Thikana News
০১ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫
৩৬শে জুলাই ২০২৪

একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-৮

আবু সাঈদের স্বনামে অথবা ভিন্ন নামে যেসব কবিতা-ছড়া রচিত হয়েছে; এসব রচনায় কবি-ছড়াকারদের আবেগ-অনুভূতি প্রতিক্রিয়ার কথা পাঠক জানতে পারবেন। এক অর্থে এগুলো সমাজেরর মানুষের মনের অভিব্যক্তি, চিত্তের প্রতিফলন।
একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-৮
সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক নিবিড় ও পারস্পরিক আদান-প্রদানে নিবদ্ধ। ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘শিল্পসাহিত্য বিপ্লবকে দিক ভাষা, বিপ্লব শিল্পসাহিত্যকে দেবে মুক্তি।’ বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক আন্দোলন/বিপ্লব দেশের সাহিত্য-সংগীত-শিল্প থেকে অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা, সৎসাহস লাভ করে এগিয়ে গেছে; আবার একটি সফল ও সার্থক আন্দোলন/বিপ্লব নতুন সাহিত্য-সংগীত-শিল্প সৃষ্টিতে আবেগ, অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা জুগিয়েছে। রুশ বিপ্লবীরা টলস্টয়ের সাহিত্য থেকে প্রেরণা ও নির্দেশনা লাভ করেছিলেন। আবার বিপ্লব-যুদ্ধোত্তর কালজয়ী কাব্য-উপন্যাস-নাটক রচিত হয়েছে অনেক দেশে। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নজির হিসেবে নিলে জ্বলন্ত প্রমাণ হাতের কাছেই পেয়ে যাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আন্দোলনের শুরুতে যখন র‍্যাপ গান রচিত হয়নি, তখন পূর্বপ্রচলিত জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা অনুপ্রাণিত হয়েছে, শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করেছে। তারা মিছিলে ও সমাবেশে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ গান করেছেন, ‘বল বীর/ বল চির উন্নত মম শির’ কবিতা আবৃত্তি করেছেন, যা কবি প্রায় একশ বছর আগে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রচনা করেছিলেন। গীতিকার ও সুরকার আপেল মাহমুদের ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে’, গোবিন্দ হালদারের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’ ও ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ ইত্যাদি গান পরিবেশিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত হয়েছিল। ইথন বাবুর রচিত ও গীত ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি?’ গান ২০২২ সালে রচিত ও প্রচারিত হয়। এটিও চলতি আন্দোলনের প্রেরণার উৎস ছিল। ১৫ জুলাই পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদসহ ৬ জন ছাত্র ও সাধারণ জনতা নিহত হন। পরের দিনেই সেজান লিখেন ‘কথা ক’ গান। এরপর র‍্যাপ পপ গানের স্রোত বয়ে যায়।
গানের অনুরূপ কবিতা ও ছড়া আন্দোলনের হাতিয়ার ও প্রেরণার উৎস। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে বহুসংখ্যক কবিতা-ছড়া লেখা হয়েছে; নানা পত্রপত্রিকায় সেগুলো ছাপা হয়েছে, সংকলনও প্রকাশিত হয়। শুরুতে কে বা কারা কী কী কবিতা-ছড়া রচনা করেন, তার হিসাব কেউ দেননি, আমারও জানা নেই। গণআন্দোলনের প্রথম দিকে কবিতা-ছড়া লেখার ও প্রকাশ সম্পর্কে একজন নবীন প্রবন্ধকার মনসুর আজিজ লেখেন, ‘যেকোনো আন্দোলনে কবি-লেখকদের একটি বড় ভূমিকা থাকে আন্দোলনকারীদের উজ্জীবিত রাখতে। কিন্তু গত দেড় দশকে বাংলাদেশের কবি-লেখক, শিল্পী সমাজের প্রধান অংশটি ছিল সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী। রাজবন্দনা আর সরকারের দক্ষিণা গ্রহণে তারা ছিলেন তৎপর। ... এর বাইরের দেশপ্রেমিক অংশটি সরকারি-বেসরকারি প্রচারমাধ্যমে ছিলেন উপেক্ষিত। সে জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে কবি-লেখক-শিল্পীদের বড় অংশটি ছিল নীরব। তবে এর বিপরীতে দেশপ্রেমী অগ্রজ ও তরুণ কবি-লেখক-শিল্পী সমাজের একটি অংশ সরাসরি আন্দোলনে, লেখায় ও সামাজিক মাধ্যমেও ছিলেন সরব। প্রবাসী কবি-লেখক-শিল্পীদের ভূমিকাও ছিল চোখে পড়ার মতো।’ (ছোটদের সময়, জুলাই বিপ্লব সংকলন, ২০২৪, পৃ. ৬৫)।
এ হলো আন্দোলনের প্রাক-পরিস্থিতি। আন্দোলন চলাকালে কবি ও ছড়া রচয়িতা, বিশেষ করে ছড়াকারদের ভূমিকা সম্পর্কে লেখকের উক্তি, ‘ছড়ায় সরাসরি বক্তব্য তুলে ধরা যায়। গণআন্দোলনকে ঘিরে অনেকে লিখেছেন দ্রোহের ছড়া। দুঃশাসনের চিত্র, গুম-খুন-হত‍্যার চিত্র, শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ অন‍্যদের কথা তুলে ধরা হয়েছে ছড়ার আবেগী পঙ্্ক্তিমালায়।’ (ঐ, পৃ. ৬৮)। এরপর তিনি ’২৪-এর গণআন্দোলনের বিচিত্র ঘটনা ও প্রসঙ্গ নিয়ে যারা ছড়া রচনা করেছেন, তাদের রচনার দৃষ্টান্ত ছাড়াই কেবল একটি তালিকা প্রদান করেছেন। এখানে তালিকাটি পুনর্বিন্যস্ত করে নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. ফারুক হোসেন-মুগ্ধ গেল যুদ্ধক্ষেত্রে; ২. হামিদ মেহবুব-চব্বিশ সাল; ৩. জাকির আবু জাফর-রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ; ৪. আমীন আল আসাদ-জীবনের সেরা ঈদ; ৫. জগলুল হায়দার- যোদ্ধা সাইদ; ৬. জাকির হোসেন কামাল-ফিনিক্স পাখি হয়ে; ৭. নাসিরদ্দীন তুসী-বিচার চাই; ৮. জুলফিকার শাহাদৎ-বিজয় ২০২৪; ৯. নজরুল ইসলাম শান্ত-ছড়ার বারুদ; ১০. মালেক মাহমুদ-এই ছড়াটি; ১১. লোকমান হোসেন জীবন-জ্বলছে মশাল; ১২. মোরশেদ কমল-হয় যে ইতিহাস; ১৩. মামুন সারওয়ার-সোনার ছেলে; ১৪. আবিদ আজম-স্বদেশ নয় মৃত্যু; ১৫. আমিনুল ইসলাম মামুন-চব্বিশের ছড়া; ১৬. আবু বকর সালেহ-কাল নাগিনী; ১৭. শাহরিয়ার সোহেল-চেতনায় লাগলে আগুন; ১৮. সুমন রায়হান-গড়ব বাংলাদেশ; ১৯. শামীম