বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের সরে দাঁড়ানোয় নিউইয়র্ক সিটি নির্বাচনে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অক্টোবর সারপ্রাইজ এবং অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমসের বিরুদ্ধে ফেডারেল অভিযোগপত্র ঘোষণার পর রাজ্যের রাজনীতি আবারও সরগরম। আবারও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন জেমসের নাম উল্লেখ করে বলেন, বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকরণ ও অস্ত্রায়ন ভুল- চাই সেটা ট্রাম্পের আমলে হোক বা কোনো ডেমোক্র্যাটের হাতে। বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হলে মানুষ গণতন্ত্রের মূলভিত্তি- বিচারের ওপর থেকে আস্থা হারায়। তিনি আরও দাবি করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট তার ও তিনটি ডেমোক্র্যাটিক রাজ্যের গভর্নরদের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ সময়ে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিয়েছিল। বর্তমানে জেমস ও সাবেক এফবিআই ডিরেক্টর কমির ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ক্যুমো যদি তার অবস্থান সুসংগতভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারেন, তবে এই ঘটনা তার প্রচারণায় বিপরীত প্রভাব ফেলবে- বিশেষত যেসব ভোটার নৈতিকতা ও সততার প্রতীক হিসেবে জেমসকে দেখেন, তারা আরও দৃঢ়ভাবে মামদানির দিকে ঝুঁকবেন।
লেটিশিয়া জেমসের অভিযোগপত্র নিঃসন্দেহে নিউইয়র্ক রাজনীতিতে নতুন কাঁপন তুলেছে। কিন্তু এর প্রকৃত রাজনৈতিক লাভ বা ক্ষতি কার ভাগ্যে জোটে- তা নির্ভর করছে অ্যান্ড্রু ক্যুমো এই সংকটকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং ভোটাররা তার প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল থাকেন।
ট্রাম্পের ‘অক্টোবর সারপ্রাইজ’ : নভেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বহু বছর ধরেই ‘অক্টোবর সারপ্রাইস’ বা অক্টোবরের অঘটন এক পরিচিত শব্দ। সাধারণত এটি বোঝায়- ভোটের আগমুহূর্তে এমন কোনো বড় ঘটনা বা রাজনৈতিক ধাক্কা, যা পুরো নির্বাচনের গতিপথকে পাল্টে দিতে পারে। আর এবারের অঘটন ঘটেছে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনকে
কেন্দ্র করে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থিত ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি শুধু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নয়, নিউইয়র্কের নির্বাচনী মাঠেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ট্রাম্পের অক্টোবর সারপ্রাইজ’- যা সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে শহরের বর্তমান মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানির নির্বাচনী সম্ভাবনায়।
দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধের অবসান যেমন বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় তৈরি করছে, তেমনি নিউইয়র্কের মুসলিম, ইহুদি ও প্রগতিশীল ভোটারদের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করেছে।
অ্যাস্টোরিয়া এলাকার জনপ্রিয় ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জোহরান মামদানি, যিনি বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে শীর্ষ প্রার্থী, শুরু থেকেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে এক প্রগতিশীল ও মানবিক অবস্থান নিয়েছিলেন।
তবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর তাঁর আগের মন্তব্য ও ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা’ স্লোগান নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি অংশ মামদানির অবস্থানকে ইসরায়েল-বিরোধী ও ‘অ্যান্টিসেমিটিক’ বলে সমালোচনা করছে। অপরদিকে প্রো-প্যালেস্টাইন ভোটাররা দেখছেন ‘ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ় কণ্ঠস্বর’ হিসেবে।
হোয়াইট হাউস ও রিপাবলিকান শিবির মনে করছে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণা নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিতে বিভাজন আরও তীব্র করবে- যা রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া বা স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু ক্যুমোর পক্ষে ভোট টানতে সহায়ক হতে পারে।
ক্যুমোর পক্ষে ৫টি বরোর ৭০ জন ধর্মীয় নেতার সমর্থন ঘোষণা: নিউইয়র্ক শহরের পাঁচটি বরোজুড়ে ৭০ জন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ক্যুমোর প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
