Thikana News
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছোটগল্প

খণ্ড মেঘের বিলাপ

খণ্ড মেঘের বিলাপ
আশরাফ উদ্‌দীন আহ্‌মদ

বিকেলের নরম আলো একটু একটু মুছে যায়, রাতের জোনাকিরা বিন্দু বিন্দু আলো ছড়িয়ে যায় চারদিকে। জমাট কালো অন্ধকার আস্তে আস্তে তাবৎ পৃথিবীকে গ্রাস করেছে, মৃদু বাতাস এলোমেলো খেলে যায়, উঠোনের নতুন টিউবওয়েলের পাশে একটা জবা ফুলের গাছ। বেশ ঝাঁপালো ওর শ্যামলতা, বাড়িটার চারপাশে সবুজ বৃক্ষের সমারোহ। দক্ষিণ দিকের প্রাচীর ঘেঁষে গন্ধরাজ ফুলের গাছটা নীরব পায়ে অক্লান্ত পথিকের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো-বা স্থির দৃষ্টিতে অবলোকন করছে রাতের সৌন্দর্য।

উঠোন থেকে দাওয়ার ওপর উঠে ডেকে তোলে রেবেকাকে, দরজা খুলে বের হয় এলোমেলো কাপড়ে এলোকেশী রেবেকা। আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে প্রত্যক্ষ করে গোলাপ মিয়ার পেছনে আরেকজন সুদর্শন স্মার্ট যুবক, রেবেকা অচেনা যুবার দিকে একঝলক আড় চোখে তাকিয়ে বুকের ওপর কাপড়টা বেশ টেনেটুনে নেয়, গোলাপ মিয়া একসময় রেবেকার ঘরের ভেতরে লাগোয়া তক্তায় বসে পড়ে, যুবকটিও বিনয়ের ভঙ্গিতে ধীরে-সুস্থে বসে। হয়তো গোলাপ মিয়ার হাতের ইশারায় ওই যুবক বসল, রেবেকা দুজনের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে, দুজনের মুখের আদলে কেমন একটা মিল বেশ স্পষ্ট ফুটে ওঠে, গোলাপ মিয়ার চোখজোড়ার সঙ্গে যুবকটির চোখজোড়ার এমন মিল প্রত্যক্ষ করে রেবেকা একটু কেমন বিমোহিত হয়। বুকের ভেতর অন্য রকম এক শিহরণ দোলা দেয়, সে ভাষা হয়তো কাউকে বোঝানো যাবে না। সে ভাষা একেবারে নিজস্ব, তবু সে ভাষায় কিছু কথা কিছু গল্প বলতে বড় অভিপ্রায় জাগে, রাতের সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে ডুবে রেবেকা সে ভাষা ভুলে গেলেও স্বপ্ন তো মরে না, স্বপ্ন স্বপ্নীল। গোলাপ মিয়ার সাড়া পেয়ে রেবেকার পাশের ঘর থেকে রোজিনা-মৌটুসী-টুলটুল চোখ রগড়ে কাপড় গোছাতে গোছাতে আসে রেবেকার ঘরে, পেছন পেছন কালু। কালুকে দেখে গোলাপ কেমন ম্লান হয়ে যায়, মুখ শুকিয়ে আসে। আসলে এই লোককে গোলাপ কখনো সহ্য করতে পারে না। কেমন মিনমিনে স্বভাবের, হাসলে আরও বিশ্রী দেখায়। হারামজাদাকে দেখলে মেজাজ ঠিক থাকে না। দু’পাতা বিদ্যার মহড়া দেখায়, শালগাছের ছালের মতো তো ভারী ওর গায়ের রং, বেঁটে-খাটো একজন চামচিকে মানুষ, রোয়াবেই বাদ্যি বাজায় আর কি! কিন্তু এসবই মনের ব্যাপার, মুখে অবশ্যই বেশ চিড়ে ভিজিয়ে ফেলে গোলাপ মিয়া ওর সঙ্গে কথা বলার সময়। কারণ কালু মদনা যে আবার মৌটুসীর সিঁদুর-শাঁখার স্বামী। হাজার হোক সাত পাকে বিয়ে করেছে ছ্যাঁদনা তলায়, আর সে জন্যই গোলাপ মিয়া পারে না কালুকে ছুড়ে ফেলে দিতে এক হাতে তুলে।

