খেলাধুলার প্রতি আমার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু আমি স্কুলে বার্ষিক খেলাধুলায় কোনো দিন একটি পুরস্কারও পাইনি। আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ভালো হাডুডু খেলোয়াড় হব। খেলেছিও অনেক। কিন্তু অন্যদের মতো পারিনি। হতে চেয়েছিলাম ফুটবল প্লেয়ার এবং দৌড়বিদ। দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি বরাবর শেষের দিকে থাকতাম। আমার স্পিড ছিল খুবই কম। হাইজাম্প-লংজাম্প খেলতে গিয়েই হয়তো-বা স্থায়ীভাবে ব্যাকপেইন হয়ে থাকবে। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মামাবাড়িতে গিয়ে থাকতাম বছরে দুই মাস। আমাদের বেশ ধান আসত গ্রাম থেকে। মা যেতেন তদারকি করতে। তখন একবার কৃষক হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে গ্রামের ঘোমটা টানা কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আমি হব আদর্শ কৃষক। কৃষকের স্ত্রী সকালবেলা সানকিতে পান্তা ভাত নিয়ে আসবে আমার জন্য ক্ষেতে। আমি পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচামরিচ ডলে সেই ভাত খাব। সঙ্গে থাকবে ক্ষেতের টাটকা সবজি আর পুকুরের মাছ। শীতের সকালের সেই জমাট বাঁধা জিয়ল মাছ আর তরকারির স্বাদই ছিল আলাদা। ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরব বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ধান মাড়াতে গরুর পেছনে ছুটেছি কত। রাতে সেদ্ধ ধানের ভেতরে টং বানিয়ে ওম ওম বিছানা পেতে মাঘের শীতে ঘুমিয়েছি। নৌকা বাইয়েছি খালে-বিলে। গ্রাম দেশে বড় বড় তালগাছের খোল দিয়ে ডোঙা তৈরি হতো। সেগুলো বাইয়েছি। প্রায়ই তাল রাখতে না পেরে উল্টে পড়ে যেতাম পানিতে। চিনেজোঁকে ধরত। সাপ আর চিনেজোঁক আমি খুব ভয় পেতাম। পুকুরে ডুবে ডুবে মাছ ধরেছি। কলার ভেলার ওপর দাঁড়িয়ে ঝাঁকি জাল ছুড়েছি পানিতে। শীতের বিকেলে ধান উঠে যাওয়া জমিতে খেলেছি আমার ভাইবোনদের সঙ্গে। কাচি দিয়ে নাড়া কেটেছি। মাঝে মাঝে লুকিয়ে পাতার বিড়ি টেনেছি। নাড়া জ্বালিয়ে আগুন পোহায়েছি। শীতের কুয়াশাভরা সকালে বিড়ির ধোঁয়া সত্যি অসাধারণ লাগত।
শনিবার আর মঙ্গলবার দুই দিন কলসকাঠির হাট বসত। বিশাল হাট। ছোট মামার সঙ্গে যেতাম হাটে। কত কী পাওয়া যেত। মামা কত কী আমাকে কিনে দিতেনÑখেলনা, লজেন্স, রসগোল্লা। একটা খাবার খুবই সুস্বাদু ছিল মনে আছে, সেটা হলো মিষ্টি মুড়ি আর ঘোল। আহা কী সেই স্বাদ! একবারের একটা ঘটনা কোনো দিন ভুলব না। ছোট মামার সঙ্গে হাট থেকে ঘুরতে ঘুরতে বাড়িতে এসে পড়েছি। তখন রাত হয়ে গেছে। নৌকায় কলসকাঠির হাট থেকে যাওয়া-আসা করতে ঘণ্টা চারেক লাগে। বাড়িতে পৌঁছে মামা দেখলেন, আমার হাতের মুঠোয় একটা পেঁয়াজ বা আলু-জাতীয় কিছু। আমি কোনো দোকান থেকে নিয়ে এসেছি। মামা আবার আমাকে নিয়ে গেলেন কলসকাঠির হাটে এবং যে দোকান থেকে আমি জিনিসটা এনেছি, সেই দোকানে সেটা ফেরত দিয়ে এলেন। সে এক অপূর্ব জীবন ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে কোনো স্বপ্ন দানা বাঁধেনি। কোনো কিছু হওয়ার স্বপ ছিল না। স্কুলে যখন ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লিখতে দিত, তখন আমি বিরাট সমস্যায় পড়ে যেতাম। অনেকেই লিখত ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, পাইলট হবে। কিন্তু আমি কোনো দিন এসব লিখিনি। কারণ তখনো আমি জানতাম না আমি কী হব, কী হতে চাই। আমার জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক ছিল না। আজও না। এখন বিদেশে এসে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাওয়া যাচ্ছে যে তখন জীবনের লক্ষ্য ঠিক ছিল না বলে ভালোই হয়েছে। যদি কিছু হয়ে যেতাম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, তাহলে বিদেশ এসে সেটা যদি ধরে রাখা সম্ভব না