Thikana News
২৪ মে ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

ভালোবাসার চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু নাই

সঠিক মানুষ চিনতে প্রায়ই আমরা ভুল করি। যার কাছে কিছু প্রত্যাশা করি, দেখি সেই প্রত্যাখ্যান করে। যার কাছে প্রত্যাশা করি না, সেই পাশে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে সব সময় কিছু রহস্য থাকে। মানুষের চরিত্রের রহস্য, সম্পর্কের রহস্য, মনের রহস্য, প্রকৃতির রহস্য। এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করা যায় না। মাঝে মাঝে এমন হয়, সামান্য কারণে হতাশায় ভেঙে পড়ি, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাই। মনে হয়, এই হতাশা কাটিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না।
ভালোবাসার চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু নাই
আমি মারা গেলে আমার জন্য কেউ কি কষ্ট পাবে! আমি চাই রোগে-শোকে কষ্ট না পেয়ে, কাউকে কষ্ট না দিয়ে হুট করে চলে যেতে। ঘুমের মধ্যে হলে আরও ভালো। মৃত্যুর আগে কি আমার প্রিয় দুই সন্তানের মুখ দেখতে পাব! আমার আশা কি পূরণ হবে! আমি চাই আমার বাবার কবরে শায়িত হতে। কিন্তু আমি জানি না আমার আশা পূরণ হবে কি না। কিছুই জানা যায় না। সবকিছু অনিশ্চিত। অর্ক, অরিত্রি ফেসবুক করে না, জেসমিন ফেসবুকে তেমন অ্যাকটিভ নয়, কখনো কিছু পোস্ট দেয় না। তাই আমি মারা গেলে দ্রুত কেউ জানবে না। আত্মীয়রা জানবে। তাদের মাধ্যমে অন্যরা জানলেও জানতে পারে। আমার ফেসবুক বন্ধুরা যখন জানবে, তখন যথানিয়মে ইন্না লিল্লাহ...রাজিউন লিখবে। সবাই কষ্ট করে লিখবে না। কেউ কেউ অন্যের লেখা থেকে কপি করে পেস্ট করে দেবে। নিয়মরক্ষা। আমিও এমন করি। যারা আমাকে চেনে, যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সখ্য হয়েছে, তারা একটু কষ্ট পাবে। যাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কাজ করেছি, তারাও ব্যথিত হবে। বিশেষ করে, আমার বিচিত্রার বন্ধুরা। যাদের কষ্ট দিয়েছি, তারা হয়তো মাফ করে দেবে আমাকে। আমি নিজে কারও ওপর রাগ-ক্ষোভ পুষে রাখিনি। নিজের ভুলের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি অনেক আগেই। যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়তেন, তাদের একটু খারাপ লাগবে বৈকি। ভাববে, আহা মানুষটা চলে গেল! আর লেখা পড়তে পারব না! তারপর দ্রুতই ভুলে যাবে। কাউকে দীর্ঘদিন মনে রাখা কঠিন।

টরন্টোতে মারা গেলে আত্মীয়রা বাসায় আসবে। জেসমিন কাঁদবে হয়তো। অর্ক ছুটে আসবে, অরিত্রি আসবে আমেরিকা থেকে। জেসমিনকে সান্ত্বনা দেবে। লাশ হিমঘরে থাকবে একলা, তারপর মসজিদে জানাজা ও দাফনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে। আমার টরন্টোর বন্ধুরা ফেসবুকে খবর দেবে। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে কাফনে ঢাকা মুখটা দেখতে চাইবে। মৃত্যুর পর দেখতে কেমন লাগবে, কে জানে! বরিশালে আত্মীয় বন্ধুরা ফোন করে খবর নেবে। আহা চলে গেল বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। কেউ কেউ দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলবে। যেসব মসজিদে আমি দান করতাম, সেগুলোতে হয়তো একদিন দোয়া হবে। টরন্টোর যে দুটি হাসপাতালে আমি ডোনেট করতাম, তারা হয়তো জানবেই না। দেশের দু-একটি খবরের কাগজে মাঝের পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলামে নিউজ হলেও হতে পারে। টরন্টো বা আমেরিকার যেসব পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখেছি, তারা প্রথম বা শেষের পৃষ্ঠায় নিউজ ছাপতে পারে। টিভির খবরেও বলতে পারে হয়তো। সবই অনুমান করি। এমনটা নাও হতে পারে। একদিন আমার এই প্রিয় শহরের বন্ধুরা হয়তো একটা স্মরণ সভা করবে। সেখানে আমাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণা হবে। লেখালেখি নিয়ে তেমন কথা হবে না। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা বেশি হবে। সবার মুখ থাকবে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর, শোকের একটা আবহ থাকবে। সেই অনুষ্ঠানে জেসমিন উপস্থিত থাকলে মাথায় ওড়না দিয়ে নীরবে বসে থাকবে, সবার কথা শুনবে, নারীরা ওকে ঘিরে থাকবে। তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষে সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে যাবে। শোকের আয়ু বেশি দিন বা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।