শাহাবুদ্দীন-দালাল; ২০. তাসরিন প্রধান-ধিক্কার; ২১. নাজীর হুসাইন খান-স্বাধীন হইলো দেশ; ২২. আবদুল হাই ইদ্রিছী-মুখোশ পরা গুরু; ২৩. আরকানুল ইসলাম-লিখেছে শহিদের নাম; ২৪. রেজা করিম-ডাইনি বুড়ি; ২৫. নুশরাত রুমু-চব্বিশের আন্দোলন; ২৬. খলিল ইমতিয়াজ-আমিই মিছিল, আমিই সাহস; ২৭. জহির সাদাত-আবু সাঈদ; ২৮. শরিফ আহমদ-তারুণ্যের আগুন; ২৯. নোমান শায়েরী-রক্তাক্ত জুলাই ২০২৪; ৩০. নবীন সাদিক-ঝরাফুল; ৩১. মুহাম্মদ ইব্রাহিম বাহারি-নতুন যুগের স্বাধীনতা; ৩২. স্বপঞ্জয় চৌধুরী-কোটা চাইনে কোটা; ৩৩. মনসুর আজিজ-হায় পলাতক ক্ষমতাধর। (ঐ, পৃ. ৬৮-৫৯)।
আমরা ‘ছোটদের সময়’ নামে যে সংকলনটির কথা বলছি, তাতে ‘জুলাই বিপ্লবের কবিতা’ শিরোনামে মোট ৪৮টি ‘কবিতা’ সংকলিত হয়েছে। আসলে ভাব ভাষা ছন্দ ও আঙ্গিকে এগুলো ছড়া, কবিতা নয়। সম্প্রতি মৎপ্রণীত ‘জুলাই-আগস্ট ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান : ইতিহাস ও অন্যান্য’ (২০২৫) গ্রন্থে বিভিন্ন উৎস থেকে মোট ২০টি কবিতা ও ছড়া সংকলিত করেছি। এগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ পত্রিকার ১২টি কবিতা-ছড়া রয়েছে। রচয়িতাগণ অধিকাংশই প্রবাসী। তাদের নামসহ কবিতা-ছড়ার নাম ছিল এরূপ : ১. তাপস কুমার ধরÑআবু সাঈদ; ২. কামরুল হোসেন লিটু-হিপোক্রেট; ৩. খ্রীষ্টফার পিউরীফিকেশন-বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছি; ৪. সালেম সুলেরী-দাড়িহীন দরবেশ; ৫. শাহনাজ শিউলী-স্যালুট তোমাদের; ৬. আকছার মুহাম্মদ-আমিই স্বাধীনতা; ৭. আবু কাজী রুবেল-পানি লাগবে পানি; ৮. ছন্দা বিনতে সুলতান-মুগ্ধময় এই বাংলা; ৯. নবী হোসেন নবী-আয়নাঘর; ১০. ফিরোজ হুমায়ুন-দরবেশ ও দরবেশ; ১১. শামসুদ্দিন হারুন-মানুষ নেমেছে রক্তের অনুবাদে ও ১২. পথ যখন হয় রক্তে লাল।
জুলাই গণআন্দোলনের নানা ঘটনা, স্বৈরাচার সরকারের অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন-নির্যাতন, খুন-যখম, হামলা-মামলা, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার, শত শত শহীদের আত্মত্যাগ ও শতসহস্র আহত ছাত্র-জনতার আর্তনাদ ইত্যাদি ছিল এসব কবিতার ও ছড়ার বিষয়বস্তু। ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার দোসররা এবং আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, তাহমিদ প্রমুখ শহীদ প্রাধান্য পেয়েছেন। অত্যাচারী, নিপীড়ক ও স্বৈরাচার শাসক হিসেবে প্রথম জনরা নিন্দিত ও ধিক্কৃত হয়েছেন; দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আত্মবিসর্জন দিয়ে দ্বিতীয় জনরা বীর শহীদের জাতীয় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন।
