মোহাম্মদ সোহরাব আলী
দেখুন তো, আপনার ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে পড়ে কি না? সহপাঠীরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে হঠাৎ মারামারি, এরপর একে অপরের গায়ে চিমটি, কিল বা ঘুসি অথবা ছোট একটা লাঠি দিয়ে একে অপরের গায়ে বাড়ি দেওয়া। এরপর একে অন্যের খেলনা এলোমেলো করে দিয়ে অথবা খেলনা নিয়ে দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে নালিশ। যেমন আমাকে ও মেরেছে, অনেক মেরেছে, জোরে জোরে মেরেছে। মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দিতেন। নিজে আগে মারলেও সেটা না বলে বলা হতো, ও আমাকে আগে মেরেছে। চল, আমরা এখনই যাই ওর আম্মার কাছে এবং বলি তার ছেলে আমাকে মেরেছে, খেলনা লুকিয়ে রেখেছে, জোর করে খেলনার জায়গা দখল করে নিয়েছে, আমার সাথে ঝগড়া করেছে, আমাকে ভয় দেখিয়েছে, আমাকে ওই কাঁঠাল গাছতলায় খেলার জায়গায় যেতে নিষেধ করেছে, আবার যদি যাই আমাকে নাকি মারা হবে। কান্না না এলেও জোরে জোরে কাঁদার চেষ্টা করা, নিজের দোষ থাকলেও সেটা স্বীকার না করা, সহপাঠীর দোষ খুঁজে বের করা। দুজন সহপাঠী তার মায়ের হাত ধরে একে অপরের সঙ্গে কী হয়েছিল, তার বর্ণনা করা।
কখনো নিজের হাতে নিজেই একটা চিমটি কেটে অপর সহপাঠী চিমটি দিয়েছে বলা। চোখের কোণে একটু জল লেগে কান্না করার ভান করা। মায়ের সামনে অপর সহপাঠীর সঙ্গে তর্ক করে অপরকে দোষী সাব্যস্ত করা। একে অপরকে বলা-কখনো আর একসাথে হবে না খেলা। কিন্তু একটু পরই একসঙ্গে বসে খেলাধুলা করা। হাসি-কান্না হয়ে যেত একাকার। পছন্দের কোনো জিনিস না পেলেই কান্নাকাটি আর পেলেই খই-ফোটা হাসি। ছোটবেলায় ঝগড়া, মারামারির শেষ ছিল না। একে অপরের বেলুন কোনো কিছুর সঙ্গে লাগিয়ে অথবা থাপ্পড় বা লাথি মেরে ফাটিয়ে দিলে কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেত। কেন একে অন্যের বেলুন ফাটাল, তা নিয়ে তর্ক হতো। ঝগড়া লেগে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটত। নালিশ করত তারা অভিভাবকের কাছে গিয়ে। বলত, ও ফাটিয়ে ফেলেছে, তুই-ই তো ফাটালি, একাই ফেটে গেছে-কত কিছু যে বলা হতো। সহজে নিজের দোষ কেউ স্বীকার করত না। অপরের দোষ দেওয়া হতো বেশি।
কত কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসানো হতো। কেউ কলাগাছের থুরের খোল দিয়ে নৌকা বানাত, কেউ কলাগাছের খোল কেটে নৌকা বানাত, কেউ আবার নারকেলগাছের ডাগুরের খোল কেটে নৌকা বানাত। মই জাল বা কারেন্ট জাল দিয়ে গিরাফি বানাত। কেউ আবার দুষ্টুমি করে বড় একটা মাটির ঢেলা পানিতে ছুড়ে মারলে ওইসব নৌকা ডুবে যেত। তা নিয়েও কত ঝগড়া-বিবাদ হয়ে অভিভাবকদের কাছে নালিশ করতে চলে যেত। আগে পলি মাটি শুকিয়ে গেলে বড় বড় মাটির দলা হতো, সেই দলা একটার ওপর আরেকটা লাগিয়ে ঘর বানানো হতো। সেই ঘর আবার কেউ লাথি মেরে ভেঙে ফেলত। এ নিয়ে ঝগড়া হতো। ঝগড়া আর মিল-মহব্বত হতে সময় লাগত না। কিন্তু দোষ স্বীকার করাটা অপমানের ব্যাপার ছিল। অপরের দোষটা বেশি ধরা হতো। নিজেকে নির্দোষ ভাবা হতো।
ছোটবেলায় ঘুড়ি বানিয়ে ওড়ানো হতো। একের ঘুড়ির সুতা অপরের ঘুড়ির সুতার সঙ্গে প্যাঁচ লেগে যেত। ঘুড়ির সুতা ছিঁড়ে গিয়ে গাছে বেজে থাকত। গাছে উঠে বা কুটা দিয়ে সেই ঘুড়ি ছাড়িয়ে আনা হতো। কত রকমের ঘুড়ি যে বানানো হতো, যেমন পতিন, কৌরি, চিল, ডাউস, সাপা ঘুড়ি। কৌরি ঘুড়িতে বেত লাগিয়ে ওড়ালে সেই রকম শব্দ হতো। বওলা, ঝিকার আটা, খেজুরের রসের উলা, আঠা বা সলিউশন দিয়ে ঘুড়ির কাগজ লাগানো হতো। সেই ঘুড়ি ওড়ানো নিয়েও কত গন্ডগোল হতো এবং শেষে অভিভাবকদের কাছে নালিশ চলে যেত এবং অপরের দোষ খুঁজে বের করা হতো। খাটের নিচে লুকিয়ে পলান টুকটুক খেলা হতো। কুক দাও বলা হতো।
