Thikana News
০১ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’

সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বহুল বিতর্কিত ও আলোচিত কর ও ব্যয়সংক্রান্ত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ পাস ও তা আইনে পরিগণিত হওয়ার পূর্বাপর ঘটনাক্রম দেখে উপরে বর্ণিত জরিপটির কথা মনে পড়ল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’
এই মুহূর্তে কয়েক বছর পূর্বে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত একটি জরিপের কথা মনে পড়ছে। ওই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, অধিকাংশ মার্কিনি বিত্তবানদের প্রশংসা করলেও তাদেরকে তারা খুব একটা পছন্দ করেন না। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিত্তবানদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন এবং তাদেরকে তারা কঠোর পরিশ্রমী ও চৌকস বলেও বিবেচনা করেন। সেই সঙ্গে তারা এটাও মনে করেন, বিত্তবানদের অনেকে লোভী ও অসৎ প্রকৃতির মানুষ এবং তারা খুব কম পরিমাণ করছেন। প্রতি ১০ জনের ছয়জন মার্কিনির ধারণা, রিপাবলিকানরা বিত্তবানদের প্রতি পক্ষপাতপুষ্ট। জরিপে বিত্তবানদের প্রতি মার্কিনিদের মধ্যে বিদ্যমান অনুভূতির পাশাপাশি রিপাবলিকানদের প্রতি তাদের মনোভাব সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যায়।
সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বহুল বিতর্কিত ও আলোচিত কর ও ব্যয়সংক্রান্ত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ পাস ও তা আইনে পরিগণিত হওয়ার পূর্বাপর ঘটনাক্রম দেখে উপরে বর্ণিত জরিপটির কথা মনে পড়ল।

মার্কিন কংগ্রেসের সিনেটে বিলটির পক্ষে-বিপক্ষে সমান সমান (৫০-৫০) ভোট পড়লে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের টাইব্রেকিং ভোটে বিলটি পাস হয়। কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর, যেমন র‌্যান্ডপল, থমটিলিস ও সুজান কলিন্স বিলের বিপক্ষে ভোট দেন। সিনেটে পাসকৃত বিলটি হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে বিবেচনা ও পাসের জন্য সিনেটের অনুরূপ কয়েকজন রিপাবলিকান সদস্য বিলটি পাসের পক্ষে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানান। দুই দিন ধরে স্পিকার মাইক জনসনও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেন-দরবারের পর বিদ্রোহী সদস্যদের মধ্যে দুজন বাদে অন্যরা বিলের পক্ষে ভোট দিতে সম্মত হলে বিলটি ২১৮-২১৪ ভোটে পাস হয়। সব ডেমোক্র্যাট সদস্য (২১২ জন) এবং দুজন রিপাবলিকান সদস্য বিলের বিপক্ষে ভোট দেন। সিনেট ও হাউসের বিদ্রোহী রিপাবলিকান সদস্যরা আরও কিছু বিষয়ের মধ্যে এই বিল ব্যয় সংকোচনের পরিবর্তে ব্যয় ও রাষ্ট্রীয় দেনার পরিমাণ বৃদ্ধি ও মেডিকেইড বাজেট হ্রাসের ফলে বহু দরিদ্র মার্কিনি দুর্ভোগের শিকার হবেন বলে অভিযোগ করে বিলের পক্ষে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেনার পরিমাণ প্রায় ৩৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তথ্যমতে, নতুন বিল এই দেনায় অতিরিক্ত প্রায় ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে। নতুন বিলে প্রতিরক্ষা বাজেটে অতিরিক্ত ১৫০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়। প্রতিরক্ষা খাতে বর্তমান বার্ষিক বাজেট কমবেশি ৮৪১ বিলিয়ন ডলার। এই খাতে বাজেট বৃদ্ধি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করা ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে নতুন অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘গোল্ডেন ডোম’ (Golden Dome) নির্মাণে সহায়ক হবে। তা ছাড়া ইমিগ্রেশন (সীমান্ত দেয়াল নির্মাণ) ও অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের বিতাড়ন, তাদের জন্য ডিটেনশন সেন্টার নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত ১০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়। পূর্বে ইমিগ্রেশন খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। মেডিকেইড ও ফুড স্টাম্প খাতে বরাদ্দ হ্রাস করে প্রতিরক্ষা ও ইমিগ্রেশন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় আংশিকভাবে মেটানো হবে।
তথাকথিত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিলে’র দু-একটি উল্লেখযোগ্য দিক নিম্নরূপ। ক. এই মেগা বিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০১৭ সালের কর রেয়াত সুবিধা, যা এ বছরের শেষ নাগাদ সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল, সেই সুবিধাকে স্থায়ীভাবে চালু রাখবে। রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ডিডাকশন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই বিল প্রধানত বিত্তবান ব্যক্তির বড় বড় করপোরেশনের কর হ্রাস করবে, যা অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারে সহায়ক হবে বলে দাবি করা হয়।