নবাগত যুবকের দিকে তাকিয়ে সর্বপ্রথম টুলটুলই বলে ওঠে, দুলাভাই, ওই সঙ্গীটি কে গো!
রেবেকা এতক্ষণে লক্ষ করে, যুবকটিকে যতটুকু মডার্ন বা স্মার্ট মনে করেছিল, আসলে তার চেয়ে ঢের বেশি স্মার্টনেস বলতেই হয়। মনে হয় বেহেশত থেকে হুরপরিরা শুভ্র-সাদা পাখায় এনে ফেলে দিয়েছে। ওমন একটা যুবক যেকোনো নারীর জীবনকে কানায় কানায় ভরিয়ে দিতে পারে। দুধের সরের মতো ননীযুক্ত চিবুক, সমস্ত শরীর বেয়ে উছলে পড়ছে যৌবন। রেবেকার চোখ স্থির হয়ে যায়।
গোলাপ মিয়া এতক্ষণে কথা বলে ওঠে, ও আচ্ছা, ও আমার ছোট বোনের ছেলে, ভাগনে...
রোজিনা আচমকা মুখ ফসকে বলে ফেলে, ভা-গ-নে...
কপালে ভাঁজ ফেলে মৌটুসী জানায়, তা ভাগনেকে নিয়ে এই মাঝরাতে আমাদের ডেরায় হানা যে, কী মতলব বলো তো বাপু!

গোলাপ মিয়া চুপিসারে এক চোখ মেরে উত্তর দিল, কেন গো, ভাগনেকে নিয়ে তোমাদের কাছে আসতে নেই বুঝি। কৌতুক মেশানো গোলাপ মিয়ার মিষ্টি কথায় সবার মন তৎক্ষণাৎ সিক্ত হলেও রেবেকার মন শুধু যুবকটির দিকেই, ওর চোখের নীড়ে যুবকের ছায়ামূর্তি। বুকের ভেতরে অনেক কথা আঁকুপাঁকু করে মরে, কীভাবে বোঝাবে, তাও বুঝে পায় না।
গোলাপ মিয়া এই মাঝরাতে কেন এল, তা সে জানতে চায় না, কিন্তু এই যুবকের চোখে এত গাঢ় আর মায়াবী পেলবতা কেন, জানতে বড় সাধ জাগে। রোজিনা-মৌটুসী-টুলটুল বেশ আনন্দে আত্মহারা, মেলা দিন পরে গোলাপ মিয়ার আগমনে। কালু ছোঁড়া সবার কথা গিলছে, গোলাপের কাছে একটু কেমন কেমন লাগলেও মানিয়ে নিতে হয়। পোদে কষে একটা লাত্থি মেরে তো আর ঘর থেকে ধাক্কা দিতে পারে না। ইয়ার্কির ছলে একটু-আধটু কথা বললেও একটা বাধা সরাতে পারে না, ভাগনে বলে কথা, অর্থাৎ সংযত কথাই শ্রেয়। যদিও পেটের মধ্যে অন্য রকম ক্ষুধা জানান দিচ্ছে, তাও তাকে বেড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে।