হতো! কতজনই তো তা পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন মাছের ব্যবসায়ী, ডাক্তার হয়েছেন কমিউনিটি ওয়ার্কার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন ট্যাক্সিচালক বা সাংবাদিক হয়েছেন সিকিউরিটি অফিসার! জীবনের প্রয়োজনে, বাঁচার তাগিদে মানুষ তার পেশার পরিবর্তন করতেই পারে। বড় বড় স্বপ্নের সওদাগরদের এই স্বপ্নভঙ্গের জন্য আমার খারাপ লাগে। আরও খারাপ লাগে আমার মায়ের জন্য। আমার মাও চেয়েছিলেন কিছু একটা হই আমি। কিন্তু মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমি তেমন কিছু হতে পারিনি। লেখার শেষে লেখক ও সাংবাদিক কথাটা দেখতে খারাপ লাগে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নেশার জন্যই এসব করা। নেশার জন্য মানুষ কী না করে। তবে লেখালেখির একটা ভালো দিকও আছে। আমরা যারা একত্রে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, সেই সব হারানো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায়! ওরা বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, আমি কি সেই! এ ছাড়া নানাভাবে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। চমৎকার চমৎকার মেয়েদের অনুভূতিগুলো শেয়ার করা যায়, যারা আমার লেখা পড়তে পছন্দ করে।
আমি সহজেই মুগ্ধ হই। বিস্ময়বোধটা আমার পিছু ছাড়ে না কখনো। মানুষের কিছু কিছু গুণাবলি সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতো। একজন বন্ধু লিখেছেন, তিনি আজকাল সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। এমনকি আমাকেও পুরোপুরি আস্থায় আনতে পারছেন না। সেটা আমি বুঝি। আমার ধারণা, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোটা অতি দুঃখে ঘটে। নানা কার্যকারণে মানুষ একে অন্যের প্রতি আস্থা হারায়। তারপর মানুষ একদিন একাকী হয়ে যায়। একেকটি স্বপ্ন বুকে ধারণ করে মানুষ বেঁচে থাকে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ভিতটা তৈরি হয় খুব ধীর গতিতে। কোনোভাবেই একজন মানুষ অন্যের ওপর পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারে না। একধরনের রহস্যময়তার ঘেরাটোপে নিজেকে বন্দী করে রাখে। নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। আস্থাহীনতায় ভোগে। বঞ্চিত করে নিজেকে। অবশ্য এরকম হওয়ার পেছনে অনেক কার্যকারণও থাকে। তারপর একদিন সে নিঃস্ব হয়ে যায়। এটাই মানুষের নিয়তি। মানুষ কিছুতেই নিজেকে নিজের মতো গড়তে পারে না। নিজের চাওয়াটাকে বাস্তব করতে পারে না। নিজের মতো করে আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। অনেক সীমাবদ্ধতা তাকে কুরে কুরে খায়। আসলে অন্যকে বিশ্বাস করার মতো উদারতা অল্প মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আমি আসলে একসঙ্গে অনেক কিছু নিতে পারি না। আমার জগৎটা ছিল বরাবরই খুব ক্ষুদ্র। একা একা ঘুরে বেড়াতাম বনে-জঙ্গলে। গাছেদের সঙ্গে কথা হতো। কথা বলতাম পাখিদের সঙ্গে। মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতাম নিভৃতে। জোনাকি আর প্রজাপতির পিছু নিতাম। আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল বিশাল জঙ্গল। তার মধ্যে একা একা ঘুরে বেড়াতাম আর রাজ্যের সব ফল কুড়াতাম। ছুটতাম কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে। মার্বেল নিয়ে খেলতাম। সাইকেলের রিং নিয়ে রাস্তায় দৌড়াতাম। বিয়ারিংয়ের গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। সিগারেটের কাগজ দিয়ে চাড়া খেলেছি। বাইসাইকেল চালাতে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গেছে কত। আমার বাবা মারা গিয়েছেন আমার দুই বছর বয়সে। মা-ই আমার সব ছিলেন। কিন্তু আমি বহুদিন ধরে মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছি।
