Thikana News
২৪ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

যেখানে মনগুলো বাতাসে ভাসে

যেখানে মনগুলো বাতাসে ভাসে
মনজুরুল সরকার দুলাল

এ ঘটনা সেই শহরের, যেখানে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের আবু তালেব প্রতিবেশীদের ঘরের দরজার নিচ দিয়ে প্রবেশ না করলে তারা ঘুণাক্ষরেও তার অবস্থান জানতে পারে না। তিনি এখন কোথায়, কোন দেশে? তারা জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। আপনি যদি খেয়াল করেন, দেখবেন একজন প্রতিবেশীর মৃত্যুর খবর জানার পরও তারা কোনোভাবেই অনুভূতির পরশে মাখা কোনো শব্দ অন্তরের অন্তস্তল থেকে বের করে কাউকে সহমর্মী করতে পারছে না কিংবা তারা সে রকম চেষ্টাও করেছে না। অবশ্য অনেকে খবর শোনার পর নগরকেন্দ্রিক কৌশলযুক্ত কথাবার্তা বলেছে নিজেকে জাহির করার জন্য।

মৃত্যু আসে শহরের ষোলো তলাবিশিষ্ট ‘ব্রাইট’ ভবনে, যেখানে দুর্ভাগ্যের হাত থেকে ভবনবাসীকে রক্ষার জন্য তেরো তলা বলে কোনো তলাই খুঁজে পাবেন না। বারো তলার মাথার ওপর বসেছে চৌদ্দ তলা। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানেই আবু তালেব একদিন (মাফ করবেন তারিখ বলতে পারছি না) বিছানায় পচে গলে দুর্গন্ধের রূপ নিয়ে হাওয়ার সঙ্গে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে। প্রতিবেশীরা দুর্গন্ধের প্রকৃত উৎস খুঁজে প্রাণহীন গলিত দেহ আবিষ্কার করে। তারপর সুন্দর সুন্দর বাক্য প্রক্ষেপণ করে এবং অতি তাড়াতাড়ি স্মৃতি মুছে ফেলে।

অথচ জীবিতকালে আবু তালেব তার মেক্সিকান বান্ধবীর স্মৃতি মুছে ফেলতে চায়নি। দুই বছর আগে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী অন্য ছেলের সঙ্গে চলে গেলেও সে এত দিন এই ভবনেই ছিল। তার কথা, ‘বান্ধবীর প্রতিটি পদধ্বনি, প্রতিটি পদচিহ্ন আমি অন্তরে অনুভব করে আনন্দিত হই। যত দিন বেঁচে আছি, ব্রাইট ভবনের এই বাসাতেই থাকব। তাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।’ তবে হতাশা যখন বিড়ালের মতো শব্দহীন পায়ে ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে আসে, তখন সে সাগরের তীরে যায়, সাগরের গর্জন ধারণ করে বেঁচে থাকার সাহস সঞ্চয় করে। কিন্তু হতাশা তাকে সহজে ছাড়ে না, বুকের ভেতর প্রবেশ করে মোচড় দেয়, তারপর ঝরনাধারা হয়ে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে পড়ে। সে সাগরের বালুর বিছানায় উপুড় হয়ে মুখ লুকায়। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। রাত হয়। কিন্তু তার ঘুম ভাঙে না। গভীর ঘুম তাকে জাপটে ধরে থাকে, সৈকত নিরাপত্তাকর্মীর বাঁশির শব্দ খামোখাই বালুচর ঘুরে ঘুরে সাগরের গর্জনে বিলীন হয়ে যায়। রাত গভীর হওয়ার আগে নিরাপত্তাকর্মীরা অনেক চেষ্টা-তদবির করে তাকে জাগিয়ে তোলে, বালুপাড়ের রাস্তায় তুলে দেয়। তখন সে অন্য কোথাও না গিয়ে বাসায় ফিরে আসে। ব্রাইট ভবনের কেউ সেই খবর রাখে না।

সেই ব্রাইট ভবনে এক আজব ঘটনা ঘটে। শুক্রবার যখন সবার আর্থিক চিন্তা নেই বললেই চলে, বিকেল গড়িয়ে গোধূলিলগ্নে সপ্তম তলার বাসিন্দা গায়ানা বংশোদ্ভূত রবার্ট নেলসন রাত্রিকালীন কাজে যাওয়ার আগে ভবনের বাঙালি নিরাপত্তাকর্মী হেলালুর রশিদকে মোবাইলে সংরক্ষণ করা একটা ভিডিও দেখায়। ভিডিওতে একটি শিশু অস্পষ্টভাবে কিছু কথা বলে। ভিডিও শেষ হলে রবার্ট নেলসন বলে, আমার এই ছেলের বয়স মাত্র দুই মাস। তারপর দুই কাঁধ সংকুচিত করে শরীরের এমন ভঙ্গি করে, যার মানে অনেক কিছুই হতে পারে। হেলালুর রশিদ মনে করে, উনি প্রশ্ন করলেন, ‘এখন আপনি কী বলবেন?’