মৌটুসী বলে, অনেক দিন পর আসলেন, বলুন তো ভুলেটুলে ছিলেন কীভাবে?
গায়ের সঙ্গে গা ঠেলে রোজিনা হাসতে থাকে, নতুন বৃক্ষে বাসা বেঁধেছে গো বৃন্দাবনের বালক রাখাল।
অকস্মাৎ কপট রাগে ধমক দেয় গোলাপ। নিজেকে আরেকটু সংবরণ করে জানায়, যাচ্ছিলাম বাড়ি, জিরাটে এসে ট্রেন বিগড়ে মরল শালা, শুনলাম কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী নাকি এই লাইন ধরে মালদার দিকে যাবে, আর তাই অপেক্ষা...
ফস করে টুলটুল কথা কেড়ে নিয়ে বলল, যাক বাবা রেলমন্ত্রীকে নমস্কার, এ জন্যই সোনামুখটির দেখা পাওয়া আর কি?
গোলাপ মিয়া একটু হেঁকে জানাল, তোমরা বড় আদ্দেকলে, আমাকে দেখার এত কী দরকার বলো তো!
টুলটুল আবার কথা বলল, দুলাভাই, কী যে বলেন, দেখার দরকার আছে গো, কোনো কোনো মানুষকে মাঝে মাঝে দেখার জন্য মন ছটফটিয়ে মরে গো!
চোখ কপালে তুলে গোলাপ মিয়া বলে, বাব্বাহ কত কথা শিখেছে আমার শালি, বাংলা সিনেমা কি খুব দেখা হচ্ছে আজকাল।
তারপর আরও কিছুক্ষণ হালকা ইয়ার্কি-ঠাট্টা চলে, একসময় গোলাপ চিমটি কাটে টুলটুলের হাতে, রেবেকা আজ যে একেবারে চুপচাপ, নাকি পছন্দ হচ্ছে না...
মৌটুসী-রোজিনা-টুলটুল কানে কানে কী সব বলাবলি করে। গোলাপ মিয়া আন্দাজেই বোঝে, তাদের এই কানে কানে কথা ভাগনে আসিফকে ঘিরে। ওমনই হয়, সুন্দর ছেলে দেখলে এরা কাঁচা আস্ত গিলে খেতে চায়। এদের কাণ্ডকীর্তি দেখে একসময় গোলাপ নিজেই সংকুচিত হয়ে যায়। এতক্ষণে বোধ ফিরে আসে তার, আসলে আসিফকে আচমকা এখানে আনা উচিত হয়নি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে।
একসময় মৌটুসী ইশারা করে গোলাপ মিয়াকে পাশের ঘরে ডেকে কী যেনবা ফিসফিসিয়ে বলে, কালু থিতু চোখে নির্বাক এক ছবি যেন, ও-ঘরের কথা এ-ঘরে স্পষ্ট শোনা যায়, মৌটুসী-রোজিনা-টুলটুল কত কী যে বলে পাশের ঘরে গোলাপ মিয়ার কানে কানে, কালুর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, এ জন্যই গোলাপ ওকে সহ্য করতে পারে না। ব্যক্তিত্বহীন একজন খোজা পুরুষ, অথচ ওরই বউ মৌটুসীর নাকে চোখে কথা, ওমনভাবে চড়বড়িয়ে কথা বলতে ক’জনই-বা পারে।
এই ঘরে গোলাপকে ঘিরে বসে আছে ওরা তিনজন, টুলটুল হালকা হেসে জানায়, দুলাভাই, যা একখান মাল এনেছেন বোনের ব্যাটাকে, রেবেকার তো সাত দিনের ঘুম হারাম...
মৌটুসী আরেকটু ফাজলামি চড়িয়ে জানাল, যেমন মামা তো তেমনি ভাগনের চেহারা, বলিহারি বাবা, ফটো তুলে বাঁধিয়ে রাখব গো! তা ভাগনেকে এ লাইনে...
গোলাপ মিয়া মুহূর্তে একটু গম্ভীর হয়ে যায়, কোনো কথা যেন মুখে সরে না তার। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণই-বা ওদের ফাজলামি অর্থাৎ ছিনালি কথাবার্তা হজম করতে হবে, কে জানে? গোলাপ মিয়া থিকথিকে এই জমাট অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারে না। ফতুয়ার পকেট থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে ছুড়ে দেয় ওদের দিকে, তারপর মুখে একচিলতে হাসি এনে ছড়িয়ে দেয়। টুলটুল হালকা হেসে এক চোখ মেরে বলে ওঠে, ভাগনেকে আজ রেখে যাবে নাকি গো নদের চাঁদ?
কঠিন একটা খিস্তি মুখ দিয়ে বের হয়ে আসতে গিয়েও আটকে যায় গলার ভেতর, নিজের ভেতরে নিজেকে শক্তভাবে বাঁধতে থাকে, টুলটুলের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না গোলাপ মিয়া।
রোজিনা চোখে এক মায়াবী মাদকতা ছড়িয়ে বিনম্র স্বরে বলে, কী আসে খণ্ড মেঘের বিলাপ 
(১১-এর পাতার পর)
যায়, আজ রাতটা থেকে যাও না বাপু।
গোলাপ মিয়া বেপরোয়াভাবে বলল, অত কচকচানি কেন, নাগর পাওনি কত দিন, একেবারে গিলে খাবে দেখছি...
মৌটুসী ফণায়িত জিহ্বা বের করে জানাল, নাগরের আবার অভাব গো, তবে রসের নাগর পাওয়াটা একটু বিড়ম্বনা, ওই পাষণ্ডদের ওপর বীতশ্রদ্ধা এসে গেছে গোসাই...
কথার মোড় পাল্টে দেয় অকস্মাৎ গোলাপ, চাপা স্বরে বিড়বিড় করে, বড় আদ্দেকলে আর ঢলঢলে মাগিগুলো। তারপর হেঁকে বলল, রকিব খন্দকারের সুমুন্ধি ওই নচ্ছার জাসুমুদ্দি এদিকে আজকাল আসে-টাসে?
কালু ছোঁড়া ফস করে উত্তর দেয়, তা আর বলতে, ওই চান্দুফাটা আসবে নাÑ
গোলাপ মিয়া তৎক্ষণাৎ কালুর উপস্থিতি আর কথা শুনে একটু আশ্বস্ত হয়, কালু আবার জানায়, জাসুমুদ্দি আবার আমাদের টুলটুলের ইয়ে না...
টুলটুল অগ্নিবর্শা হয়ে কালু ছোঁড়ার দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে মোক্ষম একটা খিস্তি ছুড়ে দেয়। গোলাপ মিয়া ওর চোখের ভাষা বোঝে, কিন্তু তেমন একটা গ্রাহ্য করে না। হয়তো সে না থাকলে ওর দফারফা করে ছাড়ত। কালু অসমাপ্ত কথা আবার বলে, এই তো গত পরশু না তড়শু দিন দিন এসে এক্কেবারে মাঝরাত অবধি সময় কাটিয়ে রংফঙ করে, তবেই না রাস্তা মাপল।
