Thikana News
০৮ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০৮ অগাস্ট ২০২৫

অভিশপ্ত আয়নাঘর-সদৃশ আর কোনো গোপন টর্চার সেল যেন তৈরি হতে না পারে

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে ‘বিশেষ’ স্থানে রাখা হতো। এ নিয়ে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এসব স্থান ‘আয়নাঘর’ নামে প্রকাশ্যে আসে। সে সময় আয়নাঘরকে কাল্পনিক আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের জড়িত ব্যক্তিরা নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
অভিশপ্ত আয়নাঘর-সদৃশ আর কোনো গোপন টর্চার সেল যেন তৈরি হতে না পারে
অভিশপ্ত আয়নাঘর বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজও রহস্যঘেরা এক আতঙ্কের নাম, যা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকার পরিচালিত একটি নৃশংসতার ছদ্মনাম। ২০০৯ সালে হাসিনা সরকার কর্তৃক নির্মিত এই আয়নাঘরে মূলত ভিন্নমতের নিরীহ মানুষদের গুম করে তাদের ওপর পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। আয়নাঘর ডিজিএফআই, র‍্যাব ও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত ছিল। যার প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে ‘বিশেষ’ স্থানে রাখা হতো। এ নিয়ে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এসব স্থান ‘আয়নাঘর’ নামে প্রকাশ্যে আসে। সে সময় আয়নাঘরকে কাল্পনিক আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের জড়িত ব্যক্তিরা নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরবর্তী সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর আয়নাঘর থেকে ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় তাদের বয়ানে উঠে আসে আয়নাঘরের নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা।

আমরা সবাই জানি, আয়না মানে আয়না বা প্রতিবিম্ব, ঘর মানে তো ঘর, কক্ষ, বাসস্থান। এই দুটি শব্দ একত্রিত হয়ে ‘আয়নাঘর’ শব্দটি তৈরি হয়েছে, যা একটি গোপন স্থান বা কক্ষকে বোঝায়। যেখানে ভেতরের অবস্থা বাইরে থেকে দেখা যায় না। যেহেতু এটি একটি গোপন স্থান, তাই এর ভেতরের কার্যকলাপ বাইরে থেকে দেখা যায় না, যেমন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, কিন্তু বাইরের জগৎ দেখা যায় না।
আয়নার মতো এই ঘরটিও সবকিছু প্রতিফলিত করে, তবে শুধু যারা এর ভেতরে থাকে তাদের কার্যকলাপ। সুতরাং ‘আয়নাঘর’ শব্দটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা একটি গোপন স্থান বা কক্ষকে নির্দেশ করে। এটি একটি রহস্যঘেরা আতঙ্কের নাম। আয়নাঘরে বন্দী এবং তাদের পরিবারকেও গোলকধাঁধায় রাখা হতো। আয়নাঘরে বন্দী নিজেও জানতেন না তিনি কোথায় আছেন, তার পরিবার তো নয়-ই।
নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের গুম হওয়ার রোমহর্ষক কাহিনি। গুম হওয়া সেই সব মানুষকে রাখা হয় রাষ্ট্রশাসক পরিচালিত ৫ ফুট বাই ১০ ফুটের একটি নির্দিষ্ট ঘরে। আলোহীন সেই ঘরটি পুরু দেয়াল ও লোহার গরাদে গড়া। এ যেন জর্জ অরওয়েলের কল্পিত সেই ‘বিগ ব্রাদারের’ বাস্তবিক ঘর। রূপক অর্থে গোলকধাঁধাকে দেখাতেই ওই প্রতিবেদনটির নামকরণ ‘আয়নাঘর’ রাখা হয় বলে অনুমেয়। কারণ বাস্তবের আয়নাঘরে একটি বিভ্রমের ভেতর দিয়ে দিন পার করেন বন্দীরা। তাদের চোখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় যাবতীয় স্বপ্ন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘আয়নাঘর’ শব্দটি আজ বাংলার মানুষের কাছে রাষ্ট্রীয় দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক হয়ে উঠেছে; যেভাবে ‘বিগ ব্রাদার’ শব্দটি বিবর্তিত হয়েছে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে ব্রিটেনের গণমাধ্যমে।

