কূটনীতির সাপ-লুডু বেশি খেলতে গিয়ে বিশ্ব কূটনীতিতে বজ্র আঁটুনিতে পড়ে গেছে ভারত। আঞ্চলিক কূটনীতির কিছু কিছু সূচকে বাংলাদেশের চেয়েও কাহিল দশা ভারতের। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তুলনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। শেখ হাসিনার চেয়েও অভ্যন্তরীণ অবস্থা বেশি নাজুক নরেন্দ্র চাপে মোদি চিন্তিত হাসিনা
মোদির। চূড়ান্ত খারাপ হতে শেখ হাসিনার সামনে বেশ কয়েকটি ‘যদি, কিন্তু, তবে’র বিষয় অবশিষ্ট রয়েছে। শেখ হাসিনার বিরোধ বিশ্বের সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে। এটি তার জন্য এক বিবেচনায় প্রেস্টিজিয়াস। আর কানাডা থেকে চীন-আফগানিস্তানসহ আশপাশের ছোটখাটো দেশগুলোর সঙ্গে ঠোকাঠুকিতে মোদির পজিশন ক্রমেই তলানির দিকে। এখন মোদি শেখ হাসিনাকে টেকাতে ভূমিকা রাখবেন, নাকি শেখ হাসিনাই মোদিকে রক্ষায় ভূমিকা রাখবেন-সেই প্রশ্ন এসে গেছে ভাইটাল কোশ্চেনের মতো। অন্যদিকে ভারতকে যা দিয়েছি, তা তাদের আজীবন মনে রাখতে হবে-শেখ হাসিনার সেই দাবির ভিত্তি এখন আরও বাস্তব। হিসাবের বাইরে কানাডার সঙ্গে চলছে ভারতের টাগ অব ওয়ার। ব্রিটেনে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীকে স্কটল্যান্ডের গুরুদ্বারে প্রবেশ করতে দেয়নি সেখানে বসবাসরত খালিস্তানের শিখরা। এর মাঝে পাশের দেশ মালদ্বীপে ভারতপন্থী মোহামেদ সলিহকে পরাজিত করে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন চীনপন্থী জোটপ্রধান মোহাম্মদ মুইজ্জু। এ বিজয়ে রাজধানী মালেসহ বিভিন্ন শহরে উল্লাস করেছেন মুইজ্জু সমর্থকেরা। চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ৪৫ বছর বয়সী মুইজ্জু ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপের আবাসন ও অবকাঠামো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। দেশটিতে বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এগিয়ে নেওয়াতেও বড় ভূমিকা তার। ভারতের তেলেবেগুনে জ্বলার আইটেম মুইজ্জু। হাতি গর্তে পড়লে চামচিকায়ও লাথি মারার মতো দিল্লিকে মোচড় দিচ্ছে কাবুলও। ভারত থেকে দূতাবাস গুটিয়ে নিয়েছে আফগানিস্তান। অজুহাত হিসেবে বলছে জনবল ও সম্পদ সংকটের কথা। এ সংকটের কারণে দূতাবাসের খরচ চালাতে না পারার বাহানা দিয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগও এনেছে তালেবান সরকার। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে তিন পৃষ্ঠার বিবৃতিতে পহেলা অক্টোবর থেকে দূতাবাস বন্ধের এই ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে চার দফা বাস্তবায়নে ভারতের প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত ফরিদ মাহমুদজাই। গুরুত্বপূর্ণ সব নথি তালেবান সরকারের কাছে হস্তান্তরের পাশাপাশি দাবি জানান, দূতাবাসের বাইরে আফগানিস্তানের নতুন পতাকা উড়তে দেওয়ার। জানানো হয় কার্যক্রম চালানোর নানা সীমাবদ্ধতাও। ২০২১ সালে সরকার বদল হলেও আশরাফ ঘানি প্রশাসনের নিয়োগপ্রাপ্ত মাহমুদজাইকেই রাষ্ট্রদূত হিসেবে রেখেছে কাবুল। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দেওয়ায় দূতাবাসের বাইরে তাদের মনোনীত পতাকা ওড়ানোরও অনুমতি দেয়নি নয়াদিল্লি। দূতাবাস বন্ধের এই ঘটনা দুঃখজনক বলে বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এদিকে মণিপুর রাজ্যে নিয়ন্ত্রণহীন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য এবার বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের দুষলেন ভারতের মণিপুর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং। কুকি ও মেইতি জনগোষ্ঠীর পাল্টাপাল্টি সহিংসতায় ৩ মে থেকে উত্তাল ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যটি। দেড়শ ছাড়িয়েছে নিহতের সংখ্যা। বাস্তুচ্যুত ৬০ হাজারের বেশি। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের দাবি, অস্থিতিশীলতা না থামার পেছনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সন্ত্রাসীদের হাত আছে। সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’ স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, প্রতিবেশী এই দুই দেশের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পরিস্থিতির অবনতিতে উসকানি দিচ্ছে।