টুলটুল সংকুচিত হয়ে বসে থাকে, আড়ষ্টতা ওকে এমনভাবে ছেয়ে ফেলে গোলাপ বুঝে পায় না। বরং টুলটুলের মুখ বড় গম্ভীর, দলছুট গরুর মতো এমন সঙিন অবস্থা অবলোকন করে হতবাক। গোলাপ সোজাসাপটা জানায়, আমার হয়েছে আরেক জ্বালা, এ জন্যই মানুষ বলে, দাগাবাজ মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই। কালু আচমকা কথা কেড়ে নিয়ে জানায়, যথার্থ কথা একখান বলেছেন ভায়া!
মৌটুসী বলে ওঠে, তা ঘটনা কী বলে ফেলো না, পথ বাতলে দিতেও তো পারি।
গোলাপ হালকা উত্তেজিত হয়ে বলল, জোচ্চোর, ওমন করে সটকে পড়ে কেউ, কী যে করি মাথামুণ্ডু, কিছুই বুঝতে পারছি না।
লোকটা তো পাঁড় মাতাল, ওকে মহৎ ব্যক্তি ভাবলেই-বা কোন আক্কেলে বলো তো! মতলবি লোক তুমি বাপু আর তুমিই কি না মানুষ চিনতে মোক্ষম ভুল করলে...রোজিনার কথা শুনে হুঁশ ফিরে পেল গোলাপ। না মানে, আমাকে একদিন বলল, দাদন ব্যবসা করলে বেশ ফুলে-ফেঁপে রাতারাতি বড়লোক হওয়া কোনো ব্যাপারই না, শুধু কাঁচা আগাম টাকার অভাব, আমিই-বা কী পাঁঠা বলো দিকি, ওর কথা শুনে গদগদ হয়ে তিলকদণ্ড অপেক্ষা না করে এক কাঁড়ি টাকা তুলে দিলাম, ধার-কর্জের টাকা আমার, এখন মাথায় বাঁশ।
মৌটুসী হাততালি মেরে বলে ওঠে, বাহ্ বাহবাহ...
ক্ষিপ্ত হয়ে গোলাপ তেড়ে গেল, থাম তো শালি, তোর আমি ইয়ে ফাটিয়ে দেব!
মুখে কাপড় টেনে রোজিনা ফস করে বলে, আহা অত রাগো কেনো বাপু, ও তো উচিত কথাই বলেছে।
গোলাপ একটু গম্ভীর গলায় জানায়, কারও সর্বনাশ আর কারও-বা পৌষ মাস, তোমরা তো ভালোই আছ, মানুষের মাথা চিবিয়ে খাও, ফন্দিবাজিতে তোমরাও কম নাকি?
মুহূর্তে সবাই নিশ্চুপ হয়ে যায়, ঘরের মধ্যে অন্য রকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়, ফাটা বাঁশের মতো সবাই ভাবলেশহীন। আচমকা গোলাপ বলে ওঠে, হায় হায়, আমার ভাগনে যে ও-ঘরে বসে আছে, ছিঃ ছিঃ, কী ভাববে গো!
টুলটুল মুখ ফসকে বলে ফেলে, ভাগনের জন্য ভাবতে হবে না গোসাই, রেবেকা বানু তোমার মিনমিনে স্বভাবের ভাগনেকে ফুসমন্তর দিয়ে এক্কেবারে দোপেয়াজা করে গরম কড়াইয়ে ভেজে এখন চিবিয়ে খাচ্ছে গো!
গোলাপ মিয়া চাপা ধমক দিয়ে ওঠে, ফচকেমি সবার সঙ্গে করো না, আর লজ্জাশরম নেই বলে কাণ্ডজ্ঞানের মাথা খেয়ে ফেলো না, পস্তাবে শেষে তখন। কিছুক্ষণ পর আবার গোলাপ বলল, আমার টাকা হজম করতে জাসুমুদ্দি কোনো দিন পারবে না, আমি ওর মাজা ভেঙে দেব, মনে রেখো।
ঘরের মধ্যে কিছু সময় এলোমেলো পায়চারি করে হঠাৎ পাশের ঘরের দিকে হেঁটে যায়, আসিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশে দণ্ডায়মান রেবেকা। চোখ দুটো শান্ত আর বড় বিনম্র, গোলাপের উপস্থিতি ঠাওর করে নিজে থেকেই রেবেকা জানাল, বুকের ভেতরটা বড় বেশি হ্যাঁচড়প্যাঁচর করছিল কদিন ধরে, তা ওই লোকমান ফকিরের টিকিটির দেখাও পাই না আজকাল।
আপাদমস্তক তাকিয়ে গোলাপ সঠিক সংবাদ দিল, বাঁশবেড়িয়ার ওদিকে ইঁদুর মারার বিষ তৈরির কারখানায় কাজ করছে শুনেছি, আমার সঙ্গেও অনেক দিন হলো দেখা-সাক্ষাৎ নেই গো!
লোকমান ফকিরের সঙ্গে কয়েক বছর আগে এই রেবেকা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কোনো এক মাঝারি গ্রাম থেকে। ভালোবাসার টানে নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা আকাশ উড়ে যেতে পারে, পাতালেও নেমে যেতে পারে, রাজা রাজ্য ফেলে প্রেমিকার বুকের ভেতরে মুখ লুকিয়ে পৃথিবীর ধনরত্ন সন্ধান করতে বেশি ভালোবাসে। সবই নাকি ইতিহাসের ব্যাপার। রেবেকা বানুর কষ্ট বোঝার সাধ্য লোকমান ফকিরের নেই, আর তাই মাসখানেক কলকাতার কোনো এক কমদামি হোটেলে থেকে তারপর ফেলে রেখে যায় এখানে। পড়ে আছে উপুড় হয়ে, মানুষ যেভাবে অন্নকষ্টে জঠরে পাথর বেঁধে পড়ে থাকে, ওমনিভাবেই রেবেকা বানু বুকের মধ্যে কঠিন দব্ধ দহন নিয়ে আছে, লোকমান ফকিরের সঙ্গে পারতপক্ষে বিয়ে হয়েছিল কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন! নচেৎ এভাবে কেউ কি কলেমা পড়া বউকে এমন পরিবেশে ফেলে রেখে থাকতে পারে। যদিও রেবেকা সম্প্রতি বলছে, লোকমান মূলত একজন ক্লীব পুরুষ। তার পরও কথা আছে, অনেক প্রশ্ন থেকে যায়, সশরীরে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে তাকে এবং লোকটা একসময় এদিকে অহরহ যাতায়াত করত একটু বেশি মাত্রায়। সলজ্জে রেবেকা বানু একসময় বলেছে, লোকমান ফকির স্বয়ং বাসুকি গো!

