এবিএম সালেহ উদ্দীন
সময়টি ছিল ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। চিলির গণতন্ত্র হরণকারী স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মঞ্চে গান গাইতে গাইতে ৪৬টি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিলেন ভিক্টর জারা।
চিলির গণমানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সে দেশের সামরিক স্বৈরশাসক আগুস্তো পিনোশের সৈন্যবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়। প্রেসিডেন্ট আয়েন্দেকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তখনকার সামরিক জান্তা সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
লাতিন আমেরিকার কোণে কোণে ভাগ্যহত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে তখন বিপ্লবী আন্দোলন তুঙ্গে। গণসংগীতের সমানতালে চলছে বিপ্লবী গান এবং শিল্প-সংস্কৃতির নানাবিধ কার্যক্রম।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের নির্মম উৎখাতের পর গোটা চিলিতে শুরু হয় স্বৈরশাসন। নির্যাতন, গুম, খুন ও হত্যাযজ্ঞের ভয়ংকর অধ্যায়।
১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যার পর সান্তিয়াগো স্টেডিয়ামে আটক হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আরও ছিলেন ভিক্টর জারা (১৯৩২-১৯৭৩), যিনি ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার জনপ্রিয় গীতিকার, নাট্য নির্দেশক, কবি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং বিপ্লবী রাজনীতিক।
চিলির মঞ্চনাটকের বিকাশ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানসহ যার ছিল অনেক অবদান, যিনি চিলির আঞ্চলিক নাটক থেকে শুরু করে জনজীবনের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর বিশেষ নিরীক্ষাধর্মী নাটকেরও নির্দেশনা দিতেন, একইভাবে কাব্যরচনা ও শিল্প-সংগীতের বিকাশে তার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সেই ক্ষণজন্মা সংস্কৃতিসেবী ও রাজনীতিকের নাম ভিক্টর লিদিও হারা (জারা) মার্তিনেজ। জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩২। তিনি ইতিমধ্যে চিলি তথা দক্ষিণ আমেরিকার লোকসংগীত ও নতুনধারার গানের পুরোধা হয়ে উঠেছেন। যিনি ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে সরকারের সময়কালের দেশাত্মবোধক গানের জনক এবং জীবন-জাগানিয়া গণসংগীতের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনাকারী। অনেকের স্মৃতিপটে যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ‘একজনের কণ্ঠে গান। অপরপক্ষের হাতে গান। একেবারে সম্মুখসমর!’
তারপর (১৯৭৩ সাল থেকে) দুদিকের শব্দই থেমে গিয়েছিল কয়েক দশক আগে। পরবর্তী প্রজন্মের গলায় প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ফিরে আসে তার কিছু গান। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায় লক্ষ জনতার কণ্ঠে বর্তমানে আবারও জেগে উঠেছেন ভিক্টর জারা।
পূর্বাপর ঘটনাবলি ও চিলির রাজনীতি : সেটি ছিল পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক। উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়েই লনকেন শহরে ফিরেছিলেন জারা। দু’চোখে তার দিনবদলের স্বপ্ন। গণমানুষের উন্নত জীবন গড়ে তোলার স্বপ্ন। চোখের সামনে সারা দিনই যেন ভেসে বেড়াচ্ছে ম্যাক্সিম গোর্কির আগুনঝরা পঙ্্ক্তিমালা।
মানবকল্যাণধর্মী কাজের সুবিধার্থে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও নাটকে অভিনয় করতে হবে তাকে। একই তাগিদে তিনি ভর্তি হলেন ইউনিভার্সিটি অব চিলির নাট্যকলা বিভাগে। সেখানে শুরু হলো তার নাটক ও থিয়েটারের কাজ। কিন্তু বেশি দিন বাঁধা-ধরা জীবনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না জারা। সে সময় চিলির গানের জগৎ মাতিয়ে রেখেছেন আরেক লোকসংগীতশিল্পী ‘ভায়োলেটা পেরা’।
মূলত তার গানে মুগ্ধ হয়ে নিজের পথের বাঁক পরিবর্তন করলেন ভিক্টর জারা। লোকসংগীত ও পল্লিগীতির তালিমও নিলেন তার কাছ থেকে। অতঃপর জড়িয়ে গেলেন, লাতিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক ও লোকসংগীত আন্দোলনে। গণসংগীতের সে আন্দোলন বদলে দিয়েছিল ভিক্টর জারার জীবন।
পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে আসার পর ভিক্টর যোগ দিলেন চিলির কমিউনিস্ট রাজনীতিতে। তত দিনে তার লেখা গান ছড়িয়ে পড়েছে গোটা কিউবাসহ লাতিন আমেরিকায়। মুখে মুখে সেসব গানের লাইন ঘুরে বেড়াচ্ছে কৃষক-শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষদের হৃদয়ের মাঝে। কখনো সেসব গান প্রতিরোধ গড়ে তুলছে অত্যাচারী শাসক দলের বিরুদ্ধে। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত গানের প্রথম অ্যালবাম সুপারহিট হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত আয়েন্দে সরকারকে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আগুস্তো পিনোশের বাহিনী চিলির ক্ষমতা দখলের পর সামরিক জান্তার নৃশংস নির্যাতনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সংগীতশিল্পী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ভিক্টর জারা। চিলি স্টেডিয়ামে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জারা-হত্যার বীভৎস স্মৃতি নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তার স্ত্রী জোন। স্ত্রী জোনের সুবাদেই ভারতের গণনাট্য সংঘ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ভিক্টর জারা রচিত ‘খোলা জানালার গান’।
সংগীতগুরু ‘ভায়োলেটা পেরা’র নিকট থেকে লোকগানে পোক্ত হয়েছিলেন জারা। তিনি গান লিখতেন, গান বাঁধতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আইয়েন্দে নিজ বামপন্থী সরকারের ক্যাবিনেটে ভিক্টর জারাকে দায়িত্বও দিয়েছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, আইয়েন্দে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর পিনোশে বাহিনী ভিক্টর জারাকে মরিয়া হয়ে খুঁজছিল। আইয়েন্দে সরকারের সমর্থক প্রায় পাঁচ হাজার লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় চিলি স্টেডিয়ামে। সেখানে জারাকে চেনার পর সেনাবাহিনীর জওয়ানরা তাকে স্টেডিয়ামের মধ্যখানে একটি চেয়ারে বসতে দেয়। সামনের টেবিলেই রাখা ছিল ভিক্টর জারার প্রিয় গিটার। প্রথমে বন্দুকের বাঁট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয় জারার দুই হাতের আঙুল। তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে হায়েনা কায়দায় তাকে গান গাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে।
অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন ভিক্টর জারা এবং শুরু করলেন পার্টির জন্য তার লেখা গান। পিনোশে বাহিনীকে চমকে দিয়ে স্টেডিয়ামে আটক পাঁচ হাজার কণ্ঠ যোগদান করে সেই বিপ্লবী গানে।
তারপর শোনা যায় গুলির শব্দ। চিলির স্বৈরশাসকের ৪৬ বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় ভিক্টর জারার দেহ। অবশেষে ভিক্টর জারার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহটি একটি গণকবরে ফেলে দেওয়া হয়।
তারপর বেশ কিছু গানের ক্যাসেট পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে ভিক্টর জারার স্ত্রী জোন ও কয়েকজন কিছু রেকর্ড সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। জোন ছিলেন ব্রিটিশ। তিনি স্বামী জারার গানগুলো ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং সেসব গান সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলায় অনূদিত ‘খোলা জানালার গান’ অ্যালবাম ছাড়াও জারার আরও গান বাংলায় রূপান্তর করা হয়।
পরবর্তী সময়ে জারার গানগুলোকে (ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায়) জোন ব্রিটেন ও আমেরিকায় ছড়িয়ে দেন। জোন ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল ভারতের গণনাট্য সংঘের কর্মকর্তা কঙ্কনবাবুর। জোন বেশ কিছু ক্যাসেটও পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। কঙ্কনবাবু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কাছাকাছি তুলনা করলে বলা যায়, হারা অনেকটা আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। দুর্ধর্ষ গলা। গণসংগীত, লোকসংগীত যেমন গাইতেন, তেমনি আধুনিক রোমান্টিক গানেও স্বচ্ছন্দ।’
ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের জন্য ভিক্টর জারার লেখা ‘রাইট টু লিভ ইন পিস’সহ গানগুলো বর্তমানে শোনা যাচ্ছে চিলির রাস্তায় এবং হাট-বাজারে। সেসব গান জারা লিখেছিলেন ভিয়েতনামসহ লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের জন্য। তিনি কবিতা ও গান লিখতেন এবং সুর করতেন। এ ছাড়া জারা ছিলেন সেরা গিটারিস্ট এবং নাট্য নির্দেশক। তিনি যখন গিটার বাজাতেন, দলে দলে লোক জমা হতো। বর্তমানে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে জারার দেশাত্মবোধক ও প্রতিবাদী গান। চিলির শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীদের জন্য জারার সেসব গান উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, যেসব গান গেয়ে ট্রেড ইউনিয়নের বিক্ষোভরত প্রতিবাদ মিছিলে উদ্দীপনাময় আগুন ঝরাতেন ভিক্টর জারা। নেতৃত্ব দিতেন গণসংগীতে।
১৯৬৯ সালে চিলিতে ঘটে যায় আরও কিছু অমানবিক ঘটনা। এর একটি পুয়ের্তো মন্টে শহরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় চিলির পুলিশ বাহিনী। ক্ষোভ ও প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন ভিক্টর জারা। তিনি লিখলেন, ‘প্রেজুনতাস পোর পুয়ের্তো মন্টে’ (পুয়ের্তো মন্টে গণহত্যা নিয়ে কিছু প্রশ্ন)। সেসব গানকে পাথেয় করেই চলতে থাকল চিলি গণ-আন্দোলন।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য ভিক্টর জারা বুঝতে পারলেন, একমাত্র রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া জনজীবনে শান্তি ও সুখ আসবে না। তাই তিনি চিলির কমিউনিস্ট পার্টি ‘পপুলার ইউনিটি কোয়ালিশন’-এর প্রধান সালভাদর আইয়েন্দের সঙ্গে হাত মেলালেন এবং আইয়েন্দের নির্বাচনী প্রচারে সস্ত্রীক যোগদান করলেন। চিলির জনগণকে উদ্দীপ্ত ও আন্দোলিত করে তুলেছিল তার রচিত ‘ভেনসেরেমোস’ গানসহ কয়েকটি বিপ্লবী সংগীত :
‘ফ্যাসিবাদী শৃঙ্খল ভেঙে স্পন্দিত হবে নতুন ভোর/ আমরা জিতব, Ñআমরা বিজয়ী হবই/ লেখা হবে ইতিহাস অমর...’
হ্যাঁ, স্বাধীনতাসংগ্রামী ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা ভিক্টর জারার গানের সূত্র ধরেই পাল্টে গিয়েছিল গোটা চিলির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়েই জিতেছিলেন আইয়েন্দে। চিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু সেই সরকারও টিকল না বেশি দিন। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সেনা অভ্যুত্থান গ্রাস করে নিল চিলির পার্লামেন্টকে। বোমাবর্ষণে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো কমিউনিস্ট রেডিও সেন্টার। সিংহাসনে বসলেন স্বৈরাচারী শাসক পিনোশে।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কুখ্যাত পিনোশের শাসনামলে ৩০ হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। নির্যাতিত হয় ২৭ হাজারের অধিক মানুষ।
বর্তমানে চিলিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরে আসার পর সে দেশের অনেক সামরিক অফিসার আমেরিকায় পালিয়ে অভিবাসন নিয়ে বসবাস করছে। তাদের সঙ্গে ভিক্টর জারার হত্যাকারী সৈনিক ‘পেদ্রো বারিয়েন্তোস’ও রয়েছেন।
ভিক্টরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জোন ন্যায়বিচার চেয়ে মামলা করেন। বিগত ৪৫ বছর ধরে তিনি এই ন্যায্য বিচারের আশায় ঘুরে বেরিয়েছেন। জোনের মতে, ভিক্টর জারার মৃত্যু কোনো ব্যক্তিগত, একক ট্র্যাজেডি নয়; সেটি হলো সম্মিলিত ট্র্যাজেডি (collective tragedy)। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে চিলির আদালত আটজন অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসারকে ভিক্টর হত্যার দায়ে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু মূল অভিযুক্ত ‘পেদ্রো বারিয়েন্তোস’ যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়ায় তাকে কোনো শাস্তি দেওয়া যায়নি।
২০০৩ সালে চিলির সেই অভিশপ্ত স্টেডিয়ামের নামকরণ হয় ‘ভিক্টর জারা স্টেডিয়াম’। প্রতিবছর তার স্মরণে রাজধানী সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত হয় ‘হাজার গিটার উৎসব’। সেখানে লক্ষ জনতা গেয়ে ওঠেন, ‘শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার’।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক