Thikana News
০১ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫
বিচারপতি খায়রুল হকের খেয়ালি রায়

কলমের এক খোঁচায় গণতন্ত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

এই রায় কেবল বিরোধী মতকে কোণঠাসা করেনি, গণতন্ত্রের শেকড়েই আঘাত হেনেছে। বিচারপতির কলমের সেই একক খোঁচায় জন্ম নেয় যে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূঢ় বাস্তবতা, তা আজ যেন উল্টো অস্ত্র হয়ে ফিরে এসেছে তাঁরই পৃষ্ঠপোষ্য রাজনৈতিক শক্তির বুকে। ফলাফল- বিশ্ব রাজনীতির প্রাচীনতম দলগুলোর একটি আজ ছিন্নমূল, তার নেতৃত্ব দেশান্তরে, শরণার্থীর জীবনে, রাষ্ট্রবিহীন বাস্তবতায়।
কলমের এক খোঁচায় গণতন্ত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া একযোগে পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়ে সবকটিতেই বিজয় অর্জন করেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করে এবং তিনি দেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ক্ষমতায় এসেই তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন- যা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন।

তবে একটি উপ-নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগকে কেন্দ্র করে ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক দলসমূহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি চালায়। এতে দেশ এক ভয়াবহ অচলাবস্থার মুখে পড়ে। প্রায় ১৭৩ দিনব্যাপী হরতাল-অবরোধসহ আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমে নেমে আসে বিপর্যয়। এ সময়কালে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। নিহত হন প্রায় ৬০ জন, আহত হন সহস্রাধিক মানুষ। উৎপাদন, রপ্তানি, শিক্ষা, যোগাযোগসহ কোটি কোটি মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রে এর প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এই সংকট উত্তরণে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বেগম খালেদা জিয়া সরকারের মেয়াদপূর্তির আগেই সংসদ বিলুপ্তির ঘোষণা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেন। তবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী সংসদ (মাত্র ১২ কার্যদিবস)। এই সংসদের একজন কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি ঐতিহাসিক ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রস্তাব ও প্রণয়নে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করি।
বেগম খালেদা জিয়ার দ্বাদশ সংশোধনী ছাড়াও আরও একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রচলন হয়, যার অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকদের মতে এই নির্বাচনগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ এবং আস্থা অর্জন করে। ফলে জনগণের মধ্যে প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতি নতুন করে বিশ্বাস ও আস্থার জন্ম নেয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু ইতিহাসের চরম পরিহাস- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত যে আন্দোলনের মাধ্যমে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্জিত হয়, সেই দলই ক্ষমতায় এসে অনুগত দাসানুদাস ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতির আসনে বসিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হীনস্বার্থে ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি বদলে দেয়? জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদে পাস হওয়া আইন ‘অ-বিবেচক’খায়রুল হক ২০১১ সালের ১০ মে এক কলমের খোঁচায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেন। কথিত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ চার বিচারকের মতের ভিত্তিতে রায় দেন- ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক!যুক্তি ছিল, এটি জনগণের ভোটাধিকারকে খর্ব করে।
তাঁর এই যুক্তিহীন রায় দেশের রাজনৈতিক মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বরং একটি ঘন কালো অন্ধকার পথে পুরো জাতিকে ধাবিত করে। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে সরকারকে ফ্যাসিস্ট হতে সহায়তা করে। এই রায়ই এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে পরবর্তী একতরফা নির্বাচনগুলোর পথপ্রসস্তকারী। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটারবিহীন একচ্ছত্র নির্বাচনের মাধ্যমে বারবার ক্ষমতায় আসে। বিরোধীদলগুলো অভিযোগ করে- বিচারপতি খায়রুল হকের ওই রায়ের মাধ্যমেই বহুদলীয় গণতন্ত্রকে একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে।

রায় নিয়ে রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজে বিতর্ক আরও তীব্র হয়, যখন জানা যায়, রায় ঘোষণার পর মূল কপিতে জালিয়াতির মাধ্যমে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রীয় নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যা ছিল গর্হিত অপরাধ।

খায়রুল হকের এই অনৈতিক রায়ের ফলে গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে। বাস্তবতায় তা প্রতিহিংসা, ভয় ও কর্তৃত্ববাদে রূপ নিয়েছে। প্রশাসন ও রাজনীতিতে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্য মূল্যায়িত হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থার ভাঙন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় দমননীতি ও বিরোধী দলের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়নে দেশ ও রাজনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

এই সময়কালে বিরোধী পক্ষকে অহরহ গুম, গ্রেপ্তার, হয়রানি ও কোণঠাসা করার মাধ্যমে শত শত উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন। সে সময় মেধা নয়, চাটুকারিতা ও অন্ধ আনুগত্যই যেন হয়ে ওঠে সমাজ প্রগতির মানদণ্ড।
ফলে স্বচ্ছ রাজনীতিক ছাড়াও তরুণরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়েছে, সমাজে জন্ম নিয়েছে হতাশা, নৈরাজ্য ও নৈতিক অবক্ষয়। গণতন্ত্র কেবল সংবিধানের কাঠামোতে টিকে থাকে, চর্চায় নয়।

গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে রাজনৈতিক দমননীতি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন, মতপ্রকাশের অধিকার সংকোচন এবং দলীয়করণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এক চরম সংকটে ফেলে দেয়।

এর কুপ্রভাব পড়েছে সাধারণ জনমনেও। মানুষ আতঙ্কে নিশ্চুপ, তরুণ প্রজন্ম হতাশায় রাজনীতি বিমুখ। সমাজে বিভাজন, নৈতিকতার মান হ্রাস ও ইতিহাস বিকৃতির মতো বিষবৃক্ষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

অবশেষে ২৪ এর আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই, ডিবি পুলিশ ধানমন্ডি থেকে বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রায় পরিবর্তনের অভিযোগে শাহবাগ, ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।

এই গ্রেপ্তার কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই নয়, বরং একটি প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাস, একটি বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা এবং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রশ্নকে সামনে এনে দিয়েছে। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, এমনকি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও।

শেষ প্রশ্নটি থেকেই যায়: বিচারপতি খায়রুল হকের সেই রায় ইতিহাসের প্রয়োজন ছিল, নাকি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও মতের উপকারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেওয়া সিদ্ধান্ত? এই প্রশ্নের উত্তর মেলে ২০২৪ এর আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। তবে এই বিতর্ক জাতিকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘একটি কলম অনেক সময় একটি ভোটের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে’।

উল্লেখ্য, ১৯৯৪-১৯৯৬ সালের আন্দোলনটি ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি এবং অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক সংঘাত। এই আন্দোলনের চরম মূল্য দিতে হয়েছে দেশের জনগণকে- অর্থনীতির বিপর্যয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার ভাঙন, এবং শতাধিক প্রাণের বিনিময়ে। এই যে ত্যাগ ও সংকটের মধ্য দিয়ে অর্জিত ত্রয়োদশ সংশোধনী অর্থাৎ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদের অনুমোদিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা- তাতে এক কলমের খোঁচায় এক ভয়াবহ স্বার্থপরতার দৃষ্টান্ত রেখে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক।
বিচারপতি খায়রুল হকের সেই রায় এখন ইতিহাসের গাঁথা থাকা এক অনারোগ্য ক্ষত। প্রশ্ন জাগে, তিনি কি আসলেই ন্যায়বিচারের আসনে ছিলেন, নাকি বিচারবস্ত্রের আড়ালে এক পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক রণকৌশল বাস্তবায়নে নিয়োজিত হয়েছিলেন? যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল শতাধিক প্রাণের বিনিময়ে, হাজারো তরুণের রক্ত, লক্ষ মানুষের শারীরিক পঙ্গুত্ব ও মানসিক বিপর্যয়, এবং প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় ক্ষতির ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে- তার মৃত্যুপরোয়ানা কি সত্যিই শুধুই আইনগত ছিল, নাকি ছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধের এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র?

এই রায় কেবল বিরোধী মতকে কোণঠাসা করেনি, গণতন্ত্রের শেকড়েই আঘাত হেনেছে। বিচারপতির কলমের সেই এক খোঁচায় জন্ম নেয় যে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূঢ় বাস্তবতা, তা আজ যেন উল্টো অস্ত্র হয়ে ফিরে এসেছে তাঁরই পৃষ্ঠপোষ্য রাজনৈতিক শক্তির বুকে। ফলাফল- বিশ্ব রাজনীতির প্রাচীনতম দলগুলোর একটি আজ ছিন্নমূল, তার নেতৃত্ব দেশান্তরে, শরণার্থীর জীবনে, রাষ্ট্রবিহীন বাস্তবতায়।

তাইতো বলি, ৩৬ জুলাই কোনো ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়- এটি একটি প্রতীক, একটি প্রতিবাদ, একটি প্রতিরোধ। এটি সেই মুহূর্ত, যখন ছাত্র-জনতার মিলিত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল- মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সাহসের, এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণচেতনার জাগরণ।

সরকারি মঞ্চ থেকে যখন বাস্তবতা অস্বীকার করা হয়, তখন ‘৩৬ জুলাই’হয়ে ওঠে অনিবার্য প্রতিবাদের ভাষা। এটি কেবল একদিন নয়, বরং সেই সংগ্রামী চেতনার নাম- যা ফ্যাসিবাদের চিরস্থায়ী অবসান ঘটাতে প্রস্তুত একটি প্রজন্মের ঘোষণা।
৩৬ জুলাই এখন আর ইতিহাস নয়, বরং এক চলমান প্রতিরোধের নাম।
 

কমেন্ট বক্স