আজ বড় খাপছাড়া মনে হয় সবকিছু। মেয়েটা আসলে বিষাক্ত নাগিনী।
আসিফকে ওঠার নির্দেশ দিয়ে গোলাপ চোখাচোখি তাকিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে, দাওয়া থেকে নেমে উঠোনের দিকে কিছুদূর হেঁটে আসিফকে দাঁড় করিয়ে একলাফে দাওয়া পার হয়ে ঘরে আসে, রেবেকার চোখের দিকে ইঙ্গিত করে জানাল, আমার মেয়ে ঘুঙর যে ওই ভাগনে আসিফকে দখল করেছে গো...
টুলটুল তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, হ্যাঁ, তা তো হবেই গোসাই, যেমন বাপ তেমনি মেয়ে না হলে কি জমে, ভালো জিনিস চিনতে কারও সময় লাগে!
মৌটুসী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, রেবেকার আরাম হারাম হলো, ঘুমও গেল ঠাকুর।
রোজিনা লাগামহীন আরও, ঠোঁট পাতলা বলে একটা বদনাম আছে ওর, তড়িৎ বেগে ঠোঁটের আগার কথাটা জানিয়ে দেয় বিজ্ঞের মতো ভাব করে। ভালো দাওয়ায় না হলে মেয়েমানুষের অধর যে তুষ্ণাত্ব থাকে গো নন্দের নিমাই, তোমার মেয়ে একখান ঠিকঠাকমতো রসের নাগর চায় যে গো!
রোজিনার কথা শেষ হতেই সবাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, কালু ছোঁড়ার বাঁকা ঠোঁটের হাসি দেখে শরীর জ্বলেপুড়ে যায় গোলাপের, হারামজাদাকে জুতিয়ে গায়ের ছাল খুলে দিতে ইচ্ছে হয়, খাজুরে আলাপ জমাতে পারে কিন্তু কাজের সময় অষ্টনব্বা। শুধু কথার বেলায় ফটরফটর, নিজেকে কঠিনভাবে সংবরণ করে, খেঁচাখেঁচির মধ্যে না জড়িয়ে শান্তভাবে বলে, বেশি বিটলেমি ভালো নয়, আর মেনিমুখো মাগিল্যাচড়াদের আমি একদম সহ্য করতে পারিনে, বুঝলে তোমরা!
গোলাপ মিয়ার শেষ কথার প্যাঁচটা যার উদ্দেশে, সে মাটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ থাকলেও ওর বউ মৌটুসীর ধারালো জিহ্বা অকস্মাৎ আরও বেশি আলগা হয়ে খুলে যায়। কী বললে গোলাপ মিয়া, আমার স্বামী মেনিমুখো আর তুমি বীরপুরুষ! কী আছে তোমার, সবই তো শেষ করেছ মাগিদের সায়ার তলে বোতল চালিয়ে...

