Thikana News
০২ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫

একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-১১

(প্রসঙ্গ নারীর ভূমিকা-২)
একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-১১
৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের অনুরূপ পেশার কারণে নারী শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সীমিত থাকলেও নৈতিক সমর্থন ছিল প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ। আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ মানববন্ধন, বিবৃতি, সাক্ষাৎকার, লেখনী ইত্যাদির মাধ্যমে এরূপ সমর্থন জুগিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষককে মূলধারার মিছিলে থেকে সমাবেশে বক্তৃতা দিতে দেখা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল (বর্তমানে আইন উপদেষ্টা), ওবায়দুল ইসলাম, কামরুল হাসান মামুন, ছিদ্দিকুর রহমান খান, তানজীমউদ্দীন আহমদ, জাবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) আনু মুহাম্মদ, গোলাম রব্বানী, বুয়েটের মুসলেউদ্দিন হাসান, ব্র্যাকের প্রফেসর ইমেরিটাস মনজুর আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে নারী শিক্ষকগণও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনজুড়ে ব্যক্তিগতভাবে অথবা দলগত ও সংগঠনগতভাবে যাদের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন অধ্যাপক সামিনা লুতফা, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক সায়মা ফেরদৌস প্রমুখ। তারা ঢাবিতে অধ্যাপনা করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত শিক্ষক হিসেবে বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও চেয়ারম্যান শামীমা সুলতানা, পারভীন হাসান, দিলারা চৌধুরী প্রমুখ শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। দল ও সংগঠনরূপে ঢাবির বিএনপিপন্থী ‘সাদা দল’ এবং উদারপন্থী ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’-এর নাম করতে হয়।
সামিনা লুতফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত থেকে ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় ও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। ৩১ জুলাই ’২৪ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় ‘রাষ্ট্রীয় শোক পালনের চেষ্টা একটি প্রহসন’ শিরোনামে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সাংবাদিক মনজুরুল ইসলাম। এক প্রশ্নের জবাবে ড. সামিনা ইসলাম বলেন, “২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে ‘ব্যাকল্যাশ’ বিক্ষোভ, যা পরে গণপভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকা সরকার, ছাত্রলীগ, পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব দিয়ে অতিরিক্ত ও অবৈধ শক্তি প্রয়োগ করেছে। কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করেও এ আন্দোলন দমন করা যায়নি। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট, ব্লক রেইড, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর পরও জনগণের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে আজ বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে।” অপর একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “শত শত মানুষের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে সরকারের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের চেষ্টা এক ভয়ংকর প্রহসন, যা শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রতিটি মিথ্যাচার, প্রহসন, আর ‘পি আর ক্যাম্পেইন’-এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী-জনতার যে ঐক্য দাঁড়াচ্ছে, তার শক্তি সাধারণ নাগরিকেরা টের পাচ্ছেন; কিন্তু সরকার কি সেটা পাচ্ছে? পেলে তাদের দমন-পীড়ন বন্ধ করে শান্তির পথে, মিথ্যাচার বন্ধ করে ক্ষমা চাওয়ার পথে আসতে হবে। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের পথে, মানবতার পথে আসতে হবে। এখন আর এটা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডে’র বিচারের দাবি উঠছে।”
২৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সামিয়া লুতফা বলেন, ‘আমরা সবাই এখন এক হয়ে গেছি। আলাদা করে কোনো কর্মসূচি নেই।’ ২ আগস্ট মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি ফোঁটা রক্তের হিসাব নিতে হবে।’

