বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও বেড়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪.৮ শতাংশ, জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আগামী বছর তা উঠতে পারে ৬.৩ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ এখন দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফ নির্ধারিত বিপিএম-৬ মানদণ্ডে হিসাব করলে এই রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ভরপুর রেমিট্যান্সেও। ১ জুলাই থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ৮ হাজার ৮ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। শুধু অক্টোবর মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৪২২ মিলিয়ন ডলার। প্রবাসীদের কষ্টের এ টাকায় থাবা বসাতে যাচ্ছে সরকার। ঋণের কিস্তি ছাড়ের শর্ত হিসেবে তা বাতলে দিয়েছে আইএমএফ। এ রকম একটি অজনপ্রিয় প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে লোকসানি ব্যবসায় আরও বেশি হারে কর বসানোরও শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। এতে হুন্ডি কমিয়ে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়াতে এত দিন ধরে যে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসীদের উৎসাহিত করা হতো; সেখানে উল্টো করারোপ প্রস্তাব রীতিমতো আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রেমিট্যান্স-প্রবাহে ব্যাপক সাড়া। তা প্রতি মাসেই বাড়তে বাড়তে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কারণেও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। আইএমএফের বাতলানো পথে হাঁটলে শিগগিরই রেমিট্যান্সে ছন্দপতন ঘটতে পারে। এতে নির্ঘাত আবার বাড়বে হুন্ডিসহ অর্থ পাচার তৎপরতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬.৮০ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছে ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। ডলার সংকট কাটাতে সরকার যখন রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়াতে মরিয়া, তখনই আইএমএফের এমন শর্তের বেড়াজাল। সরকারের ভেতরের একটি অংশ তা না মানার পরিকল্পনা করছে। বিদায়ের শেষ সময়ে এসে এ ধরনের উদ্যোগ সরকারকে বিপদে ফেলার শঙ্কা এ গ্রুপটির।
রেমিট্যান্সে কর বসানোর প্রস্তাবের পাশাপাশি সংস্থাটি ব্যবসায় মন্দার সময়ও লোকসানি ব্যবসার ওপর আরও কর বসানোর শর্ত দিয়েছে। আইএমএফ বলেছে, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও ন্যূনতম কর দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে আরও চাপে পড়বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। সংকুচিত হবে মূলধন। এমনিতেই চরম সংকটে বিজনেস কমিউনিটি। না পারছে সইতে, না পারছে বলতে। বোবা কান্নায় হাবুডুবুতে থাকা ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্ট জব্দ, মামলা-হয়রানিতে অনেককে ভিলেন বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ব্যাংক হিসাব জব্দের নমুনায় শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীর-কামরুন্নাহার দম্পতির লেভেলে নামিয়ে আনার কুপ্রবণতার শিকার কয়েক ব্যবসায়ী। তাদের ওপর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভীতিকর নানা কাণ্ডকীর্তিতে চলল এক ফের। এর পরও হাল না ছেড়ে টিকে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের আরেক ফের। এমনিতেই মামলা-হামলাসহ নানা ঘটনায় দেশের বেশ কিছু শিল্প গ্রুপের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন কারখানায় পরিকল্পিতভাবে ভাঙচুর, বিক্ষোভ ও হামলা চালিয়েছে চক্রবিশেষ। তার ওপর ব্যবসায়ীদের নামে পাইকারি মামলাবাজি।
এসবের তোড়ে বহু কারখানা বন্ধ। কর্মহীন লাখ তিনেকের মতো শ্রমিক-কর্মচারী। সরকারের বিভিন্ন কর্নার থেকে শক্ত হওয়ার আশ্বাস মিলেছে। এসব আর হবে না- এমন ভরসা মেলায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা দেয়। নতুন করে হামলা, লুট, মামলার তেজও কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু নতুন করে থাবা হানা হচ্ছে নানাভাবে। নির্বাচন সামনে রেখে এতে ঢোলের বাড়ি পড়েছে। অ্যাকাউন্ট জব্দের বিষয়টি চরম অপমানের। তা সমাজে তাদের কারও কারও মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞার মতো। তার ওপর ব্যবসা-বিনিয়োগে সহায়ক নীতিমালা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় সংস্কার আবশ্যক হলেও এর নমুনা নেই। দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় গলদ অনেক দিনের। কেউ কেউ দলবাজিতে জড়িয়ে বিনা বিনিয়োগে টাকা হাতিয়েছেন। বাকিরা বিশাল পুঁজি খাটিয়ে অনেকের কর্মসংস্থান করেও টিকে থাকার চেষ্টায় কুলাতে পারেননি। যার জেরে দেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই মন্দা। ব্যবসা-বিনিয়োগে ভর করছে সংকটের পর সংকট। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একদিকে যেমন বেশ কিছু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে, আবার সম্ভাবনাময় অনেক শিল্প-কারখানাও অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
