Thikana News
০৬ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

লাউ চারা

লাউ চারা



 
গ্রীষ্মের রোদ তখন পুরোপুরি নিজের দাপট দেখাচ্ছে। আমেরিকার উপশহরের আকাশ নীলের ভেতরে গলিত সোনার মতো ঝলমল করছে, লনের ঘাসে শিশির নেই, কেবল সমান কেটে রাখা সবুজের মসৃণতা। এই সবুজের ভেতরেই থাকেন রমেশ বাবুÑবাংলাদেশ থেকে বহু বছর আগে আসা এক প্রবাসী, যিনি বহু বছর আগে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছেন। জীবনের এই বয়সে তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। বড় ছেলে থাকে ভার্জিনিয়ায়, মেজো ছেলে টেক্সাসে আর ছোট ছেলে ক্যালিফোর্নিয়ায়। বছর ঘুরে পালাক্রমে তিনি সবার বাড়িতে থাকেন-কখনো এই শহর, কখনো অন্য রাজ্য।

নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলায়, গল্পে সময় কেটে যায়, কিন্তু রাতের গভীরে সব চুপ হলে তার বুকের ভেতর একটি নিঃশব্দ শূন্যতা জমে ওঠে। নিজের ঘর নেই, নিজের উঠোন নেই, নিজের হাতে গাছ লাগানোর মাটি নেইÑএই অভাব মাঝে মাঝে তীব্রভাবে খোঁচা দেয়।

এবার গ্রীষ্মে, পরিচিত প্রতিবেশী এক বাংলাদেশি সমবয়স্ক ভদ্রলোক তার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন। মাদারীপুরের ভদ্রলোকের নাম গিয়াস উদ্দিন তরফদার, পাশের অ্যাভিনিউতে থাকেন। সব সময় হাসিখুশি ভদ্রলোকের সাথে হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই দেখা হয়। দেশ নিয়ে, এখানকার জীবনযাত্রা নিয়ে তার সাথে খুঁটিনাটি অনেক কথাবার্তা হয়। দু-একবার তাদের বাসায় যাওয়া হয়েছে, তারাও রমেশ বাবুর সাথে বাসায় এসেছেন, চা-বিস্কুট খেয়েছেন।
-দাদা, একটা সারপ্রাইজ! এই বলে রমেশ বাবুর হাতে একটি খাম ধরিয়ে দেন, তরফদারের মুখে রহস্যময় হাসি।
-কী আছে এর ভেতরে? রমেশ বাবু খামটি খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করেন।
-এখন না, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখবেন! তরফদারের মুখে আবারও রহস্যময় হাসি।
তার কথা অনুযায়ী খামটি না খুলে হাঁটা শেষ করে সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরলেন। খামটি খুলে দেখলেন, ভেতরে কয়েকটি শুকনো বীজ। লাউয়ের বীজ। বীজগুলো হাতে নিয়ে তার বুকের ভেতর হঠাৎ যেন উষ্ণ ঢেউ বয়ে গেল। কত বছর আগে দেশের বিশাল বাড়ির আঙিনায় তিনি নিজ হাতে কত শাকসবজি, ফলফসল লাগাতেন-লাউ, কুমড়ো, শিম, ধনেপাতা। সকালের কুয়াশায় বাগানে হাঁটতে হাঁটতে পাতায় জমা শিশিরের স্পর্শ, দুপুরে সদ্য কাটা সবজির গন্ধ, বিকেলে লতাগুল্মের ছায়ায় চায়ের কাপে চুমুক-সব যেন এক মুহূর্তে ফিরে এল।

তিনি ভাবলেন, এই বীজগুলো এখানে অঙ্কুরিত করলে অন্তত এক কোণে দেশের গন্ধ পাওয়া যাবে। রান্নাঘরের এক পাশে একটি স্বচ্ছ গ্লাসে বীজগুলো ভিজিয়ে রাখলেন। প্রতিদিন যত্ন করে পানি বদলাতে লাগলেন, আঙুলের ডগায় বীজের গা ছুঁয়ে দেখতেন নরম হয়েছে কি না। মনে হচ্ছিল, যেন শৈশবের কোনো স্মৃতি তিনি আবার বাঁচিয়ে তুলছেন।

কয়েক দিনের মধ্যেই বীজ থেকে ছোট্ট অঙ্কুর বেরোল। সবুজের সেই প্রথম আভা দেখে রমেশ বাবুর মনে অপার আনন্দ জন্ম নিল। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, বাড়ির পেছনের লনের এক কোণে চারাগুলো লাগাবেন। গ্রীষ্মের শেষে লতাগুল্ম বেয়ে যদি লাউ ঝুলে, নাতিদের দেখাবেন, দেশের গল্প বলবেন, সেই লাউ দিয়ে কুঁচো চিংড়ি রান্না করে সবাইকে খাওয়াবেন।

একদিন নাশতার টেবিলে কথা প্রসঙ্গে বলেও ফেললেন, ‘ভাবছি, লনের পেছনে কয়েকটা লাউয়ের চারা লাগাব।’ ছেলে অল্প হাসল, পুত্রবধূ নীরবে মাথা নাড়ল। রমেশ বাবু তাতে কোনো সংশয় দেখলেন না। কিন্তু তিনি জানতেন না, এই বাড়ির লনের সবুজ শুধু সৌন্দর্যের জন্যই, কোনো গাছপালা লাগানো নিষিদ্ধ।
হোমওনারস অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম রয়েছেÑলনের চেহারা এক ইঞ্চি বদলালেও শাস্তি, জরিমানা। ছেলে-বউ এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও রমেশ বাবু ভেবেছিলেন, কয়েকটা লাউয়ের গাছ কোনো ক্ষতি করবে না।
দুই দিন পর রান্নাঘরে ঢুকে তার চোখে পড়ল-গ্লাস খালি। কোথাও কোনো চারা নেই। বিস্ময়ে চারপাশে খুঁজলেন, শেষে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার চারাগুলো কোথায়?’ পুত্রবধূ কিছুটা সংকোচে বলল, ‘আসলে লনের ঘাস নষ্ট হয়ে যাবে, আর অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মও আছে। তাই আমরা ওগুলো কমিউনিটি গার্ডেনে দিয়ে দিয়েছি।’