‘নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ন্যক্কারজনক’ শিরোনামে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সে’র সহযোগী অধ্যাপক সিউতি সবুর এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে অনেক সময়ই ভুল ধারণা করা হয়। মনে করা হয়, তারা ‘অরাজনৈতিক সত্তা’। এটা সত্যি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি নেই। কিন্তু ছাত্ররা তো দেখছেন, দেশে কী হচ্ছে, কারা কী করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ... আমি মনে করি, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার পার্থক্য অনেক আগেই ঘুচে গেছে।” অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন শুরুতে শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল, পরে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায়। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হলে ছাত্র বিক্ষোভ তীব্র রূপ ধারণ করে। ...এখন যেভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটা ন্যক্কারজনক। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ক্ষাভ ও বঞ্চনাবোধ তৈরি হয়েছে, সেটা যৌক্তিক। কিন্তু আলোচনার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। আলোচনায় বসে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। শুধু ছাত্রদের নয়, দেশের অনেক মানুষের মধ্যে একটা বঞ্চনাবোধ তৈরি হয়েছে। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সর্বত্র একধরনের অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অন্যায়-অনিয়ম গভীরভাবে প্রোথিত। এগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইতিবাচক নয়। ... সরকার ও জনগণের সম্পর্ক ‘প্রভু-ভৃত্যে’র সম্পর্ক নয়, এটা বুঝতে হবে। সব ধরনের দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। এগুলো না করলে বাংলাদেশকে নিয়ে যে সম্ভাবনা ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল, সেটা আর পূরণ হবে না।” (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০২৪)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে নানা ইস্যুতে তাদের নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন এবং সরকারের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের সমালোচনা করেছেন। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ২৯ জুলাই নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ‘বিক্ষুব্ধ ৭৪ নাগরিক’ যে বিবৃতি দেন, তাতে গীতি আরা নাসরীন স্বাক্ষর করেন। তিনি আন্দোলনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হিসেবে ছিলেন। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থেকে আন্দোলনকে ঘিরে সংগঠনের বিবিধ কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি ও প্রতিবাদী ভূমিকা লক্ষ করা যায়। বিজয়োত্তরকালে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘মিডিয়া সংস্কার কমিশনে’র সদস্য নিযুক্ত হন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা ফেরদৌসের কথা বলতে হয়। কুমিল্লার একটি রাজনৈতিক পরিবারের কন্যা; বাবা মনিরুল হক চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপিপন্থী সংসদ সদস্য ছিলেন। পিতার পদবি থেকে তার কেতাবি নাম চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে তিনি রাজপথে সরব বক্তা ছিলেন। তার জ্বালাময়ী বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। “কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। রাজনৈতিক আদর্শের জন্য নয়, পারিবারিক শিক্ষার কারণেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।” মন্তব্য ‘দৈনিক যুগান্তর’ (১০-৯-২৪) পত্রিকার। 
বিজয়োত্তরকালেও তিনি নিয়মিত মেডিকেল হাসপাতালে যান আহতদের দেখতে। ওই পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সায়মা ফেরদৌস বলেন, “৫ তারিখের আগে আন্দোলন রাজপথে ছিল। তখন থেকেই জানতে পারছিলাম যে হাসপাতালগুলোতে অনেক আহত মানুষ ভর্তি আছে। ... ৫ তারিখের পর থেকে আমি ঢাকা মেডিকেলে ছিলাম। আমি গিয়ে প্রথম যেদিন দাঁড়াই আমার জীবনে এই বাস্তবতা না দেখলে বোধ হয় ভালো হতো। আহতদের ক্ষত তখন একেবারে দগদগে, বুলেটের আঘাত যে কত তীব্র হয়, কারও চোখে স্পিøন্টার, কারও শরীরে রাবার বুলেট। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ছোট শিশু কেউ তো বাদ যায়নি।” (ঐ)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকদের মধ্যে প্রথমেই বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগের চেয়ারম্যান শামীমা সুলতানার কথা বলতে হয়। ‘প্রথম আলো’র ২ আগস্ট ’২৪ (শুক্রবার) সংখ্যায় ‘প্রধানমন্ত্রীর ছবি সরালেন জাবির বিভাগীয় সভাপতি’ শিরোনামে নিজস্ব প্রতিবেদক প্রেরিত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, “কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের হত্যা, হামলা, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করে নিজ কার্যালয় থেকে তার ছবি সরিয়ে ফেলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে অধ্যাপক শামীমার কার্যালয়ের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে তাকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়, তার পেছনে দেয়ালের ওপরের দিকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা গেলেও পাশে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছিল না। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অধ্যাপক শামীমা মুঠোফোনে ছবি সরিয়ে ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।” পরের দিন ওই পত্রিকায় সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়, যেখানে শামীমা সুলতানা অফিসকক্ষে বসে আছেন, তার বাম পাশে নিচে শেখ হাসিনার বাঁধানো ছবি দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদককে বলেন, “তার (প্রধানমন্ত্রীর) জন্য এই মুহূর্তে ঘরে পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নন। তার হাতে অসংখ্য শিক্ষার্থীর রক্ত লেগে আছে। যার জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান হুমকির মুখে পড়ে যায়, তার ছবি আমার কার্যালয়ে কীভাবে রাখি? আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী তার কার্যকলাপের কারণে মানুষের হৃদয়ে আর নেই। তাই বঙ্গবন্ধুর ছবি রেখেছি, কিন্তু তার ছবি সরিয়ে ফেলেছি।” শেখ হাসিনা তখনো প্রধানমন্ত্রী পদে সমাসীন; সে সময় এরূপ কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত ঝুঁকির ও দুঃসাহসের। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকগণ এর প্রতিবাদে মিছিল বের করেন এবং ‘দেশের আইন ভঙ্গ’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কাজের জন্য তার শাস্তি দাবি করেন। কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট সভা করে তাকে ‘শোকজ নোটিশ’ প্রদান করে।

১ আগস্ট ২০২৪ জাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর হামলা, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে গণগ্রেপ্তার এবং মিথ্যা মামলা দায়েরের মাধ্যমে হয়রানির প্রতিবাদে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এক প্রতিবাদী গানের মিছিল ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ করেন। সমাবেশে অধ্যাপক মাসুদা পারভীন (ইতিহাস) ও মাহমুদা আকন্দ (দর্শন) বক্তব্য রাখেন। মাসুদা পারভীন বলেন, “এই স্বাধীন দেশের মাটিতে একফোঁটা রক্ত আমি আর দেখতে চাই না। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে, ছাত্রকে বাঁচাতে গিয়ে শিক্ষকদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।” (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১-৮-২৪)
অধ্যাপক মাহমুদা আকন্দ বলেন, “গত ১৫ দিন ধরে সরকার দমননীতি অবলম্বন করার কারণে পথে পথে ছাত্ররা যেভাবে শহীদ হয়েছেন, যেভাবে ছাত্রদের অঙ্গহানি হয়েছে, ...পরে গণগ্রেপ্তার শুরু হয়েছে, ছাত্রদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মামলা দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক দিনে সরকার আইনজীবী, র‍্যাপার এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর যে দমননীতি প্রয়োগ করছে, তা দেখে আমরা কোনোভাবেই দেশকে স্বাধীন বলতে পারছি না। এই দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ জানাই, পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা, নির্যাতনের বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলছে, চলবে।” (ঐ)

সংগীতশিল্পী হিসেবে কৃষ্ণকলি (রায়) অধিক ‘ভোকাল’ ছিলেন। তিনি ১৯ জুলাই ছোটপর্দা ও মঞ্চের অভনয়শিল্পী ও আবৃত্তিশিল্পীসহ বিভিন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মানববন্ধন এবং ২৯ জুলাই উদীচীসহ ৩১টি সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে গানের মিছিল ও পদযাত্রা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। কৃষ্ণকলি ‘ভালোবাসি ভালোবাসি বলে’ একটি নতুন গান লিখে ও সুর দিয়ে নিজেই গেয়ে ইউটিউবে প্রকাশ করেছেন। সময় সোমবার রাত, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪। (বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম)। গানটি প্রসঙ্গে ‘গ্লিটজ’কে কৃষ্ণকলি বলেন, “এই গান ২০১৭ সালে লেখা হয়। আমরা গানটি দিয়ে স্টেজ পারফরম্যান্সও করেছিলাম। রেকর্ডও করা ছিল, কিন্তু প্রচার করব করব করে আর হয়ে ওঠেনি। এখন এই ছাত্র-জনতার আন্দোলন, তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই যে বিজয় হলো, সেই সময়টাকে ধরে রাখতেই গানটা প্রচার করলাম। এই গানটা দেশের সকল শহীদের উদ্দেশে, যারা মানুষকে সাধারণভাবে জীবনযাপন করার জন্য রুদ্ধশ্বাস অবস্থা থেকে বের করেছে। সেই অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে একটা মানুষের সমাজ, একটা প্রকৃত সমাজ, ভালোবাসার সমাজ উপহার দিয়েছে। ... আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম সেখানে। কিন্তু আমি এতটাই ট্রমাটাইজ ছিলাম যে গান রিলিজ করার মতো মানসিকতা ছিল না।