চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন শুরুর দিনেই তৌহিদি জনতার নামে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত। ঢাকায় এ বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালে ৪০টি দেশের বিনিয়োগকারীরা অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশে। এমনকি ইসরায়েলের বন্ধু স্টারলিংককে যখন ব্যবসার দ্রুত সব আয়োজন করে দেওয়া হচ্ছে, তখন এই লুটপাট। কথিত ‘তৌহিদি’ জনতার ফিলিস্তিন নিয়ে এই আন্দোলন। কারও নিয়োগে বা বুঝে না বুঝে এসব করে তারা কার স্বার্থ রক্ষা করছে-প্রশ্ন থেকেই গেল। বারবার এ জাতের দুর্বৃত্তরা একেকটা অকর্ম করছে আর ড. ইউনূসকে দৌড়াতে হচ্ছে দেশের মান-মর্যাদা রক্ষায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে এ ধরনের হামলার উসকানিটা এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই যা ঘটার ঘটিয়ে দিয়েছে তারা। আওয়াজ তোলা হয়েছে বিদেশি পণ্য বর্জনের।
বর্জন আর লুটপাট মোটেই এক নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি পণ্য বয়কটকে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে দেখে। বাটার প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে এপেক্স, ওরিয়ন। তারা চাইবে বাটা ফিলিস্তিন ইস্যুতে বয়কটের শিকার হোক, কেএফসির প্রতিদ্বন্দ্বী সুগার বান-সিপিও চাইবে কেএফসি ফিলিস্তিন ইস্যুতে বয়কটের শিকার হোক। লোকাল পিৎজা ব্যান্ডগুলো চাইবে পিৎজা হাট বয়কটের শিকার হোক। প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলো এ ধরনের ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে বয়কট স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন করে। বয়কট স্ট্র্যাটেজিতে কেউ সমাধান খোঁজে, কেউ ভাবে স্যাবোটাজ। দোষটা চাপে মুসলমানদের ঘাড়ে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কখনো ব্রিটেন বা কখনো ইসরায়েল বা কখনো ভারত, চীন, জাপান বা কখনো রাশান-ইউরোপিয়ানরা লাভবান হয়। মুসলিমরা কেবল মার খায়, বেইজ্জত হয়। খুলনায় বাটার দোকান লুট হওয়ার আগে সেখানে হাজারের বেশি লোকের সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশ শেষে মুখে কাপড় বেঁধে একদল লোক ঢুকে লুট করেছে। সিলেটে লুটপাটের ঘটনায় কয়েকজনকে পাকড়াও করা হয়েছে। বাটার জুতার তলে যেন চাপা না পড়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা।
বাংলাদেশকে বিনিয়োগের একটি হাব বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে ড. ইউনূসের বিশ্ব ইমেজকে ঘিরে। বিনিয়োগ সম্মেলন প্রশ্নে এবারের আবহটা ছিল ভিন্ন। বড় মোক্ষম ও প্রাসঙ্গিক সময়ে বাংলাদেশের কোর্টে নিয়ে আসা হয় বিনিয়োগের বলটি। যখন যাবতীয় আলোচনা-পর্যালোচনার মূলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সফরে চীন কী দিয়েছে, আরও কত কী দেবে বাংলাদেশকেÑএ নিয়ে প্রশ্ন, তখন সেই আলোচনায় ছেদ ফেলে বিমসটেক সম্মেলন, সেখানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক। এ বৈঠকে কার জিত হয়েছে, কে ঠকেছে? সেখানে আবার ছেদ-ছন্দপতন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করারোপের ঘটনা। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানসহ ১৪টি দেশের নাগরিকদের ওপর সৌদি নিষেধাজ্ঞা। এই ভজঘট বা ঘটনার ঘনঘটার মাঝে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ পুনর্বিবেচনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে। দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের মধ্যে মার্কিন শুল্ক পুনর্বিবেচনা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন তিনি। চিঠিতে তিন মাসের জন্য ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রস্তাব স্থগিতের অনুরোধ জানানো হয়েছে। সোমবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেওয়া এ চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়, দেশটির বাণিজ্য অ্যাজেন্ডা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নে সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে মার্কিন পণ্য রপ্তানি দ্রুত বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা চিহ্নিত করতে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদারে বিশদ কার্যক্রম নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টাও কাজ করবেন বলে প্রধান উপদেষ্টার চিঠিতে জানানো হয়। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বময় কঠিন এ সময়টাতেই ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন। নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ তহবিল থেকে শুধু স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে মূলধন জোগান দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সোমবার সম্মেলনের প্রথম দিন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট বা বিনিয়োগ সম্মেলনে ‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ অধিবেশনে প্যানেল আলোচনায় এসব কথা জানান গভর্নর। স্টার্টআপ কানেক্ট অধিবেশনে দেশি-বিদেশি তরুণ ও উদ্ভাবনী উদ্যোক্তারা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল মাধ্যমে রেকর্ড করা বক্তব্য দেন লিংকডইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যান। ‘এম্পাওয়ারিং ইনোভেশন কানেকটিং অপরচুনিটি’ শিরোনামের এ বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ কী পেয়েছে, কী পাবে, সেই হালখাতা এখনই মেলানো সম্ভব নয়। এ বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রাপ্তি দৃশ্যমান হবে ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তা পাল্টানো শুরু হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যেকোনো বিনিয়োগকারী দেশে-বিদেশে যেখানেই বিনিয়োগের চিন্তা করেন তার বিনিয়োগকৃত অর্থের নিশ্চয়তা। বিনিয়োগ করতে কত সময় লাগবে, বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছ থেকে কী রকম সহায়তা মিলবে, তা ভাবতে হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এর একটি বার্তা পাবেন, এ আশাবাদের মধ্যে ঘটল উচ্ছৃঙ্খলতা-লুটপাট। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে সম্ভাব্য বিনিয়োগের আওয়াজ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ বিনিয়োগ করেছে কি না, সেই তথ্য থাকে না। বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছেও এ-সংক্রান্ত তথ্য নেই। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিসহ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। সে তালিকা অনুযায়ী আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ করানো সম্ভব হবে। বিগত সময়ে বিনিয়োগ সম্মেলন হতো বিদেশে। দেশ থেকে দল বেঁধে ব্যাংকাররা যেতেন, সঙ্গে থাকতেন কিছু ব্যবসায়ী, আমলা ও বিশেষ কোটারির কিছু সাংবাদিকের লটবহর। সবাই মিলে মোজমাস্তিতে সরকারি টাকা খরচ করে আসতেন। কেউ কেউ থেকেও যেতেন বা পরে সুবিধামতো সময়ে বিদেশে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এবার ওই পর্ব না থাকলেও যোগ হয়েছে লুটপাট- উচ্ছৃঙ্খলতাসহ বিদেশি পণ্য বয়কটের আওয়াজ।