টুলটুল চোখ ইশারায় জানাল, আহা, কেন আবার ওকে নাড়াঘাঁটা করলে বলো তো, এখন বোঝো ঠ্যালা, ঝেড়ে কাপড় পরাবে, যাও ফুটে।
ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার সময় আবার গোলাপ বলে ওঠে, তারকাশ্বরের নিতাইকে বলো, বাংলাদেশের যে গ্রুপকে গত বছর অস্ত্র দিয়েছিল, তারা আবার অস্ত্রের বায়না... নগদানগদি কারবার। খবরটা যে পৌঁছে দেবে, সেই রোজিনা সংবাদটা শুনে খানিকক্ষণ মুষড়ে গেল, চোখ দুটো ছানাবড়া।

নিতাইয়ের কথা এতক্ষণে বলা হয়নি, মানুষটা যা-ই করুক না কেন, মনটা বড় স্বচ্ছ ছিল তার। গত মাসে গুপ্তিপাড়া স্টেশনের চাপরাশি হরেন এসে বলল, নিতাইকে জঙ্গি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক সন্দেহে পুলিশ অস্ত্রসহ হাতেনাতে ধরে। সংবাদটা শুনে আক্কেল গুম হয়ে যায়, ধাপ্পাবাজি যতই করুক, চালচলন যতই মন্দ হোক, মানুষের দুঃখ-কষ্টে ওই মানুষটা সর্বদাই পাশে এসে দাঁড়াত বন্ধুর মতো, কিন্তু মানুষের আশীর্বাদ আর ওই ওপরওয়ালার দৃষ্টি থাকলে, কে পারে তাকে আটকাতে। সপ্তাহখানেকের মাথায় নিতাই ছাড়া পেয়ে যায় কার-বা বদৌলতে। নিতাইয়ের ভাষায়, সবই ওই পাগলা ব্যাটার কারসাজি, যে পারে মারতে সেই পারে আবার বাঁচাতে...তো নিতাইয়ের মতো ওমন মানুষ আজকাল তেমন একটা পাওয়া যায় না, অকস্মাৎ বুকের বাম পাশটা কেমন চিনচিন করে ওঠে, রোজিনা বোবা চোখে তাকিয়ে থাকে। মৌটুসীর দিকে খানিক দেখে ঘর থেকে বের হয়ে বড় বড় পা ফেলে অন্ধকার পথ চিনে স্টেশনের দিকে চলে যায়।