৩৬শে জুলাই আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন আবু সাঈদ। তিনি ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন’ মনে করে সশস্ত্র পুলিশের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দাঁড়ান। ন্যায়সংগত বিষয়ের দাবিতে অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলন করার অধিকার একজন নাগরিকের আছে, রাষ্ট্রের সংবিধান এই অধিকার দিয়েছে। স্বৈরাচার সরকার তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে উল্টো গুলি চালিয়ে সাঈদসহ বহুজনকে হত্যা করেছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে সাঈদের মৃত্যুবরণের দৃশ্যটি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। টেলিভিশন, ভিডিও ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এ দৃশ্য দেশবাসী ও বিশ্ববাসী দেখেছে, শুনেছে, জেনেছে। করুণ এ দৃশ্য স্বাভাবিকভাবে কবি-সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী-কণ্ঠশিল্পী সবার অন্তরকে অভিভূত ও বিচলিত করেছে। তাই আবু সাঈদকে নিয়ে গান, গ্রাফিতি, কবিতা, ছড়া, পোস্টারও অধিক রচিত হয়েছে। এর সঙ্গে মীর মুগ্ধের জীবন বিসর্জনের ঘটনাও প্রায় সমতুল্য হৃদয়গ্রাহী ও মর্মবিদারক ছিল। দিন-দুপুরে তীব্র দাবদাহে আন্দোলনরত সহযোগী ছাত্রদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ‘পানি লাগবে পানি, পানি লাগবে পানি?’ বলে আদরের স্বরধ্বনি তুলে ‘মিনারেল ওয়াটার’ ভর্তি প্লাস্টিক বোতল বিতরণ করছেন। তার হাতে বোতল, মুখে মৃদু হাসি, বাম চোখের টিপনী ও গলায় ঝুলন্ত ফ্রিল্যান্সের কার্ড দৃশ্যটি সবার নজর কাড়ে। পুলিশের গুলি চলছে, ভ্রুক্ষেপ নেই। মিছিলের সাথে চলতে চলতে একসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। মুগ্ধও গানে-গ্রাফিতিতে-কবিতায়-ছড়ায় তুল্যমূল্য স্থান পেয়েছেন। মাঝে মাত্র দুই দিনের ব্যবধান-১৫ জুলাই আবু সাঈদ এবং ১৮ জুলাই মুগ্ধ এভাবে শহীদ হন। তাদের জীবনের সব স্বপ্নের ও আশার প্রদীপ নিভে যায়। দেশের ও দশের জন্য তাদের এই আত্মত্যাগ ছিল বিরল ও অতুলনীয়।
আবু সাঈদের স্বনামে অথবা ভিন্ন নামে যেসব কবিতা-ছড়া রচিত হয়েছে; এসব রচনায় কবি-ছড়াকারদের আবেগ-অনুভূতি প্রতিক্রিয়ার কথা পাঠক জানতে পারবেন। এক অর্থে এগুলো সমাজেরর মানুষের মনের অভিব্যক্তি, চিত্তের প্রতিফলন। কবিরা তো সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করেন। আমরা প্রথমে আবু সাঈদকে নিয়ে রচিত কতক কবিতা-ছড়ার উল্লেখ করতে চাই।
(১) ‘আবু সাঈদ’ নামের একটি কবিতায় তাপস কুমার ধর লিখেন, ‘বিবেক তুমি জাগ্রত হও/ তোমার বীর সন্তান আবু সাঈদ/ মা-বাবার বুক থেকে কেন গেলে চলে? ... এমন স্বাধীনতা আমার চাই না/ যেখানে মানবতা হয়ে ওঠে/ মৃত্যুর রক্ত দানব।’ (সাপ্তাহিক ঠিকানা, ২৪ জুলাই ২০২৪)।