প্রথম কাউকে দেখলে এক টিলো এবং এরপর কাউকে দেখলে দুই টিলো বলা হতো। অনেক সময় না দেখেও দেখেছি বলা হতো। পানিতে ডুব দিয়ে পলান টুকটুক খেলা হতো। ডুব দিয়ে ধরে ছুঁয়ে দেওয়া হতো। ঝাপুড়ি খেলা হতো। একটা পাটখড়ি ভেঙে ঝাপুড়ি বানানো হতো। না ধরেও কখনো ডুব দেওয়া হতো। একে অপরের দোষ দিলেও কেউ আর নিজের দোষ স্বীকার করত না। পাখির বাচ্চা ধরে একটা খুঁটির মধ্যে বেঁধে রাখা হতো এবং সেই বাচ্চা আবার কেউ লুকিয়ে নিয়ে যেত। পাখির বাচ্চা খুঁজে না পেলে একে অপরকে সন্দেহ করত। এটা নিয়ে তর্ক লেগে যেত। কখনো ঝগড়া লেগে মারামারি পর্যন্ত হয়ে অভিভাবকদের কাছে নালিশ চলে যেত এবং একে অপরের দোষ দেওয়া হতো। গুটির সুতা খেজুরগাছের লালের সঙ্গে বেঁধে চুরি করে রস খাওয়া হতো। কখনো গাছি রসের ভাঁড় গাছ থেকে পেড়ে নিলে একটা মাটির খুঁটি গাছে লাগানো নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেলে বড়রা এসে মীমাংসা করে দিত। অপরের খেত থেকে ছোলা বা মটর কলই পুড়িয়ে খাওয়া নিয়ে কত সময় ঝগড়া লেগে একে অপরকে দোষারোপ করা হতো।
আগে গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে ধুরা জাল পেতে মোরগ ধরা হতো। বাচ্চারা একত্র হয়ে মোরগের পেছনে দৌড়াত। মোরগ জালে ধরা পড়লে সবাই কী যে মজা পেত! কিন্তু ধরতে গিয়ে মোরগ ছুটে গেলে একে অপরের দোষ খুঁজে বের করত।
ছোটবেলায় মজা করে মার্বেল খেলা হতো। মার্বেল খেলায় অনেক সময় কাই করা হতো। হেরে গেলে আবার মার্বেল কিনে খেলা হতো। এই মার্বেল খেলা নিয়েও ঝগড়া হলে অপরে কাই করে জিতে গেছেÑএ কথা বলা হতো। আগে বলপেন পাওয়া যেত। বলপেনের কালি শেষ হয়ে গেলে বলপেন আগুনে পুড়িয়ে বাবল বের করা হতো। বাবল বের করা নিয়ে কত ঝগড়া হতো। কেউ আর নিজের দোষ স্বীকার করত না। ছোটকালে খেলোয়াড় ভাগ করা হতো দুজন করে। দুজন একসঙ্গে কাঁধ ধরে একটু দূরে সরে যেত। তারা কেউ হতো বালতিভরা সোনা আর কেউ হতো আকাশের কোনা। দুজন দলপতি থাকত। দলপতি আবার তার পছন্দের খেলোয়াড়কে বলে দিত, তুই আকাশের কোনা হবি আর যখন আমি বলব আকাশের কোনা, তখন তুই আমার পক্ষ হয়ে যাবি। খেলোয়াড়েরা কেউ হতো বাঘ, কেউ হতো বরি, কেউ হতো মাটি, কেউ হতো দুর্বলা, কেউ হতো সোনার বালি, কেউ হতো ময়না পক্ষী। কী আনন্দময় দিন ছিল। গাছে উঠে ডগা ডগা খেলা, কানে মাটি কানে কুরুত বলা। বল দিয়ে অন্যের গায়ে থ্রো করে তাকে আউট করে দেওয়া, চোখ বেঁধে কপালে টিপ দেওয়া। দলপতি দুই হাত দিয়ে অন্য পক্ষের খেলোয়াড়ের চোখ ধরে তার পক্ষের খেলোয়াড়ের কত নামে ডাকতÑআয়রে আমার দুলদুলি ঘোড়া, আয়রে আমার ময়নার ছাও, আয়রে আমার ডেপির মা। অপরপক্ষের খেলোয়াড় সঠিক টিপ দেওয়া খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারলে তার দলের দলপতি আবার অন্যপক্ষের খেলোয়াড়দের চোখ দুই হাত দিয়ে ধরে তার পক্ষের খেলোয়াড়দের কত নামে ডাকত-আয়রে আমার হায়মনার বাপ, আয়রে আমার টিয়া, আয়রে আমার রাজলক্ষ্মী। যদি সঠিক টিপ দেওয়া খেলোয়াড়ের নাম বলতে না পারত, তাহলে অন্যপক্ষ লাফ মেরে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে উইন করত।
গোল্লাছুট খেলায় গোল্লা কখন ছোটে খেয়াল রাখা হতো। যদি গোল্লা ছুটে পেকে যেত, তাহলে এক খেলোয়াড় আরেক খেলোয়াড়কে দোষ দিত, সে আবার দোষ চাপাত তার ওপর।
জীবনের সেই সোনালি দিনগুলোর কথা কত মনে পড়ে। সকাল, বিকাল ও সাঁঝে কত আড্ডা হতো সহপাঠীদের সঙ্গে। হইহল্লা আর চেঁচামেচি, রাগ-অভিমান, ঝগড়া-বিপদ, মারামারি আর মিল-মহব্বত হতেও দেরি হতো না। বন্ধুরা আজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কতখানে। তারা সবাই ব্যস্ত নিজেদের সংসার ও কর্ম নিয়ে। ছোটবেলার সেই ঝগড়ার কথা ‘আমার নয়, ওর দোষ’ এখনো কত মনে পড়ে।