আসিফের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ভাসতে থাকে রেবেকার চোখের সরোবরে, কোনোক্রমে ওই চোখ দুটোকে মন থেকে তাড়াতে পারে না। রাতের মিশমিশে অন্ধকারে যে জোনাকি আলো ছড়ায়, দিনের ঝলমলে আলোতে সেই জোনাকি চোখ বুজে থাকে। রোজিনা-মৌটুসী-রেবেকা-টুলটুল আর ওই কালু ছোঁড়া নির্জীব এখন। ওর সামনে ওত পেতে বসে আছে জমাট গুচ্ছ অন্ধকার। ট্রেনের হুইসেল শোনা যায় একসময়, দূরে কুকুরের চিৎকার সেই সঙ্গে, ঢাউস একটা দুঃস্বপ্ন দাঁড়িয়ে আছে তাদের মুখোমুখি, নিরাশ্বাস সময়ের গন্ডারের পিঠে বেপরোয়া এসব প্রাণী। একসময় খুব ঘন ঘন শিয়ালের ডাক শোনা যায়, রেবেকা বানুর চোখে আজ ঘুম নেই, চোখে ওর স্মৃতির ছাইরঙা টুকরো-টাকরা মেঘ, স্মৃতির জাজিমে অন্য রকম এক অপ্সরী।

-ঘোড়ামারা, রাজশাহী, বাংলাদেশ

কমেন্ট বক্স