গত ১২ অক্টোবর ক্যুমোর প্রচার শিবির এক বিবৃতিতে জানায়, এই ধর্মীয় নেতারা শহরের হাজারো উপাসক ও দীর্ঘদিনের নৈতিক নেতৃত্বের প্রতিনিধি।
তাঁরা ক্যুমোর প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন।
ক্যুমো বলেন, ধর্মীয় নেতারাই আমাদের সমাজের প্রাণ। তাঁরা এই শহরের আত্মাকে সুস্থ রাখেন। এত সম্মানিত পাস্টর, বিশপ ও আধ্যাত্মিক নেতাদের সমর্থন পাওয়া আমার জন্য গর্বের বিষয়। আমার বিশ্বাস ও আশা কর্মের মাধ্যমে নিউইয়র্ককে নতুনভাবে গড়ে তুলবো।
নির্বাচনের মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি, আর ক্যুমোর এই ‘ফেইথ কোয়ালিশন’ সমর্থন হয়তো নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের দৌড়ে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করবে।
কেন মার্টিনের সমর্থন পেলেন মামদানি : জোহরান মামদানির পক্ষে এবার সরাসরি সমর্থন জানালেন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির (ডিএনসি) চেয়ার কেন মার্টিন। নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁর এই প্রকাশ্য সমর্থন মামদানির প্রচারণায় নতুন গতি আনতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
১০ অক্টোবর শুক্রবার এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে কেন মার্টিন লেখেন, তিনি নিউইয়র্ক সিটিকে সবার জন্য আরও বাসযোগ্য করতে লড়ছেন এবং তাঁর অসাধারণ প্রচারণা সারা জাতির দৃষ্টি কেড়েছে। নভেম্বরে জোহরানকে ভোট দিন।
নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল সেপ্টেম্বর মাসে মামদানিকে সমর্থন জানান। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লেখেন, তাঁদের মধ্যে নীতি-ভিন্নতা থাকলেও ‘শহরকে আরও সাশ্রয়ী করার’ লক্ষ্য দুজনেরই অভিন্ন।
পূর্বতন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস গত মাসে এমএসএনবিসি-তে সাক্ষাৎকারে বলেন, যেহেতু তিনিই আমাদের দলের মনোনীত প্রার্থী, তাই তাঁর প্রতি আমাদের সমর্থন থাকা উচিত।
এর আগে, পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব- চাক শুমার ও হাকিম জেফ্রিস- এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে মামদানিকে সমর্থন দেননি।
মামদানির অভূতপূর্ব উত্থানের গল্প : নিউইয়র্কের ব্যস্ত ফিফথ অ্যাভিনিউর এক সোমবার সকাল। মাত্র ৩৩ বছর বয়সী রাজনীতিক জোহরান মামদানি ইউনিয়নের এক বৈঠক শেষ করে তাঁর নির্বাচনী দফতরের পথে হাঁটছেন। কিন্তু এই শহরে তাঁর পক্ষে এখন আর নিঃশব্দে হাঁটা সম্ভব নয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশে জড়ো হয় মোবাইল হাতে উচ্ছ্বসিত জনতা। কেউ বলে ওঠে, ‘ওহ মাই গড, হ্যালো!’ কেউ হাততালি দেয়, কেউ আবার হর্ন বাজিয়ে সমর্থন জানায়। একপর্যায়ে এক প্লাম্বারের ভ্যান থেমে যায়, চালক দৌড়ে নেমে এসে হাত মেলায় এই তরুণ নেতার সঙ্গে।
মাঝেমধ্যে কিছু কটূক্তিও শোনা যায়- কেউ চীৎকার করে বলে, ‘অ্যান্টিসেমিটিক!’ কিন্তু তার মধ্যেও বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক ধরণের তারকাসুলভ উত্তেজনা।
২০২৫ সালের আগে পর্যন্ত জোহরান মামদানিকে খুব কম লোকই চিনতো। কুইন্সের এক পাড়ার অ্যাসেম্বলিম্যান, প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিক- এর বেশি কিছু নয়। অথচ আট মাসের মধ্যে তিনি নিউইয়র্ক সিটির সম্ভাব্য পরবর্তী মেয়র এবং আমেরিকান রাজনীতির এক নতুন মুখ।
তাঁর এই উত্থান যেনো রাতারাতি ঘটেছে! কিন্তু এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের তৃণমূল সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন ও তরুণ ভোটারদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এবং সাহসী নীতিনির্ভর রাজনীতি।
জোহরান মামদানির সমর্থন যেমন আকাশছোঁয়া, তেমনি বিতর্কও সমান তীব্র।
উগান্ডায় জন্ম নেয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই তরুণ রাজনীতিক এখন নিউইয়র্কের বহুসাংস্কৃতিক চেতনার এক প্রতীক। তাঁর প্রচারণায় যেমন শ্রমিক, কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন ভোটারদের সাড়া মিলছে, তেমনি অভিবাসী সম্প্রদায়ের তরুণ প্রজন্মও তাঁকে দেখছে এক ‘নিজের মতো’ নেতা হিসেবে।
মামদানি এখন শুধু নিউইয়র্কের প্রার্থী নন- তিনি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রগতিশীল রাজনীতির এক নতুন মুখ। তাঁর দ্রুত উত্থান অনেক বিশ্লেষকের চোখে ‘বার্নি স্যান্ডার্স প্রজন্মের উত্তরাধিকার’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তাঁর চারপাশে নিরাপত্তারক্ষীদের উপস্থিতি, জনতার উচ্ছ্বাস, এমনকি হুমকিমূলক বার্তা- সব মিলিয়ে তিনি এখন এক জীবন্ত বিতর্ক! এক নতুন যুগের প্রতীক!