বরিশালের নিস্তরঙ্গ কিন্তু সবুজে, মায়ায়, ছায়ায়, ভালোবাসায় চমৎকার জীবন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম একদিন। অনিশ্চিত সেই জীবন ছিল আমার। তারপর কত কী ঘটল জীবনে। এত কিছু ঘটার কথা ছিল না। এক জীবনে সবারই অনেক অভিজ্ঞতা হয়। আমার একটু বেশিই হয়েছে। আমার সমবয়সী অনেকেই বরিশালের সেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি! কোনো কিছু থেকে তারা বঞ্চিত হয়নি! আমি কী এক নেশায় বরিশাল ছেড়ে আজ এখানে কাল সেখানে ছুটে বেড়ালাম। বরিশাল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে কানাডার অটোয়া। তারপর একসময় টরন্টো শহরে থিতু হলাম। আরও কত দেশ-বিদেশ ঘুরলাম। কত মানুষ দেখলাম। শহর, নগর, বন্দর দেখলাম। অভাব-অনটন যেমন দেখেছি, এক পয়সা দুই পয়সার হিসাব সহজে মিলত না, আবার তথাকথিত সচ্ছল জীবনও দেখেছি। নৌকায় চড়ে যেমন মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যেতাম, তেমনি প্লেনে হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছি, কখনো ইকোনমি, কালেভদ্রে বিজনেস ক্লাস, কখন্ েভিআইপি লাউঞ্জ দেখেছি। শিশুকালে কাঠের চৌকিতে ঘুমাতাম, কাঁথা বিছানো থাকত, শক্ত চৌকি, তাও ঘুম হতো দারুণ। জাজিম কী জিনিস জানতাম না। দেশ-বিদেশে নামীদামি হোটেল দেখেছি, থেকেছি। পার্থক্য আর এমন কী। নিশ্চিন্ত ঘুম হওয়াটাই বড় ব্যাপার। সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই আসল। জীবনে আমি মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি, আনুকূল্য পেয়েছি, যা পাওয়ার যোগ্য আমি নই। যা পাওয়ার কথা ছিল না। প্রকৃতি যেমন আমাকে আগলে রাখে, তেমনি মানুষের ভালোবাসাও আমাকে সতেজ রাখে, অনুপ্রাণিত করে। তাই আমি প্রতিনিয়ত হারতে হারতে জিতে যাই। আমি কি ভুল করি না! অনেক ভুল করি। আমিও কি ঈর্ষান্বিত হই না! হই। আমি কখনো কারও ক্ষতির চিন্তা করিনি। আমি কখনো প্রতিশোধপরায়ণ হইনি! অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েছি। আমার কিছু দুর্বল দিক আছে। অনেকে সেটা ব্যবহার করে। তখন ক্লাস ফোরে বা ফাইভে পড়ি। রাস্তায় মার্বেল খেলতে গিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া লেগে গেল। বন্ধুটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল রাস্তায়। কিল-ঘুষি দিল। সে ছিল দুষ্ট প্রকৃতির। আমি ছিলাম হালকা, পটকা। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এলাম। মা বললেন, তুমি কিছু বলোনি তো! আমি বললাম, না বলিনি। মা বললেন, ঠিক করেছ। মা সব সময় আমাকে অহিংস হতে শিখিয়েছেন। ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। কাউকে অপছন্দ হলে অ্যাভয়েড করতে বলেছেন। কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ হতে বলেননি।
ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে যেতাম ঢাপরকাঠি। অজগ্রাম। মামাবাড়ি। ভরা বর্ষার দিনে মাঠঘাট পানিতে টইটম্বুর হয়ে যেত। ঘোলা পানিতে মাঠঘাটকে মনে হতো সাগর। বড় বড় ঢেউ উঠত। পান্ডপ নদীর পানির এমন স্রোত ছিল যে দেখলে বুক কেঁপে উঠত। আমার যখন বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ হতো, তখন এই নদীর কাছে এসে বসে থাকতাম। দুপুর বারোটায় একটা লঞ্চ ভোঁ দিয়ে এসে ঘাটে ভিড়ত। বরিশাল-পটুয়াখালীর মধ্যে যাতায়াত করত এই লঞ্চ। কিছু নারী-পুরুষ লঞ্চ থেকে নামত আর কিছু আবার উঠত। তারপর লঞ্চটা উধাও হয়ে যেত নদীর বাঁকে। অনেকক্ষণ ধরে লঞ্চের ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দ কান পেতে শুনতাম। শব্দটা মিলিয়ে গেলে একধরনের হাহাকার বুকের মধ্যে বেজে উঠত। ওই লঞ্চটার আসা-যাওয়ার মধ্যেই বাড়ির সঙ্গে একটা গোপন যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মা আমাকে একা একা যেতে দেবেন না জানি; আবার বাড়িতে রেখে এসেছি খেলার সাথিদের। তাদের জন্য মন খারাপ হয়। কিন্তু ছোটদের কথা কেউ বুঝতে চায় না। বড়রা কখনো ছোটদের মন বোঝে না! পান্ডপ নদীটার সঙ্গে আমার অদ্ভুত এক সখ্য গড়ে উঠেছিল। অন্যে যা করত, আমার অবচেতন মন তা-ই করতে চাইত। ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে খুব সিনেমা দেখতাম। নায়িকা কবরী ছিল আমার খুব প্রিয়। মনে মনে ভাবতাম, কবরী এত সুন্দর কেন! পরবর্তীকালে কবরীর ভুবনভোলানো হাসি নিয়ে অনেক লেখাও লিখেছি। তখন কবরীকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আসলে সুন্দর কিছু দেখলেই আমার মন কেমন করে। কত কী যে ভর করত মনে। আমি বরাবর একটু ইন্ট্রোভার্ট। সহজে কারও সামনে যেতে বা কিছু বলতে পারি না। নিজের জন্য কিছু চাইতে পারি না। এ জন্য আমার কিছু হয়নি। আমাকে বোঝে এ রকম একজন মানুষও আমি পাইনি। আমাকে বোঝা যেকোনো মানুষের জন্য একটু কঠিন বটে।
বরিশালের বাড়িতে দুপুর হলেই হকারের জন্য অপেক্ষা করি। ঢাকার পত্রিকা বরিশাল পৌঁছায় পরদিন সকালে। তত দিনে আমি বিখ্যাত সাপ্তাহিক বিচিত্রার নিয়মিত পাঠক হয়ে গেছি। বিচিত্রার ডেটলাইন হচ্ছে শুক্রবার। কিন্তু বাজারে ছাড়া হতো এক দিন আগেই বৃহস্পতিবার। মঙ্গলবার হতো পেস্টিং। বুধবার হতো বাঁধাই। এসব আমি অনেক পরে জেনেছি। শুক্রবারের জন্য থাকে আমার অধীর অপেক্ষা। সে সময় প্রতি সংখ্যা বিচিত্রার দাম দুই টাকা। এই দুই টাকা জোগাড় করা আমার জন্য ছিল অতি কঠিন। পয়সা জমিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা কিনতাম। স্কুলজীবন থেকেই এই অভ্যাস হয়েছিল। মফস্বলের এক ছায়াঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ বাড়িতে বসে এক তরুণ তখন বিচিত্রা পড়ে, লাইব্রেরি থেকে গাদা গাদা বই আনে। নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা, বিমল মিত্র, বিমল কর, আশুতোষ, রমাপদ’র লেখা গিলে খায়। দস্যুবনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানা পড়ে নিয়মিত। আমার মা এসব দেখে ভয় পেয়ে যান। আমি রাত জেগে পাঠ্যবইয়ের আড়ালে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি। কী ভয়াবহ কথা! মা ভাবলেন, এ ছেলের কপালে দুঃখ আছে। বাপ-মারা ছেলে! লেখাপড়া না করলে খাবে কী! রাত দশটা হলেই মা লাইট অফ করে দেন। সে সময় অনেক ইচ্ছাই অপূর্ণ থেকে যেত। এ জন্য আমি স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতাম। আমার জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। কবি আবুল হাসানের ভাষায় বলতে হয়, ‘আমি বুঝে গেছি আমার হবে না।’ এ জন্য আমার কোনো দুঃখ নাই। আমি যে তেমন কিছু হতে পারিনি, এটাকে আমি বেশ উপভোগ করি! সবাই কিছু না কিছুু হতে চায়। বড় হতে চায়। আমি চাই না। আমার বাবা ছিল না বলে মা-ই ছিলেন আমার কাছে সব। আজ বুঝতে পারি, মা আমার জন্য কত কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি ছিলাম খুব দুরন্ত প্রকৃতির। আমার দুরন্তপনায় পাড়া-পড়শিরা অতিষ্ঠ ছিল। আমাদের পরিবারটা ছিল বিশাল। অনেক আত্মীয়-পরিজন নিয়ে আমাদের বসবাস। বারো-তেরো বছর বয়স যখন, তখন থেকেই সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কলোনিতে। সেখানে ডাক্তারদের অনেক সুন্দরী কন্যারা ছিল। মনে আছে, মায়া নামের এক রূপসী ডাক্তার-কন্যার প্রেমে পড়েছিল পুরো শহরের যুবকেরা! মা আমাকে একটা ফনিক্স চায়নিজ বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। সেটাই দাবড়ে বেড়াতাম। সিনেমায় যেতাম স্কুল পালিয়ে। চুলের স্টাইল করতাম রাজ্জাকের মতো। কবরী ছিল আমার প্রিয় নায়িকা। চিত্রালী পত্রিকা থেকে কবরীর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি কেটে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। (চলবে)