জেসমিন বড়জোর এক-দুদিন কাজে যাবে না। আত্মীয়রা খাবার পাঠাবে প্রথম এক-দুদিন। অর্ক অনেক কষ্ট পাবে কিন্তু ভেঙে পড়বে না। বড় সন্তান বলে সে শক্ত থাকবে, মা আর বোনের পাশে দাঁড়াবে, যা সাধারণত সে করে থাকে। খাতিজা আর সাদ কষ্ট পাবে। মনে মনে ভাববে, আমাদের অনেক আদর করত মানুষটা। প্রতিদিনের একঘেয়ে রুটিন জীবন থেকে জেসমিন মুক্তি পাবে। কেউ আর খাওয়াদাওয়া নিয়ে ত্যক্ত করবে না। প্রতিদিন ফ্রেশ রান্না করতে হবে না। এটা খাব না, ওটা খাব না বলে বায়নাক্কা থাকবে না। সবকিছু মিলিয়ে একধরনের স্বস্তির জীবন ফিরবে। দীর্ঘ অভ্যাসের পরিবর্তন হবে। একদিন সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শোক ভুলতে না পারলে মানুষ বাঁচতে পারত না। জেসমিনও শোক ভুলে যাবে। আবার হাসবে, বেড়াবে, প্রিয় খাবার রান্না করবে। গভীর রাতে কখনো হঠাৎ মনে পড়বে, লোকটা বড্ড জ্বালিয়েছে সারা জীবন। এখন আর জ্বালাতন করার কেউ নাই। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার সংগ্রহের বই বা আমার লেখা বইগুলো সরিয়ে ফেলবে শেলফ থেকে। ওগুলোর স্থান কোথায় হবে, অনুমান করতে পারি। কে আর জঞ্জাল বহন করে বেড়ায়! আমার ব্যবহৃত কাপড়চোপড়, জুতা স্যান্ডেল স্যালভেশন আর্মিতে দান করে দেবে। আমার কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক, লেখার টেবিল, নোটবুক সরিয়ে ফেলবে। অপ্রকাশিত লেখাগুলো কোনো দিন আর আলোর মুখ দেখবে না। বছর ঘুরে মৃত্যুদিবস আসবে। প্রতিবছর আসবে। তত দিন কি আর কেউ মনে রাখবে! মনে হয় না। যাদের সঙ্গে ফেসবুকে ছিলাম, তারা অবচেতনে আনফ্রেন্ড বাটনে চাপ দেবে। যাদের কাছে আমার ফোন নম্বর ছিল, তারা ডিলিট করে দেবে। ফেসবুককে বলা আছে আমার মৃত্যুর পর আমার অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলতে। ইনস্টাগ্রামে আর নতুন কোনো ছবি পোস্ট থাকবে না। যেসব সাইটে নিয়মিত লিখতাম, যেমন বিসিসিবি, পেন্সিল, পোয়েম ওয়ার্ল্ড, প্রবাসী কণ্ঠ; সেখানে নতুন কোনো লেখা থাকবে না আর। যেসব পত্রিকায় নিয়মিত লিখছি আর কখনো লেখা ছাপা হবে না। একদিন সবাই ভুলে গেলেও গুগল কখনো ভুলবে না। সার্চ বাটন চাপলে ভেসে উঠবে নাম, পরিচয়, ছবি আর বইয়ের প্রচ্ছদ। আরেকজন কখনো ভুলবে না, সে হচ্ছে অরিত্রি। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে অরিত্রি কিন্তু প্রকাশ করবে না। বাসায় এলে আর কখনো বলবে না, বাবা চা বানাও।