ব্রুকলিনে রিপাবলিকান ঢেউ : নিউইয়র্কের রাজনৈতিক মানচিত্রে সাধারণত ব্রুকলিনকে ধরা হয় ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি হিসেবে। কিন্তু চলতি মেয়র নির্বাচনের শেষ পর্বে সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া, যিনি তাঁর স্বভাবসুলভ তেজ, অদম্য এনার্জি এবং রাস্তাঘাটের মানুষদের ভাষায় সরাসরি বক্তব্য দিয়ে আবারও আলোচনায়। ৬৯ বছর বয়সী এই প্রাক্তন গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলস প্রতিষ্ঠাতা ও রেডিও হোস্ট এবার দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র পদে লড়ছেন।
কিনি বলেন, ‘আমি আগের নির্বাচনে ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলাম। বেশিরভাগ ভোটার এখনো আমার পাশে। রিপাবলিকানরা ফিরে আসবে, স্বাধীন ভোটারদেরও আমি আগের চেয়ে বেশি পাচ্ছি। এবার নতুন ‘প্রটেক্ট অ্যানিমেলস’ ব্যালট লাইন আছে- এটা মূলত নারী ভোটারদের আকর্ষণ করবে। আমি অন্তত আরও চার-পাঁচ শতাংশ যোগ করতে পারবো। এবার আমি প্রতিদ্বন্দ্বী, দর্শক নই।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কৌশল স্লিওয়াকে শহুরে ভোটারদের এক নতুন অংশে পৌঁছে দিচ্ছে- যারা ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকানদের সমর্থক নয়।
কার্টিস স্লিওয়া নিউইয়র্ক রাজনীতির এক অদ্ভূত চরিত্র- যিনি বিলাসবহুল অফিসে নয়, বরং রাস্তার মোড়ে, সাবওয়েতে বা ডেলি ক্যাফেতে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাঁর বক্তৃতায় থাকে হাস্যরস, গল্প এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ।
একজন ভোটার বলেন, ওনার মধ্যে নিউইয়র্কের রাস্তাঘাটের গন্ধ আছে। তিনি যেভাবে কথা বলেন, মনে হয় এই শহরটা তাঁর রক্তে।
তবে কঠিন বাস্তবতা হলো- নিউইয়র্কে রিপাবলিকানদের জন্য জয় এখনো কঠিন। গত দুই মেয়র নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীরা পেয়েছিলেন যথাক্রমে ২৪% (২০১৩, জো লোট্টা) এবং ২৮% (২০১৭, নিকোল মালিয়োটাকিস) ভোট। স্লিওয়া মনে করেন, তিনি সেই অবস্থান থেকে এগিয়ে আছেন। তিনি বলেন, আমি ডেমোক্র্যাটদের মতো কর্পোরেট অনুদান চাই না। আমি শহরের বাস্তব মানুষদের কণ্ঠস্বর- ট্যাক্সি ড্রাইভার, দোকানদার, সাবওয়ে মিউজিশিয়ানদের। ব্রুকলিনের এক জনসভায় স্লিওয়া বলেন, ‘আমি হাল ছাড়ার মানুষ নই। এই শহর যেমন কখনো থামে না, আমিও থামবো না।’