নশ্বর এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। এটাই ধ্রুব সত্য। জীবন নশ্বর কিন্তু তার কীর্তি অবিনশ্বর। এই অবিনশ্বর কর্মই মানুষকে অমরত্ব দান করে। তার মহৎ কর্মের অমন দ্যুতিতে মানুষের হৃদয়ে তিনি চির ভাস্বর হয়ে থাকেন। গত ২৮ জুলাই মিড টাউন ম্যানহাটনের একটি ভবনে কর্মরত অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে এ ওয়াই পিডি অফিসার দিদারুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করলেও সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সাহসিকতা আর বীরের প্রতীক হয়ে। থাকবেন মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়।
তার মৃত্যুতে আমরা যেমন শোকাহত হয়েছি, তেমনি বাঙালি জাতি হিসেবে তিনি আমাদের করেছেন গর্বিত। পলিশ অফিসার দিদারুল ইসলাম নিজের প্রাণ দিয়ে অন্যদের জীবন বাঁচিয়ে গেছেন। তার এই মহান আত্মত্যাগের কারণে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। পুলিশ অফিসার থেকে তাকে মরণোত্তর পদোন্নতি দেওয়া হয় প্রথম গ্রেডের ডিটেকটিভ হিসাবে। আর তাই তো এই মহান বীরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এসেছেন নগর পিতা এরিক এডমস, নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর, প্রাক্তন গভর্নর পুলিশ কমিশনার, আসন্ন মেয়র পদপ্রার্থী জোহরাান মামদানিসহ, সরকারি উচ্চপর্যায়ের নেতারা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ, নিউইর্য়কের বাঙালি কমিউনিটির নেতারা সাধারণ মানুষ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়তমা স্ত্রী, সন্তান, পিতামাতা আর দিদারুল ইসলামের সতীর্থ নীল ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ বাহিনীর প্রায় ২০ হাজার সদস্য। ব্যস্ত নিউইয়র্ক নগরীর ব্যস্ত বরো ব্রঙ্কস মূলত সেদিন অচল হয়ে গিয়েছিল তার শেষ বিদায়ের দিন ২৯ জুলাই। ২৮ জুলাই সন্ধ্যা হতেই পার্কচেস্টার জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় কারপার্কিং নিষিদ্ধ করা হয়। আশপাশের এলাকাজুড়ে নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা।
যানজট এরাতে ২৯ জুলাই সকাল থেকেই সবাই দিদারুল ইসলমের শেষ বিদায়ে অংশ নিতে পার্ক চেষ্টার জামে মসজিদে আসে। বাদ জোহর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গার্ড অব অর্নার দেওয়া হয়। রোদেলা দুপুরে পতাকায় মুড়ানো দিদারুল ইসলামের কফিন কাঁধে তার সতীর্থরা। কেউ শেতাঙ্গ, কেউ কৃষ্ণাঙ্গ ল্যাটিনো কিংবা বাঙালি। যে ইসলাম ধর্ম নিয়ে আমেরিকার কিছু মানুষের মধ্যে ফোবিয়া কাজ করে, সেই ধর্মের দিদারুল ইসলামের কফিন কাঁধে নিয়ে চলেছেন। ইহুদি খ্রিস্টান, মুসলিমসহ অন্য ধর্মালম্বীরা। এটাই আমেরিকা, এমনটিই হওয়া উচিত, দ্য গ্রেট আমেরিকা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাঁধে চড়ে তার শেষ বিদায়। পেছনে দেখা যায় আসন্ন সন্তান সম্ভাব্য প্রিয়তমা ক্রন্দনরত স্ত্রী, নাবালক সন্তান, আত্মীয়স্বজনদের।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অর্নার দেওয়ার সময় যখন বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে তখনই দেখা যায় এক অভাবনীয় দৃশ্যের। রোদেলা দুপুর হয়ে যায় বৃষ্টিভেজা। আর সারি সারি নীল ইউনিফর্মের পুলিশ বাহিনী বৃষ্টিতে ভিজে তাদের প্রিয় এই সতীর্থকে, এই মহান বীরকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। সাধারণত নাটক সিনেমাতে এমন দৃশ্য দেখা যেতে পারে; কিন্তু বাস্তবে এমনটা দেখা যায় না। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এই মহান বীরের মৃত্যুতে প্রকৃতি যেন শোকাভূত, অশ্রুসিক্ত।
যে বীরের মৃত্যুতে প্রকৃতিও কেঁদে ওঠে। সুপ্রিয় পাঠক, আপনাদের হয়তো মনে আছে ২০১৪ সলে ‘ব্রঙ্কস থেকে বলছি’ শিরোনামে ধারাবাহিক কলাম সাপ্তাহিক ঠিকানায় নিয়মিত লিখতাম। সেখানে আমি মূলত ব্রঙ্কসে বাঙালিদের উত্থান নিয়ে লিখতাম। পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলাম ছিলেন এই ব্রঙ্কসেরই বাসিন্দা। তার শেষ বিদায়ের দিন জানাজার আগে পার্কচেস্টার জামে মসজিদে সিটি মেয়র পুলিশ কমিশনার এবং গভর্নরসহ আরও কিছু বিশিষ্টজন বক্তব্য রাখেন। কিন্তু সবার বক্তব্যকে ছাপিয়ে আমার দৃষ্টি কেড়েছে পার্কচেস্টার জামে মসজিদের ইমাম, এ প্রজন্মের সন্তান, ব্রঙ্কসে বেড়ে ওঠা জাকিরের বক্তব্য। উচ্চশিক্ষিত ইমাম জাকি বিশুদ্ধ ইংরেজিতে একজন সাধরণ মানুষ হিসেবে দিদারুল ইসলামের মানবিক গুণাবলীগুলো পাশাপাশি ইসলামের মর্মবাণী এবং গাজায় মুসলিমদের উপর যে গণহত্যা এবং অত্যাচার হচ্ছেÑ সেই বিষয়টিও সাহসকিতার সাথে তুলে ধরেন। এমন সব সরকারি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সামনে এমন সাহসী বক্তব্য ক’জন দিতে পারে? এই সাহসী ইমামের জন্যও রইল শ্রদ্ধা। মূলধারার সব ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামের এই বীরত্বগাথা ফলাও করে প্রচার করেছে। যতবার দিদারুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হয়েছে, ততবারই উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। তার মৃত্যুতে আমাদের চোখে যেমন অশ্রু ঝড়েছে, তেমনি জাতি হিসেবে আমরা হয়েছি গর্বিত। রাজনৈতিক সংঘাত, আর রুচির দুর্ভিক্ষে জর্জরিত বাংলাদেশ নিয়ে আমরা যখন চরম উদ্বিগ্ন, তখন দিদারুল ইসলামের মতো সাহসী বীরের জন্য প্রবাসে জাতি হিসাবে আমরা হই গর্বিত। দিদারুল ইসলাম, আমাদের পরম করুণাময় যেন তোমাকে জান্নাতবাসী করেন। আর তোমার পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দান করেন।
লেখক : সাংবাদিক।