খ. মেডিকেইড ও ফুড স্টাম্প প্রাপ্তির নিয়মকানুন (Eligibility) কঠিনতর করার ফলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র ও অভাবী মার্কিনিকে এসব কর্মসূচির সুবিধা পেতে বেগ পেতে হবে এবং ইতিমধ্যে এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত বহু মানুষ এসব কর্মসূচি থেকে ছিটকে পড়বে। তথ্যমতে, প্রায় সাড়ে চার কোটি মার্কিনি খাদ্যসহায়তার জন্য ফুড স্টাম্পের ওপর নির্ভরশীল। মেডিকেইড খাতে বাজেট হ্রাসের ফলে প্রায় ১২ মিলিয়ন মার্কিনি চিকিৎসা-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। বহু হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে চিকিৎসা গ্রহণকারীদের অধিকাংশই মেডিকেইড সুবিধাভোগী। এই খাতে বাজেট হ্রাসের ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হওয়াসহ এসব হাসপাতাল ও নার্সিং হোম ব্যাপক আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করেন। গরিবের পেটে লাথি মেরে বিত্তবানদের তোষণের কথা ভেবেই সম্ভবত পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে রিপাবলিকানদের সম্পর্কে মার্কিনিদের মিশ্র মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

গ. এই বিলে কর্মজীবী মার্কিনিদের বকশিশ বা টিপস ও ওভারটাইমের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের ওপর কর প্রত্যাহারসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে কর রেয়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র বর্তমানে অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ধরপাকড়ে ব্যাপক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। নতুন বিলে ইমিগ্রেশন খাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ এই তৎপরতাকে আরও বেগবান করবে বলে মনে করা হচ্ছে। সাধারণভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন নীতির প্রতি অধিকাংশ মার্কিনির সমর্থন থাকলেও কর্মস্থল এমনকি নিজেদের বাসাবাড়িতে রাতবিরাতে হানা দিয়ে যে প্রক্রিয়ায় ইমিগ্র্যান্টদের ধরপাকড় করা হচ্ছে, তা নিয়ে বহু মার্কিনির মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। কে বৈধ বা কে অবৈধ, সেটা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া প্রশ্নাতীত নয়। অনেক ক্ষেত্রে কেবল গোত্র, বর্ণ ও ইংরেজি বলার ধরন দেখে মানুষকে ধরে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ শোনা যায়। প্রধানত অশ্বেতাঙ্গ ও হিসপানিক নাগরিকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি মহান গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের এভাবে হয়রানির শিকার হওয়া মোটেই স্বাভাবিক ও কাম্য নয় বলে বহু মহল মনে করেন।
১৩ জুন ইরানের পরমাণু ও সামরিক স্থাপনায় হামলা করে যুদ্ধের সূচনা করে ইসরায়েল। হামলার জবাবে ইরানও ইসরায়েলে মিসাইল ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালায়। ইসরায়েলের তথাকথিত দুর্ভেদ্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ ইরানের মিসাইল ও ড্রোন হামলাকে শতভাগ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরও নিখুঁত ও শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বহু আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা করছিল। সেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার জন্য গোল্ডেন ডোম (Golden Dome) নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২২ জুন ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে বাংকার বাস্টার বোমা ফেলে সেগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র, যদিও সে দাবির সত্যতা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।

ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে কেউ কেউ ইসরায়েলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি হামলা বলে মনে করেন। ২৩ জুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের অবসান হয়।

ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক নিয়মের বরখেলাপ হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাম্প্রতিক সময়ে পাক-ভারত যুদ্ধ, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ, কঙ্গো-রুয়ান্ডার যুদ্ধ বন্ধ ও গাজায় যুদ্ধবিরতি স্থাপনে স্বীয় ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ তার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির পক্ষে মত দিয়েছেন। এ বছরের ১০ অক্টোবর নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণার কথা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই পুরস্কার পেলে তা শান্তির প্রতি একপ্রকার পরিহাসতুল্য বিবেচিত হওয়া ছাড়াও তা এই পুরস্কারের মর্যাদাকেও বহুলাংশে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে অনেকে মনে করেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ তার ও তার দলের জন্য কতটা ভালো বা মন্দ হবে-সেটা দেখার জন্য আমাদেরকে আগামী বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় মধ্যবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
 

কমেন্ট বক্স