হেলালুর রশিদ স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তার দৃষ্টি নাকবরাবর লবির শূন্য বাতাসে ভাসে। ভাসতে ভাসতে একসময় আটলান্টিক সাগরের বুকের ওপর দিয়ে বিরতিহীন চলতে থাকে। বঙ্গোপসাগরের উষ্ণ হাওয়ায় সতেজ হয়ে মেঘনার তীর ঘেঁষে সোজা ঢাকায়। ঢাকার আকাশে আসতে না আসতেই কানে আসে গান : ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথি মোদের ফুলপরী, ফুলপরী লাল পরী, লাল পরী নীল পরী...।’ চোখ ছুটে যায় ঢাকার শিশু পার্কের ক্যারোসোলের টগবগ করে চলা রঙিন ঘোড়াগুলোতে। ঘোড়ার পিঠে জগৎ ভোলানো হাসিমাখা শিশু। আকাশে-বাতাসে আজ আনন্দ আর আনন্দ। আনন্দকথনে সকলের বুক থৈ থৈ করে। চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে। কে বুঝে, কে দেখে সেসব?

এদিকে জেরেমি ওকাশিও হেলালুর রশিদের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে এই আশায় যে খুব তাড়াতাড়ি তার ভ্রম কাটবে। কিন্তু তা ঘটে না। হেলালুর রশিদ চেয়ারে বসা ভাস্কর্যে রূপান্তরিত হয়। যুগ যুগ ধরে ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এমন এক মহাসংকটের মধ্যে জেরেমি ওকাশিও লক্ষ করে ডাকসাইটে নিরাপত্তাকর্মীর চোখে জল টলটল করে। চোখের জল দেখে সে রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। কী করবে ঠিক করতে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। হঠাৎ হিতাহিতজ্ঞান ভুলে ঘাড়ে হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকি দেয়। হেলালুর রশিদ চমকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বলেÑ

: কী হয়েছে?
: সেটাই তো জানতে চাচ্ছিÑকী হয়েছে?
হেলালুর রশিদ নিজেকে সামলে নেয়। আশপাশে তাকায়। মোনাজাত শেষ করার মতো চোখে-মুখে দুই হাত বোলায়। তারপর মাথাটা সামান্য উঁচু করে, অদৃশ্য জনসভার জনতাকে উদ্দেশ করে বিস্ময়মগ্ন চিত্তে ধীরে ধীরে বলেÑ
: কেয়ামতের আলামত দেখলাম।
: ওহ্ গড।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। কেউ কাউকে তাকিয়েও দেখে না। আসলে তারা নির্দিষ্ট করে কিছুই দেখে না। বোধ করি নিজেদের অন্তরের আয়না দেখার চেষ্টা করে। আয়নায় পরিবারের সকলে আগের মতোই থাকে, কেয়ামতে শুধু নিজের ধ্বংস দেখে আর হতাশার সমুদ্রে ভাসে। জেরেমি ওকাশিও দেখে, মহাসমুদ্রে একটি ডিঙি নৌকায় তার স্কুলপড়ুয়া দুই সন্তান। কীভাবে তারা পার হবে এই অকূল সমুদ্র? অথচ সে বসবাস করে পৃথিবীর রাজধানী নামে খ্যাত নিউইয়র্ক শহরে, যেখানে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে তাদের নিজস্ব বিমান ব্যবহার করে। অথচ সে চলাফেরা করে পাবলিক পরিবহনে। কিন্তু কী অপরাধ সে করেছে? আর তারা কী পুণ্য করছে? উত্তর নেই। সৃষ্টিকর্তা হয়তো জানেন কী খেলা চলছে জগতে। তাই ওসব ভেবে লাভ নেই। কিন্তু ঘটনাটা শোনার কৌতূহল ধামাচাপা দিতে পারে না।
: ঘটনাটা খুলে বলুন, ব্রাদার।
: রবার্ট নেলসনের দুই মাসের সন্তান দিব্যি কথা বলছে।
: বলেন কী?
: আমি নিজের চোখে দেখলাম।

জেরেমি ওকাশিও থমকে যায়, যেন এরপর আর কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। কোনো কথা থাকতে পারে না। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয় মহাপ্রলয় আসন্ন। কিন্তু তার করার কী আছে? সুতরাং নিজের কাজে দেরি করে লাভ নেই, ভাবতে ভাবতে ভবন ত্যাগ করে।

