বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এনওয়াইপিডি অফিসার, ডিটেকটিভ ফার্স্ট গ্রেড দিদারুল ইসলামের জানাজায় নিউইয়র্ক সিটির গভর্নর ক্যাথি হোকুল হিজাব পরে উপস্থিত হন। এ নিয়ে হোকুলকে কটাক্ষ করেন টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ। তার এই বিরূপ মন্তব্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক, সোশ্যাল মিডিয়া ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বইছে নিন্দার ঝড়। বিশেষ করে, নিউইয়র্ক, টেক্সাস চ্যাপ্টারসহ কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (ঈঅওজ) থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এ অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন সিনেটর ক্রুজ।
গত ৩১ জুলাই ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার জামে মসজিদে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে দিদারুল ইসলামের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর ক্যাথি হোকুল, মেয়র এরিক অ্যাডামস, সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো, মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি, এনওয়াইপিডি কমিশনার জেসিকা টিশসহ শহরের অসংখ্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও মুসলিম কমিউনিটির নেতারা। ইসলাম ধর্মের প্রতি সম্মান দেখিয়ে হোকুল এবং কমিশনার টিশ হিজাব পরে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এতে মুসলিম কমিউনিটির গভীর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা পান তারা। কিন্তু গভর্নর হোকুলের এই শিষ্টাচারমূলক আচরণকে ব্যঙ্গ করেন টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ। ঘটনার সূচনা এক অজ্ঞাত রক্ষণশীল এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ছবি পোস্টের মাধ্যমে। ছবিতে গভর্নর হোকুলকে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামসের পাশে একটি মসজিদে বসে থাকতে দেখা যায়। ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘Why in TF is the Governor of New York wearing a fcking hijab?’ সেই পোস্টকে রিপোস্ট করে টেড ক্রুজ লেখেন, ‘Um, wut?’, যা মূলত হোকুলের হিজাব পরার ওই ছবির প্রতিক্রিয়া। তার এই কটাক্ষভরা মন্তব্যকে ইসলামবিদ্বেষী ও মুসলিম সমাজকে অবমাননাকর বলে আখ্যায়িত করেছে CAIR।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর হোকুল ২ আগস্ট শনিবার রাতে তার এক্স অ্যাকাউন্টে সংক্ষিপ্ত অথচ দৃপ্ত ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘আমি হিজাব পরেছিলাম একজন মুসলিম শহীদ পুলিশ অফিসারের প্রতি সম্মান জানাতে। শোকাহত পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সভ্য সমাজে সাধারণ শিষ্টাচার-এটিই নেতা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।’
হোকুলের এই জবাব দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। অনেক ব্যবহারকারী ক্রুজের দ্বিচারিতা তুলে ধরে স্মরণ করিয়ে দেন, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি ব্রাইটন বিচের একটি ইহুদি ধর্মীয় স্থানে গিয়ে ইয়ামালকা পরেছিলেন, যা ধর্মীয় রীতি পালনের অংশ হিসেবেই করা হয়।
ঈঅওজ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সিনেটর টেড ক্রুজ যদি ন্যূনতম মানবিকতা ও সম্মানবোধ রাখেন, তবে তিনি গভর্নর হোকুল এবং শহীদ দিদারুল ইসলামের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবেন। তার বক্তব্য ইসলামবিদ্বেষ উসকে দেয় এবং হিজাবের বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব আরও স্পষ্ট করে।’ ঈঅওজ আরও মন্তব্য করেছে, ‘টেড ক্রুজ যখন ইহুদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান দেখিয়ে ইয়ামালকা পরেন, তখন তা প্রশংসনীয়; কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি একই সম্মান দেখানোয় তিনি বিদ্রূপ করেন, এটা দ্বিমুখী নীতি ও সরাসরি মুসলিম বিদ্বেষ।’
জানাজার দিন শহরের বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্রঙ্কস বরো প্রেসিডেন্ট ভ্যানেসা গিবসন, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ডারসেল ক্লার্ক, পাবলিক অ্যাডভোকেট জুমানে উইলিয়ামস, কংগ্রেসম্যান আদ্রিয়ানো এস্পাইল্যাট, কংগ্রেসম্যান রিচি টরেস, ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্র্যাগ এবং কাউন্সিলম্যান ড. ইউসুফ সালাম। জানাজায় বক্তৃতাকালে গভর্নর হোকুল বলেন, ‘আজকের দিনটি আমাদের হৃদয়ে দুঃখ ও ক্ষোভে ভরপুর। শহীদ দিদারুল ইসলামের পরিবার তাদের সন্তান, স্বামী, পিতাÑযার সঙ্গে আরও অনেক জন্মদিন, রাতের খাবার কিংবা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ভাগাভাগি করার স্বপ্ন দেখেছিল। এক উন্মাদ বন্দুকধারীর নির্মমতায় সেই স্বপ্ন আজ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিউইয়র্কাররা যেখানে সহানুভূতি, সম্মান ও সহনশীলতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, সেখানে টেড ক্রুজের মতো জাতীয় পর্যায়ের নেতার বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য শুধু অমানবিক নয়, এটি জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধে এক অশোভন আঘাত। তারা আরও বলেন, হোকুলের হিজাব পরার ঘটনা কেবল একজন শহীদ পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয় নয়; এটি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শোকের মুহূর্তে একতার নিদর্শন। এর বিপরীতে যারা ঘৃণা ও বিভেদ ছড়ানোর চেষ্টা করেন, তারা কেবল নিজেদের ক্ষুদ্রতা প্রদর্শন করেন।
দিদারুল ইসলামের মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক রাজ্য ও শহরের পক্ষ থেকে আবারও আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ওপর জাতীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিও জোরালোভাবে পুনরায় উত্থাপন করা হয়েছে।দিদারুল ইসলাম ব্রঙ্কসের ৪৭তম প্রিসিঙ্কটে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন দুই সন্তানের পিতা এবং তৃতীয় সন্তান আসন্ন। মেয়র অ্যাডামস তাকে ‘একজন সত্যিকারের নিউইয়র্কবাসী এবং বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
উল্লেখ্য, গত ২৮ জুলাই রাতে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের পার্ক অ্যাভিনিউতে একটি বহুতল ভবনে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় এক বন্দুকধারী। হামলাকারীকে থামাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল। ওই ঘটনায় আরও তিনজন নিহত হন। দিদারুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়। তিনি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন।