Thikana News
২৪ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

স্মৃতিচারণা : কবি শামসুর রাহমান ও দুটি কবিতা

স্মৃতিচারণা : কবি শামসুর রাহমান ও দুটি কবিতা
জুলি রহমান

তখন মধ্যপ্রাচ্যে সাহিত্য করি। রাইটার্সসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখি। সম্পাদনাও করি জলপ্রপাত ও অনিবাস। ২০০৫ সাল। কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। বন্ধুকবি জায়েদের ফোন। রাহমান ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে একটা লিটলম্যাগ করব। কবিতা রেডি করো। তখন ঢাকার কবি ফরিদ কবীর জায়েদ ক্রিয়াপদহীন কবিতা লেখা শুরু করেছেন। জায়েদ আমাকেও ক্রিয়াপদহীন কবিতা লিখতে বলেন। আমি কয়েকটা লেখার পর ভালো লাগে না। স্টপ করে দিই। এতে জায়েদ খুব মনঃক্ষুণ্ন হয়। সেই সপ্তাহে আমাদের শীতল সম্পর্ক চলছে ক্রিয়াপদহীন কবিতা নিয়ে। আমি তাই একটু নীরব।

জায়েদ আরেকবার ফোন দিলেন, ‘কিরে কবিতা রেডি?’ আমি কী কবিতা লিখব শামসুর রাহমানকে নিয়ে? আপনারা লিখেন। জায়েদ বলেন, ‘আমি লিখেছি চিঠি ও শিমুল। শুনবি?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। খুব নীরবে যত্নে আমি কবিতা শুনছি ‘চিঠি ও শিমুল’। রাতে আমার ঘুম হলো না। কবিতাও হলো না। লিখছি উপন্যাস ধারাবাহিক ‘বহে রক্তধারা’। এখানেও মন বসাতে পারলাম না। অগত্যা লিখলাম কবিতা ‘ভেন্টিলেটরে চড়ুই’। জায়েদকে পড়ে শোনালাম। কবি নীরব। আমি ভয় পেলাম। কারণ তিনি আমার গুরু। দীর্ঘক্ষণ দুজন দু’পাশে নীরব। আমি মানফুহা। জায়েদ ধীরা। ঠিক দূরত্ব কুইন্স ব্রঙ্কস। অপেক্ষার পাথর সময় পেরোলে তিনি বলেন, ‘এই জুলি, তুই কী রে? কবিতায় তো তুই আমাকে হারিয়ে দিলি আজ।’ ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা। আমি তো ক্রিয়াপদহীন কবিতা লিখতে পারি না। আমার কেন যেন ভালো লাগে না। কিছুটা বস্ত্রবিবর্জিত মনে হয়। আপনি তো আমার ওপর রেগে আছেন। জায়েদ বলেন, ‘আর তো আমার কোনো রাগ নেই। লিটলম্যাগ হচ্ছে ঢাকায়। নন্দী ভাইকে দিয়ে কবিতাটা পাঠিয়ে দে।’ কবিতা পাঠালাম। এক মাস পর ম্যাগাজিন পেলাম। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিটলম্যাগ। দেখি, জায়েদ আমার কবিতাটি ওর কবিতার আগে দিয়েছেন। আমি জানি, আমার কবিতা যতই আগে দিক না কেন, জায়েদের কবিতার ধারেকাছেও নয় আমার কবিতা। এ হলো বন্ধুত্ব।