অর্থায়ন সংকট, ঋণ সহায়তা, সুদহার বৃদ্ধিও ব্যবসায়ীদের অনেকের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে বিনিয়োগের ব্যাপক রূপকথার তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই বিনিয়োগের আহ্বান রাখছেন। কথা দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবে বিনিয়োগের সুখবর নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশি আর বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারীই এমন অনিশ্চয়তায় থাকতে চান না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ব্যাপারে আরও বেশি সাবধানী। বেশি চালাকও তারা। বিনিয়োগের পরিবেশ, সম্ভাব্যতা, পুঁজির গ্যারান্টির কথা বলে তারা পিছিয়ে যান। পরিস্থিতির বাস্তবতা ও নানা সীমাবদ্ধতায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা তা সরাসরি বলতে পারছেন না। কোনো কোনো ব্যবসায়ী তো সভা-সেমিনারও এড়িয়ে চলেন। কী বলে কোন ঝামেলায় পড়েন, কোন ট্যাগের শিকার হন-সেই ভয়ের তাড়নায় তারা। চট্টগ্রাম ও ঢাকাকে ঘিরে গড়ে ওঠা ইস্পাত, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, সিরামিক খাত কী কারণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে? তারা এর ভেতরটা জানলেও বলেন না। গত সাত-আট মাসে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট ও লাগামহীন দাম বৃদ্ধির ফলে অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কর্মহারা অনেকে। আর বিনিয়োগের অপেক্ষায় থাকা শতাধিক প্রকল্প থমকে গেছে।
দেশি ব্যবসায়ীরা গলা খুলে বলছেন না বলে এ তথ্য বিদেশিদের অজানা থাকছে না। দেশি ব্যবসায়ীদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের ভলিউম বেশ মোটা। মানি লন্ডারিং, রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি দখল, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগ। নানা অভিযোগের ঢালাও প্রচারে বিচারের আগেই একধরনের সাজা হয়ে যাচ্ছে। পারলে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে নাতিপুতিদেরও চরিত্র হননের কাজটি করে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকলে কেবল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নয়, আরও অনেক কিছুই জব্দ করা যায়। শক্ত বিচারের আওতায় নেওয়াও জরুরি। কিন্তু সেই পথ না মাড়িয়ে একতরফা ট্রায়ালে একদিকে বিনিয়োগ মাঠে মারা যাচ্ছে, আরেকদিকে সামাজিক মানসম্মানও খেয়ে ফেলা হচ্ছে। এ যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বিজনেস কমিউনিটির অনেকে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য উতলা। কিন্তু সেখানেও ভেজাল পাকছে। বিভিন্ন দল নানাভাবে চড়াও হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ওপর। এ শাঁখের করাতে পড়ে ছোট-বড় মিল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামনে আরও কী অপেক্ষা করছে, মালিকদের ভাবনায় অকুলান। কারখানা চালু রাখা, অর্ডার নেওয়া, কাঁচামাল কেনা, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অন্ধকার দেখছেন তারা। বিদেশে পণ্য পাঠিয়েও প্রতারণার কারণে রপ্তানির অর্থ দেশে আনতে পারছেন না বহু পোশাক কারখানার মালিক। রপ্তানির বিপরীতে এ রকম প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে আটকে আছে বলে দাবি করেছে এ খাতের রপ্তানিকারক সংগঠনÑবিজিএমইএ। এর পেছনে বায়ারদের পাশাপাশি বায়িং হাউস, শিপিং এজেন্ট এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের যোগসাজশ দায়ীÑএমন অভিযোগ রপ্তানিকারকদের। তবে রপ্তানির অর্থ দেশে আনতে ব্যর্থতার জন্য রপ্তানিকারকদের অবহেলা-অদক্ষতা দায়ী, বলছেন অভিযুক্তরা। বায়ারদের অর্ডার অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে প্রায় শতভাগ কারখানা। তাদের শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য রপ্তানিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান রপ্তানিকারকেরা। কিন্তু পণ্য রপ্তানি করেও অর্থ বুঝে পান না অনেকে। অস্ট্রেলিয়ার নামকরা ফ্যাশন খুচরা বিক্রেতা মোজাইক ব্র্যান্ডের কাছে এমন অর্থ আটকে আছে ২ কোটি ডলার। এমন প্রায় ৩ কোটি টাকার পণ্য পাঠিয়ে এক টাকাও ফেরত না পাওয়ার ঘটনা রয়েছে দুই ডজনেরও বেশি। তবে রপ্তানির অর্থ আটকে যাওয়ার জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর, সেই বায়িং হাউস, শিপিং এজেন্ট এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের দাবি, রপ্তানিকারকদের অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। এর ভেতরেও রয়েছে নানা ফের।