Thikana News
২৫ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

বাঙালির ঐতিহ্য শাড়িতে

বাঙালির ঐতিহ্য শাড়িতে
কামরুন আক্তার

ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যাবে নিজ দেশে, জানতে চেয়েছিল আমি কী ধরনের শাড়ি লাইক করি? উত্তরে জানিয়েছিলাম, আমি তো শাড়ি পরি না। আর কখন কবে পরেছিলাম, তাও মনে পড়ে না। তবে যা মনে আছে, তখন আমি সুইট সিক্সটিন। জীবনের প্রথম হালকা রঙের শাড়ি পরা। অনেকে বলেছে, আমাকে তখন নাকি নীল পরির মতো লেগেছিল। তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করার বয়স হয়নি, তবে ভালো লাগার বয়স হয়েছিল। সেদিন বুঝিনি কতখানি নিজেকে সুন্দর দেখাচ্ছিল, হয়তো তেমন সুন্দরী ছিলাম না কিন্তু ছিল সুন্দর একটা মন, দুটো চোখ, বোঝার মতো অনুভূতি। তাই সেদিনের ওই শাড়িতে নিজেকে সুন্দর বলার সেই স্মৃতিটুকু আজও ভুলিনি।

বান্ধবীর প্রশ্ন ছিল, ‘তাহলে বিবাহিত জীবনের এতটা বছর, এতটা ঈদ, কত অনুষ্ঠানÑসব কি ছিল শাড়িবিহীন, এটা কীভাবে সম্ভব?’ সত্যি যদি আমি বাঙালির বাংলা বউ বা কন্যা হয়ে থাকি, তাহলে কোনোভাবেই আমি শাড়িকে নিজ হতে দূরে ঠেলে দিতে পারি না বা বলতে পারি না শাড়ি আমার অপছন্দ। কেন বা কী কারণে শাড়ি হতে দূরে বহুদূরে সরে ছিলাম, আজ এত বছর পর প্রবাসে এসে মনে করতে লাগলাম। কিছুই মনে করতে পারছি না, তবে এতটুকু মনে আছে, বছরের দুই ঈদে শুধু একটি করে শাড়ি নেওয়া হতো, তাও আবার সে শাড়িতে ছিল না কোনো প্রাচুর্য, দামের আধিক্য। পছন্দ যেন এমন ভাব, ঈদ বলে কথা, একটি নিলেই হয়। তাই সবার চেয়ে আমার ঈদের শাড়িটির রং ও দাম ছিল অত্যন্ত সাদাসিধা, যা দেখতেই বোঝা যেত, সেখানে সরলতার ছাপ ছিল।

