সুবর্ণ সুযোগ এসেছিলো ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর পরই। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের ঐতিহাসিক পতন। রাজনীতিতে খোলা মাঠ পেয়ে গিয়েছিলো বিদ্রোহী বিএনপি। প্রায় ১৮ বছর পর আধিপত্য বিস্তারের রাজনৈতিক সুযোগ। কিন্তু ভুল চাল দেয়ায় এখন পস্তাতে হচ্ছে। প্রবীণ নেতারা বলছেন, সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। কৌশলী না হওয়ায় এখন মাশুল গুণতে হচ্ছে।
কৌতুহলীদের প্রশ্ন- কি সেই সুবর্ণ সুযোগ? নীতি নির্ধারণী মহল কেনো এখন এতো আফসোস করছেন? প্রবীণদের মতে, সুযোগকে কাজে লাগানোই রাজনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি। ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ফলে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দিক-নির্দেশনা পেয়েছিলো। ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরও জে. জিয়া জাদু দেখিয়েছেন। ‘সিপাহী ও জনতার বিপ্লব’ দিয়ে দেশকে জাগিয়েছেন। ১৯৭৭-এর ৩০ মে গণভোটে তিনি রাষ্ট্রপতিত্ব স্থায়ী করেছেন। ১৯৭৮-এর পয়লা সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র দিয়েছেন। উন্নয়নমূলক নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করেছেন। ১৯৮১-এর ৩০ মে চট্টগ্রামে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়া। মিনি সামরিক অভ্যুত্থান হলেও বিএনপির হাতেই ছিলো ক্ষমতা। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু অব্যবস্থাপনার অজুহাতে সেনাপ্রধান জে. এরশাদ ক্যু করেন। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতাযাপন। বিএনপির আপোষহীন নেতৃত্বে বেগম খালেদা জিয়ার উত্থান। ১৯৯১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিজয় ও ক্ষমতা গ্রহণ।
বিএনপির ভেলায় জামায়াত
যেভাবে প্রথম ক্ষমতায়
জামায়াত প্রথম রাজনৈতিক নিবন্ধন পায় জিয়ার শাসনামলে। তখন যুক্তি ছিলো- এরা প্রকাশ্য রাজনীতি করুক। নতুবা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ বা জঙ্গী দলের তৎপরতা চালাবে। সেক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিনতর হবে। নিবন্ধন পেলেও তারা তখন নির্বাচনী সুযোগ পায়নি। ১৯৮৬-তে জে. এরশাদের সময়কালে প্রথম নির্বাচনে নামে। বিএনপিসহ বাম ঘরানার ৫ দলীয় জোট প্রত্যাখ্যান করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সংসদে যায়। অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসা ‘এরশাদ সরকার’কে বৈধতা দেয়া হয়। তখন ক্ষমতাসীন ছিলো এরশাদ প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় পার্টি’।
নির্বাচনে ‘কেয়ার টেকার’ পদ্ধতির প্রস্তাব করে জামায়াত। সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম প্রথম প্রস্তাবক। ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। জামায়াত, জাপা নেতাদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন শেখ হাসিনা। তত্ত্ববধায়ক সরকার-এর দাবিতে ১৭৩ দিন হরতালও করেন। বিরোধী দল হিসেবে সবাই সংসদ বর্জনও করেন। ফলে তত্ত্ববধায়ক সরকার বিল পাশে নতুন সংসদের প্রয়োজন হয়। ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনে সংসদ গঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন হয় জুনে। ২৩ জুন শপথ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার।
২০০০-এ নতুন জোট গড়েন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। চারদলীয় জোটে যোগ দেন জাতীয় নেতৃবর্গ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় পার্টি’। অধ্যাপক গোলাম আজমের নেতৃত্বে ‘জামায়াতে ইসলামী’। শায়খুল হাদীস মাওলানা আমিনীর নেতৃত্বে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’। ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনে জোটটি বিজয় পায়। জে. এরশাদ অবশ্য শেষতক জোটে থাকতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বিচ্ছিন্ন করাতে সক্ষম হন।
দেশে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমবারের মতো জামায়াত থেকে দু’জনকে মন্ত্রী করেন। মাওলানা নিজামী ও মোজাহিদ ‘জাতীয় পতাকা’ পান। বিষয়টি দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিএনপি-বিরোধী প্রচারণায় নামে। রাজনীতিতে ‘বিএনপি-জামায়াত’ শব্দদ্বয় একযোগে ব্যবহৃত হতে থাকে।
সচেতন মহলের মতে, জামায়াত সম্পৃক্ততা বিএনপির ঐতিহাসিক ভুল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার দলকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬-এ শিবিরের সমাবেশে তারেক রহমান উপস্থিত হন। ২০১৮-এর নির্বাচনে জামায়াত ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচন করে। বিষয়গুলো বিএনপির রাজনীতির ইতিহাসে ক্ষতচিহ্ন স্বরূপ।
ডাকসু-জাকসুতে জামায়াত ॥ সরকারে তাহলে কে?
