ভাষা
মোহাম্মদ সোহরাব আলী

মনে পড়ে গেল সেই গান : ‘চোখ যে মনের কথা বলে। চোখের সেই ভাষা বুঝতে হলে মনের মতো মন থাকা চাই। চোখ যে মনের কথা বলে।’ মানুষ শুধু মুখ দিয়ে কথা বলে না, চোখ দেখেও অনেক সময় মানুষ কী বলতে চায়, অনেকে তা বুঝতে পারে। চোখের মাধ্যমে মানুষ অনেক সময় ভালোবাসা, রাগ, সুখ, দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে। ছোটবেলায় কত দুষ্টুমি করেছি। আম্মু গায়ে তেমন হাত তোলেননি, কিন্তু তার রাগান্বিত চোখ দেখে বুঝতে দেরি হয়নি, মা সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকা মোটেই পছন্দ করেন না। মায়ের চোখ দেখে অনেক সময় অনেক কিছু ধারণা করা যায়। মা যে কাজটা পছন্দ করেন, সেই কাজটা করলে মায়ের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় মা কী খুশি হয়েছেন এবং তার মুখে হাসি অনুভব হয়। চোখ ইশারা করেও মানুষ অনেক কিছু বলে।

ছোটবেলায় একবার আমরা গোল্লাছুট খেলছি। আমি ছিলাম গোল্লা। আমাদের প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড় মুখে না বলে চোখের ইশারায় বলল অন্য পক্ষের খেলোয়াড়ের মনোযোগ অন্যদিকে আছে। এই সুযোগে যদি ছোটে, তাহলে গোল্লা গন্তব্যস্থলে গিয়ে গেম দিতে পারবে, কেউ তাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। একবার কোরবানির হাটে গিয়েছিলাম গরু কিনতে। দেখলাম, গরুর দালালরা মুখে কথা না বলে চোখের ইশারায় কীভাবে গরুর দাম ওঠানামা করে বিক্রি করছে। আমরা হৈমন্তী গল্পে পড়েছিলাম, কীভাবে পূজার উপকরণ সাজাতে হয় হৈমন্তী তা না জানায় পাশ থেকে কেউ চোখের ইশারা দিল কিন্তু হৈমন্তী চোখের ইশারা বুঝতে না পারায় তাকে শুনতে হলো নাস্তিকের ঘরের মেয়ে নাকি? একবার কটন কাকা তার শ্যালিকার জন্য জ্যাকসন হাইটসে সোনা কিনতে গিয়েছিল। দোকানদার প্রতি গ্রাম ৬২ ডলার দাম চাইলে সে ৬০ ডলার বলে কিন্তু কটন কাকার বন্ধু পাশ থেকে চোখ টিপে হাতের ইশারায় বলে দিল, ৫৮ ডলারের বেশি দাম বলা যাবে না। দোকানদারের এই দামে বিক্রি করার সম্ভাবনা অনেক। আমরা গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা খেলেছি। চোখের ইশারায় বলে দিয়েছি কে কপালে টিপ দিতে আসবে। মুখে বললে প্রতিপক্ষ সঠিক খেলোয়াড়ের নাম বলতে সক্ষম হবে। আবার চোখের ইশারায় বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় তাদের দলের খেলোয়াড়কে বলে দিত কোন খেলোয়াড় টিপ দিয়েছে। কটন কাকা একজনের কাছ থেকে শুনেছে, আগে নাকি প্রেমিক-প্রেমিকারা চোখের ইশারায় প্রেম করত।