যাক প্রসঙ্গ ছিল শাড়ি। যখন বান্ধবীকে বললাম, আমি শাড়ি পরি না, সে যেন তার ভাবনা হতে ধপ করে নিচে পড়ে গেল। সে কেবলই বলে গেল, ‘এটা তোর ন্যাকামি, না হয় তোর অহংবোধ।’ অথচ এর কোনোটাই আমার নয়, এটা আমার স্বভাবজাত অভ্যাস। তার ফোনটা রেখেই লিখতে বসলাম ‘শাড়ি’ নিয়ে। সত্যি যে শাড়ি আমার হারানো মায়ের স্মৃতি, যে শাড়ি ছোটকালের চাচিদের স্নেহ ও ভালোবাসা-মাখানো আর যে শাড়িতে আমার অতীত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তাকে কি ভোলা যায়? কীভাবে ভুলি? কত না-বলা স্মৃতি, কত ঘটে যাওয়া ঘটনা আজ লিখতে গিয়ে চোখের জলে বারবার লেপ্টে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই শাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে না, হারিয়ে যাচ্ছে মায়ের মমতা, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মায়ের শাসন। কোথায় আমার সে মা? কোথায় আমার শাশুড়ি? যারা কিনা শত ব্যস্ততার মাঝেও শাড়ি ছাড়েননি। শত কষ্ট করেও ওই শাড়ি পেঁচিয়ে আগলে রেখেছিলেন নিজেদের, সেই শাড়িতেই পালন করেছিলেন যৌথ পরিবারের সব দায়দায়িত্ব। যাকে ঝামেলা বলে গা হতে কখনো দূরে সরিয়ে রাখেননি। মনে পড়ে গেল যেদিন মাকে ছোট একটি অনুরোধ করে বলেছিলাম, ‘মা, তুমি আর শাড়ি পরবে না, এতে অনেক ঝামেলা, শুধু শুধু কেন এই ঝামেলাকে জড়িয়ে রাখবে।’ সেদিন দেখেছি মায়ের নীরব কান্না, সেদিন হয়তো গভীরভাবে ভাবিনি কিসের বেদনায় আমার মা কেঁদেছিলেন। শুধু উত্তরে হ্যাঁ বলেছিলেন। সেই শাড়িগুলো আজও বাক্সবন্দী হয়ে কাঁদে, অতীত মনে করিয়ে দেয়, কত বেদনার স্মৃতি। যেদিন শাশুড়ি মাকেও বলেছিলাম, ‘মা, তোমাকেও এই শাড়ি ছাড়তে হবে।’ তিনি নীরব কান্না করেননি, তবে প্রতিবাদ করেছিলেন জোরালো কণ্ঠে। অনেকেই তার এই প্রতিবাদের উত্তর দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু কাউকে তা করতে বারণ করেছি আমি, বরং আমি স্বেচ্ছায় রাজি হলাম, তিনি যা ভালো মনে করবেন, তা-ই যেন হয়। সময় ও কঠিন বাস্তবতায় নিজেই তাকে ছেড়ে বেছে নিয়েছে অন্য পোশাককে। কত বেদনাদায়ক! যে শাড়ি বাঙালির অহংকার, যে শাড়ি বাঙালির ঐতিহ্য, সে শাড়ি আজ বাক্সবন্দী বা আলমারিতে অথবা কারও অধীনে। সত্যি শাড়ি তুমি থাকতে কোথায়, তুমি এখন কারও শৌখিনের, কারও উপহারের, কারও অতীতের স্মৃতিতে। খুঁজলে পাওয়া যাবে দোকানে, শো-পিসে, গভীর সিন্দুকে, আলমারির তাকে। দেখা যায় না আর মা-খালাদের গায়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের শরীরে, কলেজপডুয়া মেয়েদের হাসিমাখা গায়ে। এমনকি নববধূরাও তাকে আর আগের মতো জড়িয়ে নেয় না, বরং তারা বেছে নিয়েছে লেহেঙ্গার মতো পোশাক।

কিন্তু আজ বিদেশের মাটিতে পা রেখে শাড়ির প্রাধান্য দেখে আমি স্তব্ধ। যেখানেই যাই, দেখি শাড়ি সমম্মানে নিজেকে মানিয়েছে। একবার ‘তিন বাংলার মেলা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। অবাক হলাম, আমি ছাড়া সব মহিলার পরিধানে ছিল রং-বেরঙের শাড়ি। কী চমৎকার ও পরিপাটিভাবে যে তারা শাড়ি পরেছিলেন, তা দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন নিজ মনে নিজেকে ধিক্কার দিলাম, কেন আমি শাড়ি পরা শিখলাম না, কেন শাড়িকে নিজের জীবন হতে এত দূরে সরিয়ে রাখলাম। আজ মনে হলো, আমি আবার নতুন করে তাকে আরও কাছে পাওয়ার আশায় যা করণীয় সব করে যাব। অবসর সময়ে খুঁজে খুঁজে বের করতে শুরু করলাম আমারই হারানো অতীত, আমারই বাংলার সংস্কৃতি, গ্রাম্য নারীর সৌন্দর্যের পেছনে যে সত্য লুকিয়ে আছে তাকে, নববধূর বড় ঘোমটাতে যে শাড়ি তাকে। আজ মনে হতে লাগল, ঐতিহ্য কখনো হারায় না বরং ফ্যাশনের জোরে কেবলই তা আড়াল হয়ে যায় সাময়িকভাবে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে সবার সামনে আরও উজ্জ্বল করার জন্য বা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যেকোনো অজুহাতে বা যেকোনো উপহারে তাকে জড়িয়ে রাখার প্রাণবন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব। এটাই প্রমাণ করার প্রয়াস চালাব, যেন আমাদের স্লোগানের মূল সুর হয় ‘আমি (শাড়ি) আছি, আমি ছিলাম, আর আমরা থাকব যুগে যুগে বাংলা নারীর অন্তরে, শৌখিনতায়, স্বপ্নে, কল্পনায় আর যেকোনো বাসনায় ও কামনায়। নারীর শরীর শাড়িতে এমনভাবে জড়িয়ে থাকুক, যেন তা হবে একে অন্যের পরিপূরক।
 

কমেন্ট বক্স