নিউইয়র্ক নগরের মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইপর্বে একজন তরুণ অভিবাসী এবং রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক এক গভর্নরের মধ্যে মূল লড়াইটা হবে। ওই তরুণ অভিবাসী ডেমোক্রেটিক পার্টির বামপন্থী রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। আর সাবেক ওই গভর্নর একজন মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদ।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকা এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনসভার ডেমোক্র্যাট সদস্য জোহরান মামদানি এবং সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো। নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইপর্বকে প্রগতিশীল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রক্ষণশীল ধারার পুরোনো প্রজন্মের লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২৪ জুন প্রাথমিক বাছাইপর্বের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক বাছাই কেন গুরুত্বপূর্ণ
নিউইয়র্ক নগর মূলত ডেমোক্রেটিক পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তাই বলা যায়, আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ২০২১ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে এরিক অ্যাডামস প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করেছিলেন। সেই জয়ের পর থেকে এরিক অ্যাডামস জাতীয় পর্যায়েও একটি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
নতুন মেয়রকে কী কী সামলাতে হবে
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হওয়ার অর্থ হলো, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম ও ব্যস্ততম শহরের নির্বাহী কর্মকর্তা। শহরটির নতুন মেয়র যিনি হবেন, তাকে অনেক সমস্যা ও জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে আছে আবাসন, জীবনযাত্রার ব্যয়, যানজট ও গণপরিবহন।
নিউইয়র্কবাসীর ক্ষেত্রে এ নির্বাচনের প্রভাব স্পষ্ট। তবে প্রতিবছর শহরটিতে ভ্রমণে আসা প্রায় ৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষের ওপরেও এ নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব পড়বে।
নিউইয়র্ক শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
রাজনৈতিকভাবে প্রাথমিক বাছাইপর্বের এ প্রতিযোগিতা ডেমোক্রেটিক পার্টির ভবিষ্যৎ এবং দলটির বামপন্থী অংশের প্রার্থীদের নির্বাচনী সক্ষমতা বোঝার পূর্বাভাস হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে আগামী বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং দুই বছর পর হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে এ বাছাইপর্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
নিউইয়র্কের মেয়র হওয়ার মানে দেশজুড়ে পরিচিতি পাওয়া। সর্বশেষ তিনজন মেয়রের সবাই পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক বাছাইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কারা
ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক বাছাইপর্বে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ৬৭ বছর বয়সী অ্যান্ড্রু কুমো এবং ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নরের সন্তান এবং নিজেও গভর্নর হওয়া কুমোর কর্মজীবন বিস্তৃত। ২০১১ সালে নিউইয়র্কের গভর্নর হওয়ার আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী এবং নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন।
২০২১ সালে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুমো পদত্যাগ করেন। তিনি এখন রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছেন। কুমোকে কয়েক বছর আগে পদত্যাগের আহ্বান জানানো মানুষদের সঙ্গেই তিনি আবার সম্পর্ক গড়ে তুলছেন।
কুমো তার নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন, তার মধ্যে আছে—শহরের ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করা এবং ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো।
কুমো একজন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
জোহরান মামদানি কোনো রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান নন। উগান্ডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মা–বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া মামদানি ২০২১ সাল থেকে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকা (ডিএসএ) সমর্থিত প্রার্থী।
মাত্র ৩৩ বছর বয়সী মামদানি নিজেকে এমন একজন প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারাতে পারেন। তিনি ভোটারদের মন জয় করতে আবাসন, গণপরিবহন ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিচ্ছেন।
জোহরান মামদানি নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন নিউইয়র্ক নগরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মা–বাবার সন্তান মার্কিন মেয়র।
জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডার কাম্পালায়। তিনি সাত বছর বয়সে নিউইয়র্ক নগরে চলে আসেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। তার মা মিরা নায়ার ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা, আর বাবা মাহমুদ মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
মামদানি একটি প্রগতিশীল প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বিষয়গুলোর ওপর জোর দিচ্ছেন, তার মধ্যে আছে ভাড়া স্থিতিশীল রাখা, সরকারি বাসের ফি তুলে নেওয়া এবং নগর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন সাশ্রয়ী মূল্যের মুদিদোকান তৈরি করা।
জনমত জরিপগুলোয় দেখা গেছে, ছোট দাতাগোষ্ঠী এবং বামপন্থী স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে মামদানির জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
আর কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন
ডেমোক্রেটিক পার্টির আরও যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন সিটি কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার, নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের স্পিকার অ্যাড্রিয়েন অ্যাডামস, সাবেক কম্পট্রোলার স্কট স্ট্রিঙ্গার, অঙ্গরাজ্যের সিনেট সদস্য জেসিকা রামোস, অঙ্গরাজ্যের সিনেট সদস্য জেলনার মাইরি, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও অঙ্গরাজ্যের সাবেক আইনপ্রণেতা মাইকেল ব্লেক এবং বিনিয়োগকারী হুইটনি টিলসন।
নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্তের মুখোমুখি বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
নির্বাচনে কনজারভেটিভ অধিকারকর্মী কার্টিস স্লিওয়া একমাত্র রিপাবলিকান প্রার্থী।
কোন তারিখে কী হচ্ছে
প্রথম ডেমোক্রেটিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৪ জুন। আর দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত বিতর্ক হতে যাচ্ছে আগামীকাল ১২ জুন। দলীয় বাছাইপর্বের আগাম ভোট শুরু হবে ১৪ জুন। প্রাথমিক বাছাইপর্বের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৪ জুন। মেয়র পদে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৪ নভেম্বর।
জরিপ কী বলছে
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম পলিটিকোতে ৯ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা এখন মোটামুটি পরিষ্কার, মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইয়ে এখন মূল লড়াই হচ্ছে অ্যান্ড্রু কুমো আর জোহরান মামদানির মধ্যে।
প্রতিবেদনে দুটি নতুন জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। মামদানির পক্ষের দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘ডেটা ফর প্রগ্রেস’-এর মাধ্যমে চালানো জরিপে দেখা গেছে, কুমো এখন মামদানির চেয়ে মাত্র ২ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। তবে কুমোর নিজের পক্ষের আরেকটি জরিপ বলছে, তিনি মামদানির চেয়ে ১২ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন।
‘ডেটা ফর প্রগ্রেস’ ৩০ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ৮১৯ ডেমোক্র্যাট ভোটারের মধ্যে জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে, ভোটের শুরুর দিকে কুমো ৭ পয়েন্ট এগিয়ে থাকলেও ধাপে ধাপে ভোট গণনার (র্যাঙ্কড চয়েস) শেষে কুমো ৫১-৪৯ ব্যবধানে মামদানির চয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এই জরিপে মার্জিন অব এররও (কিছুটা ভুলত্রুটি) থাকতে পারে। কারণ, দুজনের মধ্যে ব্যবধান খুবই কম।
মামদানির সমর্থক হিসেবে পরিচিত ‘নিউইয়র্কারস ফর লোয়ার কস্টস’ সুপার পিএসি এবং ‘ওয়ার্কিং ফ্যামিলিজ পার্টি’-এর জাতীয় পিএসির পক্ষ থেকে ‘ডেটা ফর প্রগ্রেস’–এর মাধ্যমে এই জরিপ চালানো হয়েছে।
ফলাফল বলছে, মামদানির দারিদ্র্য আর ধনীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি অনেক ভোটারকে আকর্ষণ করছে, বিশেষ করে যারা বাসস্থানসংকট ও দাম বাড়ার বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত। অবশ্য অনেকেই বলছেন, মামদানি তুলনামূলকভাবে তরুণ ও তার অভিজ্ঞতা কম।
নিউইয়র্কারস ফর লোয়ার কস্টসের মুখপাত্র বিল নাইডহার্ড এক বিবৃতিতে বলেন, এই জরিপ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নিউইয়র্কের মানুষ এখন জোহরান মামদানির মতো এমন একজন মেয়র চান, যিনি জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো নিয়ে ভাবেন। তারা কেলেঙ্কারিতে জড়ানো অ্যান্ড্রু কুমোর মতো এমন একজন ব্যক্তিকে চান না।
অন্যদিকে কুমোর শিবিরের পক্ষ থেকে করা জরিপে দেখা গেছে, ৬০০ ভোটারের মধ্যে চালানো জরিপে তিনি ১২ পয়েন্টে এগিয়ে। তার পক্ষে ৫৬ শতাংশ ও মামদানির পক্ষে ৪৪ শতাংশ সমর্থন জানিয়েছেন। এই সময়ে ৪ জুন প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম টিভি বিতর্ক হয়, আর ৫ জুন জনপ্রিয় কংগ্রেসওমেন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্তেজ মামদানিকে তার প্রথম পছন্দ হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ সময়ে কুমোর সমর্থক একটি সংগঠন টিভি ও মেইলে বিজ্ঞাপন চালিয়ে বলছে, মামদানি নাকি কর বৃদ্ধি করতে ও পুলিশ বিভাগের বাজেট কমাতে চান।
কুমোবিরোধী ভোটগুলোকে নিজের পক্ষে আনতে পারলে বামঘেঁষা এ আইনপ্রণেতার প্রাথমিক বাছাইয়ে জয়ের বেশ ভালোই সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং কী, কীভাবে কাজ করে
নিউইয়র্ক সিটির স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাররা এই পদ্ধতিতে একসঙ্গে সর্বোচ্চ পাঁচজন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
ভোটাররা তাদের পছন্দের কয়েকজন প্রার্থীর ক্রম নির্ধারণ করেন। যেমন প্রথম পছন্দ, দ্বিতীয় পছন্দ—এভাবে। প্রথম দফার গণনায় শুধু প্রথম পছন্দের প্রার্থীর ভোট গোনা হয়। যদি কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তাহলে সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে আবার গণনা শুরু হয়।
প্রতিটি নতুন দফার গণনায় বাদ পড়া প্রার্থীর ভোটগুলো তার ভোটারদের ব্যালটে থাকা পরবর্তী পছন্দ অনুযায়ী অন্যান্য প্রার্থীর মধ্যে বণ্টন করা হয়।
গাজা ইস্যু কেন নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে
গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ভোট দেবে বা ইসরায়েল কতটা সামরিক সহায়তা পাবে, তা নিউইয়র্ক নগরের পরবর্তী মেয়র ঠিক করবেন না।
তবু স্থানীয় নির্বাচনে মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতের প্রভাব পড়বে।
মামদানি জোরালোভাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন। তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ২০২৩ সালের নভেম্বরে হোয়াইট হাউসের বাইরে অনশন করেছিলেন।
জোহরান মামদানির এমন অবস্থানের কারণে ইসরায়েলের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও রিপাবলিকান পার্টির নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের সদস্য বিকি প্যালাডিনো সম্প্রতি তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার দাবি জানান।
প্যালাডিনোর ওই বক্তব্যের বিরুদ্ধে অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। এর জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, ফিলিস্তিনপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে মামদানির সম্পৃক্ততা থাকায় তিনি নাগরিকত্বের যোগ্য নন। সূত্র: আল জাজিরা
ঠিকানা/এসআর