চোখ নিয়ে কত কথা যে আছে, যেমন কেউ বলে কী সুন্দর মায়াবিনী চোখ, হরিণী চোখ। কেউ আবার বলে গোল্লা গোল্লা চোখ, ডাগর ডাগর চোখ, বাঘের মতো চোখ, ডাকাতের মতো চোখ। আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে কথা না বলে আকার, ইঙ্গিত বা ইশারায় কাজ করে বেশি। আমাদের এক স্যার গল্প করেছিলেন। স্যারের বন্ধুরা মিলে হলে থাকতেন। তাদের মধ্যে এত মিল-মহব্বত ছিল যে কারও চোখ পানির কলসের দিকে দেখলে অন্য বন্ধুরা বুঝতে পারত, সে পানি খাবে। তাই তাকে গ্লাসে ভরে পানি দিত। একবার আমাদের এলাকায় ইউপি নির্বাচন হচ্ছিল। আমাদের গ্রামে মোড়ল ছিলেন। আমরা তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন প্রতীকে ভোট দেব। তিনি মুখ দিয়ে না বলে চোখের ইশারায় বলে দিয়েছিলেন। আমরা সেই প্রতীকে ভোট দিয়েছিলাম। একবার আমাদের স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষার ফল বের হবে। আমরা সবাই হেড স্যারের কাছে গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার কে প্রথম হয়েছে। ফলাফলটা তখনো প্রকাশ করা হয়নি। স্যার চোখের ইশারায় বলেছিলেন। এতেই আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম, কে প্রথম হয়েছে। একবার আমাদের গ্রামে এক ঘটকের সঙ্গে ছেলেপক্ষ একটা মেয়ে দেখতে এসেছিল। মেয়ে দেখার পর ঘটককে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলেপক্ষের কি মেয়ে পছন্দ হয়েছে? ঘটক মুখে না বলে চোখের ইশারায় বলে দিল রেজাল্ট পজিটিভ। চোখেরও ভাষা আছে। চোখের ইশারায় আমরা একে অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এই ভাষা বুঝতে হয়। মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের মুখ দেখে যেমন অনেক কিছু বলে দিতে পারেন, তেমনি যারা চোখের ভাষা বোঝেন, তারা চোখ দেখে বুঝতে পারে কী বলতে চাচ্ছে। 

ডাক্তাররা বলেন, কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। তাই অনেকে অনেক সময় মুখের ভাষায় কথা না বলে চোখের ভাষায় কথা বলেন। আমরা চেষ্টা করলে চোখের ভাষায়ও অনেক কিছু বোঝাতে পারি। আমাদের অধ্যক্ষ স্যার ক্লাসে গোলমাল বা শব্দ মোটেই পছন্দ করতেন না। শ্রদ্ধেয় স্যার ক্লাস নিচ্ছেন, হঠাৎ এক ছাত্র আরেক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছে। স্যারের কানে সে আওয়াজ পৌঁছালে স্যার এক সেকেন্ড এমনভাবে ওই ছাত্র দুটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এটা দেখে তাদের পিলে চমকে গিয়েছিল। তারা এরপর কথা বলা তো দূরের কথা, ক্লাসে মাথা নিচু করে ছিল। অনেক সময় কটন কাকাকেও আমরা দেখেছি, কাকা অফিস থেকে বাসায় এলে চাচিকে চোখের ইশারায় অনেক কিছু বলত। আর চাচি কটন কাকার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে সেই জিনিসগুলো তার সামনে হাজির করত। একবার আমাদের এক বন্ধু চশমা কিনতে দোকানে গিয়েছিল, সে তার প্রিয়তমার বার্থ ডেতে চশমা গিফট করবে। আমাদের আরও কয়েক বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। চার-পাঁচটা চশমা পছন্দ হলেও ফাইনালি কোনটা নেবে, সে জিজ্ঞাসা করলে একজন চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিল ওইটা। আমরাও চোখের ইশারায় ওটাই দেখালাম। ফাইনালি সেটাই কিনেছিল।


মায়ের মতো বড় জ্যোতিষী আর নেই। ছেলেমেয়ের চোখের দিকে মা তাকিয়ে সহজেই বুঝতে পারেন তারা কী চাচ্ছে। বাচ্চারা যখন কথা বলতে পারে না, তাদের কান্না শুনে বা চোখের দিকে তাকিয়েই মা প্রায় কিছু বোঝে ফেলেন। একবার ক্যাম্পাসে দেখলাম, এক প্রেমিকার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমিক বারবার সরি বলছে। সে তাকে কয়েক দিন কল দেয়নি। প্রেমিকা মন ভার করে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেলেছে। প্রেমিক তাকে জান, টিয়া, কলিজা, সুইট হার্ট, লাভ কত কিছু বলছে। কিন্তু প্রেমিকা কথা বলছে না। প্রেমিক বারবার বলছে মিষ্টি, প্লিজ তুমি স্বাভাবিক হও। তুমি কথা বলো, প্লিজ কথা বলো। প্রেমিকার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত প্রেমিকও কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ হয়ে মন ভারী করে চোখ দিয়ে পানি ফেলতে লাগল। তারপর একে অপরের চোখের পানি মুছে দিয়ে দুজন হঠাৎ করে হেসে কথা বলা শুরু করল। সত্যিই চোখের ভাষা অনেক সময় মুখের ভাষার চেয়েও শক্তিশালী হয়।

কমেন্ট বক্স