সঠিক মানুষ চিনতে প্রায়ই আমরা ভুল করি। যার কাছে কিছু প্রত্যাশা করি, দেখি সেই প্রত্যাখ্যান করে। যার কাছে প্রত্যাশা করি না, সেই পাশে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে সব সময় কিছু রহস্য থাকে। মানুষের চরিত্রের রহস্য, সম্পর্কের রহস্য, মনের রহস্য, প্রকৃতির রহস্য। এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করা যায় না। মাঝে মাঝে এমন হয়, সামান্য কারণে হতাশায় ভেঙে পড়ি, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাই। মনে হয়, এই হতাশা কাটিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। গভীর শঙ্কা নিয়ে জীবন যাপন করি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাই। খাওয়া থাকে না, ঘুম থাকে না এমন হয়। মনে হয়, জীবনের আশা, স্বপ্নের এখানেই সমাপ্তি। জীবনে আসলে নিরবচ্ছিন্ন কোনো সুখ নাই। নিরবচ্ছিন্ন দুঃখও নাই। যখন খুব কাছের মানুষও তুচ্ছ কারণে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেয়, তখন কষ্ট পাই। কিন্তু কারও ভুল শুধরে দিতে যাই না। জানি, একদিন সে তার ভুল বুঝতে পারবে বা হয়তো কখনোই বুঝবে না। এটাই জীবন। আমিও অনেক ভুল করি। কোনো একটা সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয়। বন্ধু চিরকাল বন্ধু থাকে না, স্বামী-স্ত্রী চিরকাল স্বামী বা স্ত্রী থাকে না, প্রেমিক থাকে না প্রেমিক, আত্মীয়তার সম্পর্কও ভেঙে যায়। ভাই-বোনের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়। এই বৈপরীত্য নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। তবে যতই হাতাশায় আক্রান্ত হই না কেন, যতই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বিরাট বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, যতই মনে হোক না কেন জীবনটা বুঝি শেষ হয়ে গেছে। তার পরও মনের গহিন কোণে সব সময় একটা আশার প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলে। মনে মনে ভাবি, একদিন ঠিক হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারব, বিপদ থেকে মুক্তি পাব। মাথার ওপর ভেঙে পড়া আকাশটা হঠাৎ দূরে সরে যাবে। এভাবেই বিপদ থেকে মুক্তি মেলে মানুষের। জীবনে বিপদ-আপদ থাকে, আবার মুক্তিও থাকে। জীবন এমনই দু’হাত ভরে দেয় আবার কেড়েও নেয়। একটা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে দুটো দরজা খুলে যায়। জীবনে কিছুই অনিবার্য নয়। কেউই অনিবার্য নয়। কারও জন্যই জীবন থেমে থাকবে না। কোনো কিছু না পেলেও জীবন বৃথা হয়ে যায় না। একসঙ্গে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর সংসার করার পরও কেউ একজন চলে গেলে অপরজন দিব্বি বেঁচে থাকে। আমার জীবনটা সব সময় মিরাকল। শিশুকাল থেকেই। আমার স্বপ্নের কথা কেউ জানে না। খুব সঙ্গোপনে এসব আমি লালন করি। আজও তা অব্যাহত আছে। যেহেতু আমার চাওয়াগুলো ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, তাই যা পাই সেটাই আমার কাছে বড় হয়ে আসে। আমি মানুষের ভালোবাসা যতখানি পেয়েছি বা পাই, তার কাছে ছোট ছোট অবহেলা, উপেক্ষা অতি তুচ্ছ। ওসব নিয়ে আর ভাবি না। ভালোবাসলেই ভালোবাসা পাওয়া যায়। আমি শুধুই ভালোবাসায় বাঁচতে চেয়েছি। ভালোবাসার চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু নাই।
-টরন্টো
 

কমেন্ট বক্স