আমার বয়স যখন ১৩-১৪, তখন থেকেই নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন টের পেতে লাগলাম। বিস্ময়করভাবে আমি হঠাৎ নির্জন হয়ে গেলাম। একাকী হয়ে গেলাম। বই হলো আমার সঙ্গী। আমার খেলার সঙ্গীরা হতবাক হলো। স্কুলে পড়ার সময় আমার একটা ‘ফ্লাইং পিজিয়ন’ নামে বাইসাইকেল ছিল। চায়নিজ। সেটা চালিয়ে শহর দাবড়ে বেড়াতাম। লেখা ছাপা হয়েছে কিন্তু কাউকে বলি না। কাকে বলব! আমাদের পরিবারে কোনো লেখালেখির লোক নেই। আমার এই আকুলতা তারা কী বুঝবে! আমার মনে হয়েছিল, আমার লেখা ছাপা হয়েছে, পুরো শহর বোধ হয় আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে! আমি বিভোর হয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে গিয়ে পড়লাম বাড়ির পাশের খালের মধ্যে! কী অবস্থা! বরিশালের গণ্ডিবদ্ধ জীবন থেকে আমি মুক্তির উপায় খুঁজতাম। সে এক অসম্ভব চিন্তা! বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হয়ে আমি এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। তত দিনে আমার লেখা চিঠিপত্র বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করেছে। আমি আসল পড়া বাদ দিয়ে গল্পের বই পড়ি, সিনেমা দেখি, পত্রবন্ধুদের চিঠির উত্তর লিখি। এত চিঠি লিখতাম যে ডাকটিকিট কেনার মতো পয়সা ছিল না। আমি করতাম কি, যারা আমাকে চিঠি পাঠাত, তাদের চিঠি থেকে ডাকটিকিট খুলে কায়দা করে সেগুলোই আবার আমার চিঠিতে লাগিয়ে নিজেই পোস্ট অফিসে ঢুকে সিল মেরে দিতাম। গ্রিনবাগ পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার মানুষটি ছিলেন অতিশয় ভালো। বৃদ্ধ মানুষ। আমাকে স্নেহ করতেন খুব।
শৈশবের সেই সাদামাটা জীবনের কথা ভাবলে এখনো কেমন করে ওঠে বুকের মধ্যে। কত সহজ-সরল ছিল সেই জীবন। একটু বোকাও কি ছিলাম না তখন! ছিলাম। সামান্যতেই খুশি হতাম, আবার সামান্য কারণে কষ্টে বুক ভেঙে যেত। একবার একটা গাছ মরে যাওয়ায় আমি কেঁদেছিলাম। সামান্য একটা কলাগাছের জন্য আমার কত খারাপ লেগেছিল। গাছটা আমি লাগিয়েছিলাম। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমি গাছটার বেড়ে ওঠা দেখতাম। একবার আমার ঘুড়ি কেটে দিয়েছিল আরেকটা ঘুড়ি। ঘুড়িটা আমি চার আনা দিয়ে কিনেছিলাম। আমি অনেক দুরন্ত ছিলাম শৈশবে। অন্য পাড়া থেকে এসে দস্যুর মতো সাঁই করে আমার সুতোর ওপর হামলে পড়েছিল রাক্ষুসে ঘুড়িটা, একটু পর আমি টের পেলাম আমার নাটাইর সুতো আলগা হয়ে গেছে। আমার ঘুড়িটা আমাকে ছেড়ে মনের কষ্টে পাক খেতে খেতে দূরের আলখেতে লুটিয়ে পড়ছে। সে রাতে আমার ঘুম হয়নি কষ্টে। শৈশবের সারল্যমাখা দিনগুলো আর ফিরবে না। এখন কত জটিল জীবনযাপন করি আমরা। প্রতিটা পদে পদে কত কৌশল করি, কত হিসাব-নিকাশ করে চলতে হয়। মুখে যা বলি, তা মনের কথা নয়। কথা দিয়ে কথা রাখি না। বন্ধু না তাও বন্ধুত্বের ভান করি। প্রেম না তাও প্রেমের ভান করি। এভাবে আমরা প্রতিদিন নিঃস্ব হই। আমাদের আবেগ ক্ষয় পেতে থাকে। প্রতিদিন আমরা টুকরো টুকরো হয়ে যাই। প্রতিদিন একটু একটু করে একা হতে থাকি। শৈশবের খেলার সাথিরা আর আজকের বন্ধুদের মধ্যে যোজন যোজন তফাত। তখন ঝগড়া হতো, আবার একটু পরই মিলেমিশে যেতাম। রাগ চলে যেত।