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের ‘পাঠশালা’ নামের একটি স্কুল আছে। জুলফিকার শাকিল নামের এক ছেলে ছিল, যে ছোট থেকে বড় হয়েছে আমাদের এখানেই। ইউডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। আগস্টের ৪ তারিখ গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। ওই পুরো সময়টা আমাকে এমনভাবে আঘাত করেছিল যে গান নিয়ে চিন্তা আমার আসেনি। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েই গানটা প্রচার করা।” গানের বিষয় কী? প্রতিবেদকের ভাষায়, “শ্রেণি-লিঙ্গ-জাতি-বর্ণ-ধর্ম বৈষম্যের অবসানের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার বার্তা দেওয়া হয়েছে গানটিতে।” (ঐ, ২৮ জুলাই ২০২৫)।
‘দ্য ডেইলি স্টার বাংলা’ অনলাইনে ১১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে নীলিমা জাহানের ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : যে গ্যারেজ হয়ে উঠেছিল গুলিবিদ্ধ আহতদের অস্থায়ী ক্লিনিক’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়, “১৮ই জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বাস্তবায়নে ধানমন্ডি-২৭ অবরুদ্ধ করে রেখেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ... হাসপাতালগুলোর সামনে মোতায়েন করা ছিল পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হতে পারে আন্দোলনে আহতদের। ধানমন্ডি-২৭ এর কাছাকাছি অবস্থানে থাকা ইবনে সিনা ও সিটির মতো হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের চাপ। কেউ কেউ অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে, কেউবা আহতদের ফিরিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন দুই তরুণ চিকিৎসকÑডা. অর্থি জুখরিফ এবং ডা. হৃতিশা আক্তার মিথেন। চারদিকে যখন ভয়, অনেকে যখন নিজেদের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন নিজেদের দুয়ার খুলে দেন তারা। তাদের বাড়ির নিচের গাড়ির গ্যারেজকে পরিণত করেন এক অস্থায়ী ক্লিনিকে। তাদের প্রতিবেশীরা ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক্স, ওরস্যালাইন, পানি, শুকনো খাবারÑযে যা পেরেছেন, তা-ই দিয়েছেন। এই প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় দুই দিনে ১০০ জনেরও বেশি আহত শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. অর্থি ও মিথেন। তাদের এই সাহসিকতা ও সহযোগিতা না থাকলে আরও অনেক নামই হয়তো থাকত নিহতদের তালিকায়।”
ডা. জুখরিফ অর্থি ছিলেন ইবনে সিনা হাসপাতালের ওটি সহকারী ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যালনেলের হেলথ শো উপস্থাপক এবং ডা. হৃতিশা আক্তার মিথেন ছিলেন ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতালের সাবেক মেডিকেল অফিসার। বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রকাশ করে ডা. অর্থি বলেন, “আমার জীবনে এই প্রথম এত ভয়ংকরভাবে এত কাছাকাছি কোথাও গুলির শব্দ শুনেছিলাম। ... বারান্দা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, আহত শিক্ষার্থীরা নিচে পড়ে আছে। তাদের পোশাক ভিজে গেছে রক্তে, চোখে-মুখে আতঙ্ক। (তখন) একটাই ভাবনা এসেছিল, আমি এভাবে কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে এসব দেখতে পারি না। একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে নিচে ছুটে যাই। ... আঘাতগুলো ছিল ভয়ংকর। তাদের পিঠ, মাথা, বুক শটগানের গুলিতে ছিদ্র হয়ে গেছে। কিছু গুলি পেশিতে আটকে গেছে। অন্তত ১০ জনের গুলি লেগেছিল চোখে।” ডা. মিথেনেরও অভিন্ন অভিব্যক্তি। তিনি বলেন, “মানবতা-শুধু এই একটি কারণেই সেদিন সবকিছু করেছি, নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।” ঘটনার ভয়াবহতা এমনই ছিল যে এই দুই চিকিৎসকের প্রতিবেশী খুরশিদ জাহান, যিনি সাধ্যমতো চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন, বলেন, “আহতদের দেখে আমাদের ভেতরে যে অনুভূতিটা কাজ করল সেটা হচ্ছে, আমাদেরও তো সন্তান আছে। এই আহতরাও কোনো মায়ের সন্তান। এই সন্তানদের জন্য অবশ্যই আমাদের কিছু করতে হবে।” ঘটনাটি ছোট, কিন্তু লোমহর্ষক, মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শী। এমন ছোট ছোট ঘটনা আরও অনেক থাকতে পারে, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাবে। ছোট ঘটনার সমাহারে বড় ও মহৎ ঘটনা সৃষ্টি হয়। আমরা সৃজনশীল জুলাই অভ্যুত্থানের সেই মহাকাব্যের কতক ঘটনার উল্লেখ করলাম। [চলবে]।
 

কমেন্ট বক্স