(২) ‘বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছি’ নামক ছড়ায় খ্রীষ্টফার পিউরীফিকেশন বলেন, ‘বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছি মৃত্যুভয় ঝেড়ে,/ ন্যায়ের পথে এগিয়েছি যাব না তো ছেড়ে।/ বৈষম্য দূর করতে লড়ি করি ত্যাগ স্বীকার,/ চাই না হতে অন্যায্যতার বঞ্চনার শিকার।/ এক পাও নড়ব না হায়েনা আসুক তেড়ে,/ হটব না পিছু আর নেয় যদি প্রাণ কেড়ে।’ (ঐ, ৭ আগস্ট ২০২৪)। যিনি ‘বুক চিতিয়ে’ দাঁড়িয়েছেন, তিনি আবু সাঈদ ছাড়া আর কেউ নন। কথাগুলোতে তারই মনের ভাব ভাষা পেয়েছে।
(৩) এ কে আজাদের ছড়ার শিরোনাম ‘বীর আবু সাঈদ’। স্বৈরাচার শাসকের দুর্নীতি ও দুঃশাসন মানুষের বাকস্বাধীনতার মতো দেশের স্বাধীনতাকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। আবু সাঈদসহ শহীদ সন্তানেরা স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে ফিরিয়ে এনেছে ‘মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ’। ২২ পঙ্্ক্তির এই ছড়ার শেষের কতক চরণ ছিল এরূপ : ‘এক সাঈদের বুকের সাথে লক্ষ সাঈদ বুক পেতেছে,/ স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশ আজ খুব মেতেছে।/ এই পারেতে স্বৈরাচার ওই পারেতে মুক্তিকেতু,/ মাঝখানেতে রক্তনদী তার উপরে সাঈদ সেতু। সেই সেতুতে বুক মেলালো বাংলাদেশের ছেলেমেয়ে,/ মজলুমানের জন্মভূমি তাদের দিকেই আছে চেয়ে।’ (ছোটদের সময়, অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৪, পৃ. ৮১)।
মুগ্ধ প্রসঙ্গেও নানা কবিতা-ছড়া রচিত হয়েছে। 
(১) আবু কাজী রুবেলের কবিতার ‘পানি লাগবে পানি’ শিরোনামই বলে দেয়, কার কথা বলা হয়েছে। মীর মুগ্ধের মুখের মাত্র তিন শব্দের এ ভাষা ইতিহাসে অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবে। শুরুতে কবি লিখেছেন, ‘বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপে সৃষ্ট অথৈই সাগরের পানি/ তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে জনতার মিছিলে স্বাগতধ্বনি/ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুহুর্মুহু বজ্রধ্বনি/ মানুষের মাঝে অধিকার আদায়ের সঞ্জীবনী/ পানি লাগবে পানি।’ আর শেষ চার চরণ : ‘মিছিলের মাঝে সাহসী মুগ্ধের ডাকা পানি লাগবে পানি/ একবুক ভালোবাসার আদরে মোড়া ডাক-পানি লাগবে পানি/ ছেলেহারা মায়ের চোখের জলে ভেজা-পানি লাগবে পানি/ পানি লাগবে পানি।’ (ঐ, ২১ আগস্ট ২০২৪)। মুগ্ধের আবেগের আবেশের আদরের কণ্ঠধ্বনি বাংলার মানুষের কানে অনন্তকাল বাজবে।
(২) ‘পানি লাগবে পানি’ শিরোনামে ছড়া রচনা করেছেন মাসুম আওয়াল। তিনটি স্তবকে ছড়াকার মিছিলে পানি বিতরণরত মুগ্ধকে জীবন্তভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তার ভাষায় শেষ স্তবকের দৃশ্যপটটি ছিল এরূপ : ‘মুগ্ধ বলছি, পানি লাগবে, পানি লাগলে বলো,/ বুকভরে শ্বাস নিয়ে আবার নতুন করে জ্বলো।/ আকাশ কালো আর মাটি লাল বদলালো রঙ ঘাস,/ পানি লাগবে বলতে মুগ্ধ হলো লাশ।’ (ছোটদের সময়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯২)।