এর বিপরীতে শেখ হাসিনার সমস্যা ভিন্ন মাত্রার। কতিপয় লুটেরা ও মাফিয়া চক্র বাংলাদেশের শরীর খুবলে খাচ্ছে। এখানে দুই কান কাটারা মাঝ রাস্তা দিয়া যায়? আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়ায়। দেশের ফরেন রিজার্ভের অবস্থা করুণ। রফতানি আয় কেবল কমছেই। রেমিট্যান্সেও খরা। মূল্যস্ফীতি ভয়ানক পর্যায়ে। এর মাঝে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের মানুষের কপালে অপরাধীর সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছে। তাতেও তাদের মানহানি হচ্ছে না। শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রী, নেতারা এতে ভয় বা লজ্জার কিছু না দেখলেও বিবেকবান মানুষের কাছে তারা যারপরনাই নিন্দিত। জঘন্য ভাষায় সমালোচিত। রাজনীতি-কূটনীতিতে মেসি-ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনায় আয়েশ-স্বস্তি-উচ্ছ্বাস বোধ করলেও এবারের পরিস্থিতি তিনি উতরাতে পারবেন কি না-এ নিয়ে শঙ্কার তীব্রতা চরম ঝাঁজালো। এ শঙ্কা ও যন্ত্রণার মাঝেও হাল ছাড়ছেন না শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কাউকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেÑএমন মন্তব্যের সমান্তরালে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর হেন চেষ্টা নেই, যা তিনি না করছেন। আবার এ কথাও বলছেন, দেখি কী করে তারা। উতরাতে পারবেন কি পারবেন নাÑসেই ফয়সালার কিছু অবশিষ্ট এখনো হাতের পাঁচের মতো আছে তার ঝুড়িতে। কিন্তু মোদি কী করবেন?
বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে অনেক কিছু ওলটপালট হয়ে যাওয়ার নমুনার মাঝে ভারতের পরাশক্তি হওয়া দূরের কথা, সামনের দিনগুলোতে আঞ্চলিক শক্তির আসন ধরে রাখাও ঝুঁকির সন্ধিক্ষণে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ-আন্তর্জাতিক উভয় চাপে বেশ কাবু মোদি। আর মোদির এই বেগতিক দশায় চিন্তিত শেখ হাসিনাও। কারণ নিজের গদি সামলাতেই যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন মোদি, সেখানে পরের গদি রক্ষার মন্ত্র দেওয়ার ফুরসত নেই তার। এর ওপর পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া পড়ছে ভারতের রাজনীতিতে। ভারত বিগত স্নায়ুযুদ্ধের পুরোটা সময় (১৯৪৮-১৯৯১) সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হওয়ায় ভারতও একই সঙ্গে পরাজিত হয়েছিল। ওই পরাজয়ের পরের দশকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। চীনের উত্থান ও চীনকে ঠেকাতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রমুখী নীতি, রাশিয়ার সঙ্গে ভারসাম্য ও আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিশ্বাস করতে থাকেন, পাকিস্তান চাইলেও সীমান্তে ভারতকে আর কাবু করতে পারবে না এবং আরেকটি যুদ্ধে জড়ানোর আর্থিক শক্তি পাকিস্তানের নেই। চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ ভূ-রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে থাকে ভারত। একদিকে যেমন সাংহাই কো-অপারেশনের সদস্য হয়ে চীনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, অন্যদিকে ‘চীন ঠেকানো’ পশ্চিমা জোট কোয়াডের নির্ভরযোগ্য খুঁটি হিসেবে থাকতে চায় ভারত।
স্নায়ুযুদ্ধবিহীন সময়ে (১৯৯১-২০২২) ভারত বুঝতে পারেনি যে আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ সামনে অপেক্ষা করছে। দাপটের সঙ্গে এগিয়ে চলা ‘রাইজিং ইন্ডিয়া’তে আবার পাঞ্জাব ও মণিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তা ভারতের নীতিনির্ধারকদের চিন্তার মধ্যেই ছিল না। কানাডার সঙ্গে বিরোধ এ পর্যায়ে যাবে, সেই শঙ্কাও ছিল না। এ ঘায়ের মাঝে মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারতীয় সেনাদের ফেরত পাঠিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার ঘোষণা দিয়েছেন। এসবের রসায়নে অন্ধকার ঘিরে ফেলছে ভারতকে, মোদিকে। বাংলাদেশকেও সেই শ্রেণিভুক্তিতে নিয়ে গেছে শেখ হাসিনার সরকার। আবার ভূ-রাজনৈতিক পুঁজিতে হাতে রাখছে বাঁক ঘোরানোর কিছু পথঘাটও।