Thikana News
২৪ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বৃদ্ধাশ্রম

বৃদ্ধাশ্রম
তাপস কুমার বর

ভাঙা চেয়ারটা দরজার এক কোণে উলঙ্গ খামখেয়ালির মতো নীরব হয়ে গেছে। যে চেয়ারটায় একসময় বিমল বাবু কত গল্প, কবিতা ও উপন‍্যাস লিখত বসে। আজ সেই মানুষটা বয়সের ভিড়ে নিজের আত্মীয়দের কাছে ‘একটা অবাঞ্ছিত জড় বস্তু’! আজ কোথায় বিমল বাবু? কেউ খোঁজ করে না। একদিন যে মানুষটা নিজের সর্বস্ব দিয়ে নিজের পরিবারকে রক্ষা করে গেছে, আজ সেই মানুষটার ঠাঁই হয়নি তার নিজের পরিবারে!

অমল : কে বলছেন?
স্কুলশিক্ষক : আমি প্রিয়তোষ। আপনার বাবা যে স্কুলে চাকরি করতেন, সেই স্কুল থেকে বলছি। আগামীকাল স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান, তাই বিমল বাবুর সঙ্গে কথা বলে ওনাকে আমাদের স্কুলে আমন্ত্রণ করতে চাই।
অমল বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল।
আজকের সেই বিমল বাবু কোথায়? পঁয়ত্রিশটা বছর প্রাথমিক শিক্ষকতার কাজে যুক্ত ছিলেন। তিন বছর আগে বিমল বাবুর স্ত্রী মোহিনী দেবী মারা গেছেন। বিমল বাবু স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। আজ সেই মানুষটা নেই। এখন তার ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধ বাবাকে ‘বোঝা ভাবে’, ...
‘জীবনের দৌড়ে লাগাম লেগে গেছে,
পেনশনের টাকাতে কোনো রকম দিন চলে।’
বিমল বাবুর একমাত্র ছেলে অমল বেকার একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। সারা দিন নেশা ভাঙে ডুবে থাকে। বউমাটাও বিমল বাবুকে সহ‍্য করতে পারে না। আজ এই সমাজের বুকে মাঝে মাঝে পেছনে শুনতে হয়...
‘বাবা শিক্ষক, ছেলে নেশা ভাঙ করে!’
এই যন্ত্রণা অনেক কষ্টের, অনেকবার বিমল বাবু অমলকে বোঝাতে চেয়েছে...
বিমল বাবু : বউমা, অমল কোথায়?
বউমা : কী জানি বাবা, আপনি গিয়ে খোঁজ করে নিন না!
বিমল বাবু : বউমা, তুমি অমলকে একটু বুঝিয়ে বলবে। এভাবে নেশা ভাঙ করলে একদিন ওকে চরম বিপদে পড়তে হবে। এদিকে নানা কুকথা, গালমন্দ শুনতে হয় সমাজের লোকেদের থেকে।
বউমা : বাবা, আপনার যদি ভালো না লাগে, তাহলে এখান থেকে চলে যান না। নিজের খাবার জোগাড়ের মুরোদ নেই, আবার সম্মান নিয়ে চলেন!
বিমল বাবু সেদিন মনে মনে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। সেই দুঃখ কাউকে বলা যায় না!
সেদিন রাতে বিমল বাবুর সঙ্গে অমলের অনেক ঝামেলা হলো...
অমল : বাবা, তুমি তোমার বউমাকে কী বলেছ?
বিমল বাবু : বাবা, নেশা ভাঙ করা ছেড়ে দে। ব‍্যবসা কর, তোদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে, খোকা।
অমল : নিজের খাবার জোগাড়ের মুরোদ নেই, বড় কথা বলছেন। এখানে থাকতে গেলে আমাদের কথা মেনে চলতে হবে।
বিমল বাবু : খোকা, তোদের জন‍্য এত কিছু করলাম, তাও তোরা আমাকে এভাবে অপমান করছিস!
অমল : বেশ করেছি। তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও!
সেদিন বিমল বাবু চোখের অশ্রু লুকিয়ে নীরবে বোবা পাখির মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল...
‘মোহিনী দেখে যাও, তোমার ছেলেমেয়েরা আমায় কত সুখী রেখেছে। তুমি থাকলে আমি দেখাতাম এ যুগের ছেলেদের বৃদ্ধ বাবাদের প্রতি তাদের ভবিষ্যৎ নাকি বোঝা হয়ে যায়?’
বিমল বাবু কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে ললিতাদের বাড়িতে ওঠে। সেখানে বিমল বাবু সব কথা বলে...
বিমল বাবু : মা, কেমন আছিস?
ললিতা : কোনো রকমে চলে যাচ্ছে, বাবা।
বিমল বাবু : কেন রে, মা? জামাই কোম্পানির ম্যানেজার। এবার তো প্রমোশন হলো। কোম্পানি থেকে একটা কারও গিফট করেছে শুনলাম।
ললিতা চুপ!