মনে পড়ে গেল ১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। আমাদের তিতুমীর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। কবি শামসুর রাহমান আসছেন আমাদের সাংস্কৃতিক সপ্তাহের প্রথম দিনের উদ্বোধনীতে। আমরা কীই-না হইচই করে দিন কাটালাম। কবির প্রবেশপথ পুষ্পের গালিচা করা হয়েছে। কবি আসবেন এই পথে। কবির মঞ্চ ফুলে ফুলে শোভিত। আমাদের ক্লাসমেট রানু ছিল অপরূপা সুন্দরী। গানে, নাটকে, নৃত্যেও পারদর্শী। রানু পরাবে ফুলের মালা। রনক পড়বে কবির কবিতা। সেই সুবাদে আমিও কবির কবিতায় অংশ নিলাম। আরও অনেক ছাত্রনেতা বক্তৃতায় মঞ্চ কাঁপালেন। কবির কবিতায় ঝংকার তুললেন।
আজ কবির জন্মদিন। কী সুদর্শন কবি। এই ৭৭তম জন্মদিনে তিনি কি আগের মতো নেই? কবির জন্য কবিতা। তুমি নেই জুলি রহমান। আজও ওড়ে প্রজাপতির ডানায় আমার স্বপ্নেরা গোলাপি পাখায়। শুধু তোমাকে ঘিরে কথা হয়। খুব গোপনে, কারণ তুমি ঘুমিয়ে গ্যাছো। জাগে ঢাকার শহর। শুরু হয় ভোরের আজান। রাস্তায় ফুটপাতে দোকানে হকারের হাঁকডাক। ফেরিওয়ালার এই লাগে লেইস ফিতা। ফার্মগেট, কাওরান বাজার চৌরাস্তা কত সরগরম। মহাখালীর সেই রাস্তায় হুডখোলা রিকশার টুংটাং। মৎস্য ভবন কিংবা টিএসসি চত্বরে কেউ পড়ছে তোমার কবিতা। পরম মমতায়, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। শহরের অলিতে-গলিতে, রেস্তোরাঁয় কিংবা কোনো সাহিত্য আসরে জন্মোৎসব। 
তুমি নেই তাতে কীই-বা এসে যায়? কেউ কেউ থেকেও নেই। রাতজাগা পাখি হয়ে কেউ একা কাটায় বিনিদ্র রজনী।
কবিতা প্রাণের স্পন্দন, তাকে বাঁচাতেই হবে। যদিও নেই তার কাছে মধ্যরাতে বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে জলজ কোনো প্রসাদ। কিংবা জাতিসংঘের কোনো তাজা খবর। তবুও জানে সে কোথায়, কোন আসরে অলীক কনফারেন্স ফেরেশতামণ্ডলীর। জটিল রাতের স্বপ্ন চোখে সে বিলায় বর্ণমালা। দেশ থেকে অনাবাসী জগতে। অমায় ঘেরা জনহীন ফুটপাত দাঁড়িয়ে থাকে; টুকরো টুকরো জোছনায় দেখে সে বামন চূড়ায় বসে চুরুট ফোঁকে অপসংস্কৃতিতে। অথচ তুমি নেই বলেও আমার জানালার ক্যানভাস পর্দা কাঁপে আজও বাতাসে, কেমন আগের মতোই। কারণ তুমি তো আছ। আজ কত দোকান, কত পসরা রমণীদের, ললনাদের। জলকন্যা কাউন্টারে কিন্নর কণ্ঠে শুনি সমুদ্র গর্জন; সারা দিনমান সারা বেলা। সপ্তবর্ণ কলরব নিয়ে প্রোজ্জ্বল প্রদর্শনী এসব তোমাকে দেখতে হয় না। বড় বেঁচে গ্যাছো। বড় মুশকিল জানো তো মনে করতে পারি না। আমিও কি আছি? দাঁড়াও, এই তো মনে পড়ল। বিভেদের দেয়াল বুকে নিয়ে কেঁদেছিল নারী। হ্যাঁ, নারীই তো শুধু নারী। কাঁদে শূন্যতার কবর নিয়ে, জানালায় রাখো হাত তুমি সেই দেবদূত। বলছ, তুমি মুছে ফেলো জল, পাখিরা কত বিহ্বল; তোমার চারপাশে বৃক্ষেরা সজাগ। তোমার চারপাশে নদী বয়ে যায় গতিময়। অমার রজনী কেটে আসবে ভোর সোনালি স্বপ্ন পূরণের দিন। নিশীথের শূন্য ডাকঘর অনিন্দসুন্দর বোধিদ্রুম। ভাঙবে ঘুম অনাদিকালের। ওষ্ঠে তুলে রাখো পবিত্র চুম্বন।


-নিউইয়র্ক, ১৭ আগস্ট ২০২৩

কমেন্ট বক্স