কিন্তু হেলালুর রশিদ ভবনের নিরাপত্তাকর্মী থেকে নিজেকে বিশ্বচরাচরের নিরাপত্তাকর্মীতে উন্নীত করে। জগতের সকল মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া, অন্ততপক্ষে তাদের সাবধান করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়। যারা বাইরের কাজ শেষে ভবনে ফিরছে কিংবা যারা কাজ করতে ভবন ত্যাগ করছে, সবাইকে কেয়ামতের আলামত দর্শনের কথা এবং এই মুহূর্তে মানুষের করণীয় বর্ণনা করতে থাকে। এ-ও বলে, কেয়ামতের পূর্বে মানুষ ভালো কথা শুনবে না, ধর্মের কথা শুনবে না। ভালো কাজ করবে না। না-জায়েজ কাজ করবে। অথচ সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার এটাই প্রকৃত সময়। মানুষ এই সময়কে অবহেলা করলে আর রক্ষা নেই। এসব কথা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে। অবশ্য কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে শোনার অভিনয় করে থাকলেও থাকতে পারে। হেলালুর রশিদ এত নিবিষ্ট হয়ে কথাগুলো বলে যে, কারও অভিনয় ধরার ক্ষমতা তার থাকে না।
কিছুক্ষণের মধ্যে কোনো ব্রেকিং নিউজ কিংবা ভাইরাল পোস্ট ছাড়াই খবরটি ভবনে বসবাসরত উৎসুক জনতার কর্ণগহরে প্রবেশ করে ভবনময় এক গমগমে পরিবেশের সৃষ্টি করে। অনেকে ভবনের বাইরে অবস্থানরত কাছের লোকদের জানানোর জন্য এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে যে নিচের লবি থেকে দু-একজনের উচ্চস্বরে হ্যালো, হ্যালো শোনা যায়।

টানটান উত্তেজনা নিয়ে রাত যখন গভীর, ঠিক সেই সময় অন্য এক ঘটনা ঘটে। স্টিভ জনসন তার হবু বান্ধবীকে নিয়ে, বেসামাল অবস্থায় মাথা হেলেদুলে নিরাপত্তা ডেস্কের সামনে আসে। বড় বড় রক্তাভ ঘোলা চোখে হেলালুর রশিদের চোখে চোখ রাখে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলতে যায়। তবে ঠিকমতো বলা হয়ে ওঠে না। বক্তা কী বললেন, শ্রোতা তা বুঝতে পারে না। কিন্তু বক্তার মুখ থেকে থুতুর ছিটা, নাভিমূল থেকে উত্থিত মাদকমিশ্রিত প্রশ্বাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লবির বাতাস ভারী ও গন্ধযুক্ত হয়ে ওঠে। এমন অস্বস্তির মধ্যে বক্তা যখন নিরাপত্তাচৌকিতে এক পা তুলে নিরাপত্তাকর্মীর সামনে ঝুঁকে গিয়ে ধমক দেওয়ার জন্য অনামিকা আঙুল তাক করে, তখন অস্বস্তির সঙ্গে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে বড় কোনো অঘটন ঘটার আগে একই সঙ্গে দুটি ঘটনা ঘটে।

একদিকে হবু বান্ধবী অনেক কষ্ট করে স্টিভ জনসনকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন করে। তাতে হবু বান্ধবীর কতটা আন্তরিকতা ছিল আমরা জানি না। কিন্তু স্টিভ জনসন নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে। রাগ থামতে শুরু করে।
আর অন্যদিকে একটা ধাক্কা খেয়ে দীর্ঘ সময় পর হেলালুর রশিদের মহাপ্রলয়ের ঘোর কেটে যায়। ভবন নিরাপত্তাকর্মী ধীরে ধীরে বর্তমানে ফিরে আসে। সহজ-সরল ধীর লয়ে জিজ্ঞাসা করে-

: জনসন, আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন?
: জি। আপনি কাকে যেন কী বলেছেন তা শুনে আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী চার্চের সেবায় বাকি জীবন সমর্পণ করতে চায়? কিন্তু সেটা আমার জিজ্ঞাসা নয়, আমার জিজ্ঞাসা দুই মাসের শিশু আপনাকে কী বলেছে?
: না, আমাকে কিছু বলেনি। কাকে উদ্দেশ করে বলেছে, তা-ও জানি না। শিশুর বাবা আমাকে একটা ভিডিও দেখিয়েছে, তাতে শিশুটি কথা বলছে।
: কী বলছে?
: আমি গায়ানার ভাষা বুঝি না।
: আপনি কি শিশুদের ভাষা বোঝেন?
: না, বুঝি না।
: আপনি যা শুনেছেন, তা যে শিশুটিই বলেছে সেটা নিশ্চিত হয়েছেন?
হেলালুর রশিদের গলা শুকিয়ে যায়। কথা বলতে পারে না। শরীরের শক্তি কমে আসে। ধীরলয়ে শুধু না-বোধক মাথা নাড়ে। স্টিভ জনসন তার বান্ধবীর দিকে তাকায়। বান্ধবী এবার ছলছল চোখে, মাথা নিচু করে পরম আন্তরিকতায় বন্ধুকে আলিঙ্গন করে। মাদকের গন্ধ প্রেমের সৌরভে ঢেকে যায়। তারপর স্টিভ জনসন তার বান্ধবীসহ ভবনের এলিভেটরের সামনে গিয়ে বোতাম টিপে অপেক্ষা করে।

কমেন্ট বক্স