বিমল বাবু একদিন মেয়ের বাড়িতে থেকে মনে মনে অনুভব করল, বৃদ্ধ বাবার জন‍্য তাদের মধ্যে একটু ঝামেলা শুরু হয়েছে। পরদিন সকালে বিমল বাবু তল্পিতল্পা গুছিয়ে মেয়ে ও জামাইকে ডেকে বলল, ‘এবার আসি মা। তোরা ভালো থাকিস!’
আজ সেই বিমল বাবুর একটা অনাথ আশ্রমে ঠাঁই জুটেছে। অনেক অনাথ শিশু। সকলকে নিয়ে বিমল বাবুর জীবনটা এখন খুব আনন্দে কাটে!

জীবনের দৌড়ে হেরে গেছে। কত অনাথ শিশু, তাদের শিক্ষা দেয় বিমল বাবু। রাতের আড্ডায় সকলকে শোনায় ‘মা ও বাবাকে কী করে শ্রদ্ধা করতে হয়’। বতর্মান সমাজব‍্যবস্থা যেদিকে গড়াচ্ছে, একদিন এই পৃথিবীর বুক থেকে ‘মায়া-মমতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সেদিন থাকবে শুধু হিংসা’!

এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল বিমল বাবু। একবারও ছেলেমেয়েরা খবর নেয়নি। বাবা বেঁচে আছে, না মরে গেছে। একদিন বাজার থেকে বিমল বাবু ফিরছিল। কিছুটা দূরে একটা ছোট্ট ফুটফুটে শিশু ‘দাদু দাদু’ বলে চিৎকার করে ছুটে আসছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল ছেলে অমল ও বউমাকে। আজ সেই ছোট্ট নাতিটাই বারবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘বাবা, দাদু আমাদের সঙ্গে থাকে না কেন?’

সেদিন ছেলে অমল ও বউমা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বিমল বাবুর কাছে ক্ষমা চায়, ‘ক্ষমা করে দিয়ো বাবা, তোমার প্রতি যে অন‍্যায় করেছি, আজ নিজেকে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগছে!’
বিমল বাবুর দুই চোখে অশ্রু বয়ে এল। বিমল বাবুকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইল তার ছেলে ও বউমা কিন্তু বিমল বাবু বলল, ‘তোরা ভুল বুঝতে পেরেছিস, এটাই অনেক রে খোকা। আমি তোদের সঙ্গে যেতে পারব না। এই অনাথ আশ্রমে অনেক ছোট্ট ছোট্ট শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে, খোকা। না হলে ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকূপের মতো হয়ে যাবে!’
ছোট্ট নাতিটা দাদুকে বলল, ‘দাদু, তুমি কাঁদছ!’ হাত দিয়ে চোখের অশ্রুটা মুছে দিল সে।
বিমল বাবু হেসে উঠল, ‘আমার ছোট্ট নাতিটা, আমাদের সেই ছোট্ট অমল, দেখে যাও মোহিনী!’

কমেন্ট বক্স