ক্ষমতায় যেতে চাই সিলেট সদরের আসন
সেপ্টেম্বরের শুরুতে ডাকসু ও জাকসুতে বিজয় পায় শিবির। ছাত্র সংগঠনের ব্যাপক বিজয়ে নড়েচড়ে বসে জামায়াত। অসুস্থ আমীর ডা. শফিকুর রহমান শয্যা ছাড়েন।
তিনি এবার সিলেট সদরে প্রার্থী হবেন। শৈশব, কৈশোর শিক্ষা শহর সিলেটেই। রীতি রয়েছে, সিলেট সদরে জেতা মানে সরকার গড়া। জামায়াতের প্রত্যাশা, ডা. শফিক জিতবেন। আর পুরো জামায়াত সারাদেশে ক্ষমতার পতাকা ওড়াবে।
পি-আর পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে চলছে জোরালো আন্দোলন। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত চলছে মিছিল, সভা, সমাবেশ। আসন্ন নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘বিএনপি।’ ৬ মাস পূর্বেও ছিলো সহাবস্থান। এখন সম্পর্কটি অনেকটা দা-কুমড়োর। কথায় কথায় বিএনপির সমালোচনায় তারা মুখর। বলছে, ওরা চাঁদাবাজ, দখলদার, ক্ষমতলিপ্সু। ক্ষমতা পাওয়ার আগেই অবৈধ ক্ষমতাবান সেজেছে।
সমালোচনা কর্মে বিএনপি নেতারাও বসে নেই। বলছে, জামায়াত ‘জান্নাতের টিকেট’ বিক্রি করছে। ৪৭-এ তারা পাকিস্তান চায়নি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাও চায়নি। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নামে ব্যবসা করছে। ‘সার্বজনীন ইসলাম’ শব্দটিকে পুঁিজ হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা রাজনীতিক নয়, বরং ‘ইসলামিক জঙ্গী’।
বিএনপির সমালোচনার জবাবও দিচ্ছেন জামায়াত নেতারা। বলেছেন- জোটে থাকলেই সঙ্গী, বাইরে থাকলে জঙ্গী। আমরা অপরাধী হলে একজোটে ভোট করেছেন কেনো? তখন তো রাজাকার, আলবদর, ধর্ষক বলেননি...!
উল্লেখ্য, এই ইস্যুতে বিএনপি পড়েছে মহাবিপাকে। প্রবীণরা বলছেন, ২০০০-এ জোট করা ভুল ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের দেশে জামায়াতের উত্থান মূল চেতনার পরিপন্থি। নিয়তি এখন তার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া।
স্থানীয় সরাকার নির্বাচনকে অগ্রাহ্য ॥ বিশাল
ভুলের মাশুল গুণছে বিএনপি
ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের ৭২ ঘন্টাও অতিবাহিত হয়নি। হাজার লাশের রক্ত তখনও শুকায়নি। কিন্তু ঢাকায় বিশাল বিজয় উৎসব করে বিএনপি। বিষয়টি সচেতন মহলে কিছুটা বিরক্তি ঘটায়। এরপর সারাদেশে চলে নিয়ন্ত্রণহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নোটিশ দেন। তাগাদা দেন চাঁদাবাজি, দখলবাজি বন্ধের। কিন্তু টানা যায়নি নিয়ন্ত্রণরেখা। অন্যদিকে জামায়াত-এর বিশেষ সেল চালায় প্রচারণা। ফলে বিএনপির সংগ্রামী ভাবমূর্তি নিম্নমুখী হয়।
গত ৮ আগস্ট ২০২৪ গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। বাতিল করে হাসিনা শাসনামলের জেলা পরিষদ, মেয়র এবং উপজেলা পরিষদও। এগুলোতে ৯৫% ছিলো আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ। শেখ হাসিনার পদাঙ্ক অনুসরণে তারাও পলাতক। ইউনিয়ন পরিষদ চালু থাকলেও নেতারা পলাতক। নেতৃত্বহীন হয়ে ওঠে স্থানীয় সরকার। অধিকাংশ এলাকায় দিনে দিনে অপরাধ বাড়তে থাকে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে ‘ঠিকানা’ প্রথম প্রতিবেদন ছাপে।
বিষয়টি আমলে নেয় ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগ্রহ জানায়। কিন্তু বাঁধ সাথে তৎকালীন বিএনপি। নেতাদের মতে, আগে সংসদ নির্বাচন। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নির্বাচন প্রসঙ্গ।
এ বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের বিশ্লেষণ ছিলো ভিন্ন। যে, সংসদ নির্বাচনে নিশ্চিৎ বিএনপিই জিতবে। অতঃপর পছন্দের মানুষদের জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে বসাবে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাঁদের মতামত পাল্টে গেছে। কানে কানে বলছেন, আমাদের ভুল হয়ে গেছে।
প্রবীণ বিশ্লেষকদের মতে, সে এক সময় ছিলো। তখন জামায়াত এলাকায় এলাকায় ততোটা প্রভাবশালী ছিলো না। ‘এনসিপি’ নামক কিংস পার্টিও গঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা সব পলাতক ছিলো। সমর্থকেরাও আতঙ্কিত অবস্থায় নীরব ছিলো। প্রশাসনের আওয়ামী পন্থীরাও গা বাঁচাতে ব্যস্ত। এস. আলমের চার হাজার কোটি টাকার আওয়ামী বাজেট ছিলো না। সুতরাং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি কায়েম করতো রাজ। ধানের শীষের বিজয় ভেলায় ভাসতো সারাদেশ। দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি-দখলদারি করতে হতো না। জেলা-উপজেলা, মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদে কতরকম কাজ। বৈধভাবে উপার্জনে নিবেদিত থাকতো না-খাওয়া কর্মীরা।
স্থানীয় সরকারে থেকে দলটি তৃণমূলের রাজনীতি গোছাতে পারতো। প্রায় ১০ হাজার নেতা পদ-পদবী পেতো। ফলে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ সহজতর হতো। এমপি পদেও মনোনয়ন পেতে ভিড়ও কমতো। কিন্তু অদূরদর্শিতার কারণে এখন লেজে-গোবরে পরিস্থিতি। অন্যদিকে তৃতীয় স্থানে থাকা জামায়াত গুছিয়েছে দল। কৌশলের জেরে এখন স্বপ্ন দেখছে রাষ্ট্র পরিচালনার।