(৩) মীর মুগ্ধকে নিয়ে ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন ‘আশুরার কবিতা’। তিনি বলেন, ‘টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ মুছতে মুছতে মীর মুগ্ধ/ দৌড়ে যাচ্ছে, আর বলছে, ‘পানি লাগবে, পানি?’/ চোখ ষাট ভাগ খুলে ছবিটার দিকে তাকালে মুগ্ধকেই আপনার/ আকাশ থেকে পাঠানো কোনো ফেরেশতা মনে হবে।/ আপনি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকাবেন।/ আর আপনার চোখের সামনে এক সিমারের গুলিতে/ তার মগজ বের হয়ে যাবে, রক্তে ভেসে যাবে কারবালা।’ (প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০২৪)।
আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধ যুগ্মভাবে চিত্রিত হয়েছেন অনেক ছড়ায় ও কবিতায়। শামসুদ্দিন হারুন ‘মানুষ নেমেছে রক্তের অনুবাদে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সাঈদের সেই প্রসারিত হাত/ কখনই মিলিয়ে যাবে না শূন্যে।/ এদেশ আমার মুক্ত হবেই/ হে মুগ্ধ ... তোমাদের শত পুণ্যে।’ (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। স ম শামসুল আলমের ‘দেশের স্বার্থে’ ছড়ার দুটি চরণ : ‘যে আন্দোলন নৈতিকতার হয় তা পরিশুদ্ধ/ শহীদ হতে পারে অনেক আবু সাঈদ মুগ্ধ।’ (ছোটদের সময়, পৃ. ৪৮)। শাহাবউদ্দিন শামীম ‘জনতার ডাক’ ছড়ায় লিখেছেন, ‘ছাত্র জনতা জয় পেয়েছে স্বাধীন হলো দেশ,/ মুগ্ধ সাঈদের রক্তে কেনা তুমিই বাংলাদেশ।’ (ঐ, পৃ. ৫০)। জগলুল হায়দারের ‘দূর হলো’ ছড়ার দুটি চরণ : ‘সাঈদ পাখি, মুগ্ধ পাখি, পক্ষী হাজার হাজার/ জান দিয়েছে মানেনি তাও মিথ্যে হুকুম রাজার।’ (ঐ, পৃ. ৫৩)।
গুচ্ছ শহীদেরও নাম উচ্চারিত হয়েছে বহু কবিতায় ও ছড়ায়। দলিলুর রহমানের রচিত ‘ঝড়ের শেষে’ কবিতার শেষ স্তবকটি ছিল এ রকম : ‘ঝড়ের শেষে রক্ত-কাদায় কুড়ে পাওয়া গেল/ আম্রপালির মতো-সাঈদ, তামিদ, তাহমিদ, মাহমুদুর,/ রাসেল, হোসেন, জাকিরÑঅসংখ্য স্বর্ণটুকরো।’ (সাপ্তাহিক ঠিকানা, ২৮ আগস্ট ২০২৪)। শাহনাজ পারভীন রচিত ‘তোমরা আছ বিশ্বকোষে’ ছড়ার প্রথম ও শেষ দুটি স্তবক : ‘আবু সাঈদ, মুগ্ধ, জিসান আমার সোনার ছেলেÑ/ গোলাম নাফিজ, সুমন, রতন নাম শতবার মেলে।/ ... দেশের অসময়ে তোমরা করলে উজাড় প্রাণ-/ শহীদ হয়ে বিশ্বকে দাও মুক্তির সুঘ্রাণ।’ (ছোটদের সময়, পৃ. ৭৬)।
গদ্যের ও পদ্যের শব্দের উৎস এক, কিন্তু ছন্দ-মিল-অলংকারমণ্ডিত হয়ে পদ্য হয়ে ওঠে রসাত্মক ও নান্দনিক। পদ্যের ভাষার জাদুগুণ আছে, যা পাঠককে এক অনাস্বাদিত সৌন্দর্যভুবনে নিয়ে যায়। শাহনাজ পারভীন শহীদসন্তানদের বলেছেন ‘সোনার ছেলে’, দলিলুর রহমান বলেছেন ‘স্বর্ণটুকরো’; প্রথমটি ‘তুলনা’, দ্বিতীয়টি ‘রূপক’ অলংকার। এভাবে পদ্য গদ্য থেকে আলাদা হয়ে যায়। [চলবে]
 

কমেন্ট বক্স