কত খেলাধুলা করতাম। সহজ-সরল খেলা। মার্বেল খেলেছি। দুই আঙুলের মাথায় মার্বেল নিয়ে অন্য মার্বেলকে ঠুকে দিতাম। সিগারেটের কাগজ দিয়ে চারা খেলতাম। আমার সঙ্গে কেউই প্রায় পেরে উঠত না। সাইকেলের রিং চালাতাম। একবার আমার রিংটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। সে জন্য কত মন খারাপ হয়েছিল। চাইলেই তো আর একটা রিং জোগাড় করতে পারব না। সাইকেলের বেয়ারিং দিয়ে চার চাকার গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। একজন ধাক্কা দিত আর আমি গড়গড় করে চলতাম। একবার পড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গিয়েছিল। শৈশবের সব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করে। কত ঘটনাই তো আমরা ভুলে যাই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা-ও মনে রাখি না। আবার কত সামান্য ছিল, তা-ও সহজে ভুলতে পারি না। একবার ভরা বর্ষার সময় হঠাৎ আমার বাড়ির জন্য মন খারাপ হলো। এদিকে স্কুল খুলে গেছে। স্কুলের বন্ধুদের জন্য মন খারাপ লাগে। মাকে বলি, মা গা করে না। যেন দু-এক মাস স্কুল না করলে কিছু যায় আসে না। একদিন মাকে না বলেই বাড়িতে রওনা হলাম। তিন ঘণ্টার লঞ্চ জার্নি। আমার কাছে কোনো পয়সা নাই, একটা কলাপাতা মাথায় দিয়ে অনেক দূর পথ হেঁটে হেঁটে লঞ্চঘাটে এলাম। ভিজে একসা হয়ে গেছি। এসে দেখি জনমনুষ্যহীন লঞ্চঘাট। এই রকম দুর্দিনে কে আর ঘর থেকে বের হবে! হঠাৎ দেখি দূরে নদীর বাঁক ঘুরে লঞ্চটা উঁকি দিয়েছে, যেন একটা দেবদূত আসছে। খুশিতে আমার বুকের মধ্যে ব্যাঙ লাফ দিল। আবার ভয় হচ্ছিল মাকে তো বলে আসিনি। মা কেঁদে কেঁদে মারাই যাবে। বর্ষার পানিতে ফুলে-ফেঁপে ওঠা পাণ্ডপ নদী দিয়ে লঞ্চটা যতই কাছে আসছিল, ততই আমার ভয় বাড়ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঞ্চটা ঘাটে ভিড়ল না। আমি কত হাত তুলে ডাকলাম, শুনল না। ছোটবেলায় প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে প্লেন দেখতাম। ভাবতাম প্লেনটা কীভাবে আকাশে ভেসে থাকে! আমি কি কোনো দিন প্লেনে চড়ব! উত্তর পেতাম কখনো চড়ব না। মানুষ কীভাবে এত বড় বড় বই লেখে! এত ঘটনাবলি মাথায় কীভাবে ধারণ করে! কীভাবে মানুষ কবিতা লেখে! কীভাবে এত সুমধুর কণ্ঠে গান করে! সংগীত জিনিসটা কে আবিষ্কার করল! অভিনয়ই-বা কীভাবে করে! সেলুলয়েডের ফিতায় ভেসে ওঠে নানা রঙের মানুষ। সিনেমার রঙিন পর্দায় সুন্দর নারীদের দেখে আমি অভিভূত হই। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আচ্ছা, সারেং কেমন করে লঞ্চ চালায়! প্রবল স্রোতের মধ্যে মাঝি কীভাবে নৌকার হাল ধরে থাকে, তা-ও এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি কি এ রকম নৌকা চালাতে পারব! একজন স্ট্রাইকার যখন ড্রিবলিং করে নিপুণভাবে গোলপোস্টে বল ফেলে, তা-ও অবাক কাণ্ড। বাইসাইকেল জিনিসটাও কত ভালো! স্বাধীনভাবে ঘোরা যায়। একটা বাইসাইকেল থাকা কম বড় ব্যাপার নয়। লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়তাম আর ভাবতাম সাংবাদিকেরা রিপোর্ট লেখে কীভাবে! এত সোর্স কোথায় পায়! ছাত্ররা এত পড়াই-বা মনে রাখে কীভাবে! পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া কি চাট্টিখানি কথা। বিএম কলেজে ভার্তি হওয়ার আগে আমি জানতামই না ‘অনার্স’ কী! ভর্তি পরীক্ষায় আমি কোনো দিন পাস করব না।
শৈশব থেকেই একধরনের রহস্যময়তায় ঘেরা ছিল আমার ভুবন। রহস্যময়তার এই ঘেরাটোপ এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। মানুষ যে পশুর চেয়ে আলাদা, তা তার সৃষ্টিশীল কার্যক্রমেই প্রমাণিত হয়। মানুষ কত কী দিয়েছে এই পৃথিবীকে, কত কী আবিষ্কার করেছে। কিন্তু তার নিয়ত পরিবর্তনশীল মনের রহস্য কেউ উদ্্ঘাটন করতে পারেনি। আমরা যদি লক্ষ করি দেখতে পাব, আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই কেমন দিনে দিনে বদলে যায়। আমাদের সন্তান, ভাই, বন্ধু, বাবা, মা সবাই বদলায়। কখনো এই পরিবর্তন স্বাভাবিক মনে হয়, কখনো মনে হয় আশ্চর্যের! অবাক লাগে এসব ভাবলে। আমার শরীরে এখনো লেগে আছে শৈশবের সোঁদামাটির গন্ধ। আমি কখনো ভুলতে পারি না ছোটবেলার সেই সব নির্দোষ দিনগুলোর কথা। শৈশব ও কৈশোরের সেই দুরন্তপনার কথা। খেলার সাথিদের কথা। স্কুল থেকে ঘরে ফিরেই ঘুড়ি নিয়ে ছুটে যেতাম মাঠে। দৌড়াতাম কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে। খালে-বিলে ঝাঁপাঝাঁপি করতাম। পানিতে থাকতে থাকতে গায়ের চামড়া সাদা হয়ে যেত। ফুটবল খেলতে গিয়ে মারামারি লেগে যেত বন্ধুদের সঙ্গে। আবার একটু পরই মিলমিশ করে নিতাম। কিছুতেই আঙুলের মাথায় মার্বেল নিয়ে অন্য মার্বেল ঠুকতে পারতাম না। বাড়ির পাশেই ছিল সিঅ্যান্ডবি রোড। সেখানে বিকেল হলেই প্রায়ই কাঠি দিয়ে সাইকেলের রিং চালাতাম। লাল কাপড়ে মোড়া মাটির হাঁড়িতে কুলফি মালাই নিয়ে এলে দৌড়ে যেতাম রাস্তায়। অথবা ঘটিগরম। চা-না-চু-ররর..। প্রায় সময় পয়সা থাকত না বলে খেতে পারতাম না। মায়ের কাছে পয়সা চাইলে মা প্রায়ই দিতে পারতেন না। দিতে না পারলে মা অনেক কষ্ট পেতেন মনে মনে। আমার বাবা ছিল না বলে সব আবদার ছিল মায়ের কাছে। কত কী করতাম। ভরা বর্ষার দিনে মামাবাড়িতে নৌকা নিয়ে মামাতো ভাইদের সঙ্গে চলে যেতাম দূরে দূরে কোথাও। কোনো মাঝি হয়তো খোলা গলায় গান ধরত... মন পাখি তুই আর কতকাল থাকবি খাঁচাতে... ও তুই উড়াল দিয়ে যারে পাখি বেলা থাকিতে...। টেন্ডু পাতার বিড়ি টানতাম ফুকফুক করে। তারপর খুকখুক করে কাশতাম। সেই সব ভাইয়ের সঙ্গে কতকাল দেখাই হয় না। অথচ কত স্মৃতি জমে আছে। মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে কত মধুর স্মৃতি আছে। প্রায় ৪২ বছর পর ২০২২ সালে ঢাপরকাঠি গিয়েছিলাম একদিন। ভাবা যায়! অনেক স্থানই চিনতে পারছিলাম। চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠছিল। নতুন জেনারেশন অবাক হচ্ছিল, আমি এখনো এত কিছু মনে রেখেছি দেখে! (চলবে)