কথাটা যেন বুকের ভেতর ঠেসে বসা কোনো ভারী পাথরের মতো লাগল রমেশ বাবুর। শুধু চারাগুলো নয়, যেন তার ইচ্ছে, তার আনন্দ, তার স্মৃতির এক টুকরোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি কিছু বললেন না, শুধু চুপ করে জানালার বাইরে তাকালেন।

সেই রাতে ঘুম এল না। জানালার ধারে বসে অনেকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলেন। চাঁদের আলোয় লন ঝকঝক করছে, সবুজ একেবারে নিখুঁত, কিন্তু তার কাছে তা প্রাণহীন। মনে পড়ল, দেশের সেই বাড়িÑসকালবেলা উঠেই যেখানে হাতে কাঁচি নিয়ে গাছ ছাঁটতেন, মাটি খুঁড়তেন, সার দিতেন। দুপুরে গাছের তলায় বসে ঠান্ডা বাতাস খেতেন, তার স্ত্রী বিকেলে শাকপাতা তুলে রান্না করতেন। এই অচেনা দেশে, এই নিখুঁত কিন্তু শিকড়হীন সবুজের ভেতর তিনি কেবল একজন অতিথি।

তিনি বুঝতে পারলেন, বয়সের এই সময়ে তিনি নিজেও এক আলগা শেকড়ের লাউয়ের চারা, যাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়, যার কোনো স্থায়ী মাটি নেই, নিরাপত্তা নেই, নিজের ইচ্ছেমতো বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা নেই।

পরের দিন সকালে নাতনিকে নিয়ে পেছনের আঙিনায় গেলেন। সূর্যের আলোয় ঘাসের গা চকচক করছে। নাতনি উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘দাদু, হাউ নাইস দিস গ্রিন! ইউ ক্যান প্ল্যান্ট সাম ভেজিটেবল হেয়ার! কিন্তু তুমি কিছু লাগাও না কেন?’
রমেশ বাবু নরম গলায় বললেন, ‘কিছু লাগাতে হলে নিজের মাটি লাগে দাদু, নিজের মাটি!’
নাতনি কিছু বুঝল না, হাসিমুখে দৌড়ে গেল। রমেশ বাবু তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেনÑশুধু গাছ নয়, মানুষও শিকড় ছাড়া বড় হতে পারে না।

সেদিন বিকেলে তিনি হাঁটতে বের হলেন। কয়েক ব্লক দূরে একটি কমিউনিটি গার্ডেন আছে, যেখানে নানা জাতের ফুল, সবজি, ফল গাছ বেড়ে উঠছে। হঠাৎ চোখে পড়ল-এক কোণে তিনটি ছোট্ট লাউয়ের চারা। পাতাগুলো কচি সবুজ, হাওয়ায় দুলছে। চেনা অঙ্কুর, চেনা গন্ধ। বুঝতে কষ্ট হলো নাÑএগুলোই তার চারা।
গার্ডেনের বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করল কিন্তু পারলেন না। মনে হলো, এই চারাগুলোও তাকে চেনে, বুঝছেÑতাদের জন্ম যার হাতে, তিনি এখন কেবল এক দর্শক।

ফিরে আসতে আসতে বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত শূন্যতা জমে উঠল। জীবনের এত বছর কেটে গেছে, কত গাছ লাগিয়েছেন, কত মানুষকে বড় হতে দেখেছেন। অথচ আজ নিজেকে মনে হচ্ছে এক ভাসমান জীবন, যে নিজের মাটিতে ফিরতে পারে না, আর অন্যের মাটিতেও পুরোপুরি শেকড় গাড়তে পারে না।
সেই রাতে তিনি ডায়েরি খুললেন। লিখলেন :
‘আমার লাউয়ের চারাগুলো এখন অন্যের মাটিতে। তারা বড় হবে, ফুল দেবে, লাউ ধরবে কিন্তু আমি তাদের পাশে থাকব না। হয়তো আমিও তাই-জীবনের শেষ দিকে এসে অন্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, বড় হচ্ছি না, কেবল বেঁচে আছি।’

তারপর কলম থামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানালার বাইরে চাঁদ উঠেছে। লনের ঘাস নিখুঁত, সবুজ কিন্তু সেই সবুজে তার কোনো অংশ নেই। যেন জীবনও এমনইÑবাহ্যিক সৌন্দর্যের ভেতরে ভেতরে শিকড়হীনতার শূন্যতা লুকিয়ে থাকে। রমেশ বাবু জানেন, তিনি একদিন আবার অন্য রাজ্যে চলে যাবেন, অন্য ছেলের বাড়িতে। হয়তো নতুন গ্রীষ্ম আসবে, হয়তো আবার কোনো বীজ হাতে পাবেন। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তিনি কেবল অনুভব করছেন-তিনি সত্যিই এক আলগা শেকড়ের মানুষ...
 

কমেন্ট বক্স