কোনো কোনো বন্দীর ভাষ্যমতে, গুমের উদ্দেশ্যে তুলে আনা বন্দীদের এমন এক ঘরে রাখা হতো, যার চারপাশের দেয়ালে ছিল শুধু আয়না। কোনো জানালা থাকত না, বাইরের দুনিয়ার কোনো দৃশ্য দেখা যেত না। ঘরটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো ভয়ংকর আলোর মাধ্যমে-কখনো অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া হতো, আবার কখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার করে ফেলা হতো। বন্দীদের চোখ বাঁধা অবস্থায় সেখানে আনা হতো। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে দেওয়া হতো, যাতে তারা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যায়।
আয়নাঘর থেকে ভাগ্যক্রমে ফিরে আসা বন্দীদের ভাষ্যমতে :
১. প্রচণ্ড ঠান্ডা বা অসহনীয় গরমের মধ্যে রাখা হতো,
২. টানা কয়েক দিন না ঘুমোতে দেওয়া হতো,
৩. নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দেওয়া হতো,
৪. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আত্মসম্মানবোধ ধ্বংস করা হতো,
৫. কানের কাছে উচ্চশব্দ বাজিয়ে রাখা হতো, যাতে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়,
৬. পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হতো,
৭. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বন্দীকে নিজেকেই মারতে বাধ্য করা হতো।
এই নির্যাতন এতটাই ভয়ংকর ছিল যে অনেকে কয়েক দিনের মধ্যেই দিশেহারা হয়ে যেত। তারা ভুলে যেত, তারা কোথায় আছে, কত দিন ধরে বন্দী, এমনকি নিজের নামও মনে করতে পারত না।
এই নির্যাতন ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। কাউকে হত্যা না করেও তাকে জীবন্মৃত করে রাখা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। আয়নাঘরে গুমের শিকার বন্দীদের মানসিকভাবে ধ্বংস করার জন্য যেসব কৌশল ব্যবহার করা হতো :
১. মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা : বন্দীদের বলা হতো, তাদের পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
২. আয়নার মাধ্যমে বিভ্রম সৃষ্টি করা : বিশেষ আলোর সাহায্যে আয়নায় এমন প্রতিচ্ছবি দেখানো হতো, যাতে মনে হতো বন্দীর শরীর বিকৃত হয়ে গেছে।
৩. সময় ও বাস্তবতার অনুভূতি ধ্বংস করা : বন্দীরা কত দিন ধরে বন্দী, সেটি বোঝার কোনো উপায় রাখত না। কখনো দিনের বেলা রাতের পরিবেশ তৈরি করা হতো, আবার কখনো রাতেও কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে রাখা হতো।
আয়নাঘর মূলত তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছিল : (ক) প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা (খ) স্বাধীন গণমাধ্যমকে ধ্বংস করা (গ) একটি ভীতসন্ত্রস্ত প্রজন্ম তৈরি করা।
আয়না ঘর ও গুমের রহস্য সামনে আসার পর মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতে শুরু করল, কারণ তারা জানত এর মূল্য কী হতে পারে। সত্য প্রকাশ করলেই গুম হওয়ার ভয় ছিল। ফলে দেশের অধিকাংশ মিডিয়া একসময় সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হলো। নতুন প্রজন্ম ও তরুণদের শেখানো হলোসত্য বললে, প্রতিবাদ করলে তাদের পরিণতি হবে আয়নাঘরের বন্দীদের মতো। আয়নাঘর ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের এক ভয়ংকর নিপীড়নযন্ত্র। এটি শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ছিল নির্মম মানসিক নিপীড়নের কেন্দ্র। বাংলাদেশে কতগুলো আয়নাঘর ছিল?

অনেকের ধারণা, বিমানবন্দরের কাছে ঢাকা সেনানিবাসে তৈরি ভবনে ১৬টি রুমে ৩০ জন করে মোট ৪৮০ জন বন্দীর টর্চার সেলই একমাত্র আয়নাঘর। না, মোটেও তা নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ৮০০টির মতো আয়নাঘরের সন্ধান পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
আয়নাঘরে বন্দীর সংখ্যা : গত ২৬ জুলাই ২০২৫ রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে আয়োজিত এক সভায় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, গুমের পর আয়নাঘরে বন্দী করে রাখা ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১০৩০ জনকে একাই ক্রসফায়ার করে হত্যা করেছে হাসিনার আমলে এক বাহিনীর সদস্য। বর্তমানে সে গ্রেফতার রয়েছে। এতেই অনুমেয় হয়, বাংলাদেশে কত হাজার মানুষ আয়নাঘর নামক নরকে বন্দী ছিল। আয়নাঘরে মূলত বিরোধী দলের নেতাকর্মী, জামায়াত-শিবির, প্রখ্যাত ইসলামি বক্তা ও সাংবাদিকদের রাখা হতো। অর্থাৎ যাদের আন্দোলন-সংগ্রাম, বক্তব্য ও লেখা সরকারের বিরুদ্ধে যেত, তাদেরকেই গুম করে আয়নাঘরে রাখা হতো। ২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর, ২০০৯ সাল থেকে তার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়নাঘর থেকে খুব কম বন্দী মুক্তি পেয়েছেন। তবে কিছু বন্দীকে দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়। অনেকেই আবার এনকাউন্টারের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে এ-জাতীয় ঘটনার তদন্ত প্রায় হয়নি বললেই চলে। আয়নাঘরে রাখা অনেকেই দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মারা যান। তারপর লাশ সরিয়ে দেওয়া হয়। যাদের গ্রেফতার করা হয়, তাদের খাতা-কলমে কোনো তথ্য রাখা হয় না। আর যারা হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন, তারাই আয়নাঘরের দায়িত্ব পেতেন। আয়নাঘরের বন্দীদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করা বা যোগাযোগেরও কোনো সুযোগ বা আইনই ছিল না। আয়নাঘরে বন্দী ব্যক্তির শোকে কাতর পরিবারের সদস্যরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর থানা পুলিশ, কোর্টের বারান্দায় ঘুরে ক্লান্ত হয়ে আশা ছেড়ে দিতেন। একপর্যায়ে কোনো কোনো বন্দীর পরিবারের সদস্য (পিতা, মাতা, স্ত্রী) শোকে মারা যেতেন। আবার বন্দিদশা থেকে বের হয়ে পরিবারের সদস্যকে আর দেখার সুযোগ হয়নি কোনো কোনো বন্দীর। এমনও বন্দী সম্পর্কে জেনেছি, যিনি আয়নাঘরে গুম হওয়ার আগে স্ত্রীর গর্ভে রেখে যাওয়া সন্তানকে ফিরে এসে সাবালক দেখেছেন। আয়নাঘর যে কত জঘন্যতম নৃশংসতার ছদ্মনাম, তা কেবল ভুক্তভোগী আর তার পরিবারই জানে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকবে, এমন একটি আইন প্রণয়ন করুন, যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে আয়নাঘর-সদৃশ আর কোনো গোপন বন্দিশালা/টর্চার সেল তৈরি হতে না পারে। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যতীত অন্য কোনো সরকার এ আইন পাস করবে না। সুতরাং এ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব আইন প্রণয়নের পাশাপাশি এ বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।
 

কমেন্ট বক্স