Thikana News
০৩ মে ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০৩ মে ২০২৫

সুযোগসন্ধানীর সাহিত্যদর্শন

সুযোগসন্ধানীর সাহিত্যদর্শন
সুযোগসন্ধানীদের স্বরূপ বলতে এমন ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা সব সময় নিজস্ব সুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের জন্য সুযোগ খোঁজে। সুযোগ বুঝে অন্যদেরকে কৌশলে ব্যবহার করে এবং নিজের সুবিধা ও লাভকে তুলে নেয়। সাধারণত এ শ্রেণির লোক নীতিহীন ও স্বার্থপর হয়ে থাকে। নিজস্ব স্বার্থের বাইরে অন্যের সুবিধার ধার ধারে না। বরং নিজের সুবিধাটাকেই প্রাধান্য দেয়। চিন্তা ও চেতনায় কীভাবে নিজের লাভ হবে, সেটাই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। এমনকি কারও উপকার করলেও তার পেছনেও তাদের হীন স্বার্থ লুকানো থাকে। তারা পরিস্থিতি বুঝে রং বদলায়, যখন যে পরিবেশে কেমন আচরণ করলে লাভ হবে, তারা সেই অনুযায়ী নিজের আচরণ, বোল ও মত পাল্টে ফেলে। ফলে তাদেরকে বিশ্বাস করা কঠিন।
এ ধরনের সুযোগসন্ধানী লোকদের ওপর কোনো ভরসা করা যায় না, কেননা যেকোনো মুহূর্তে নিজের স্বার্থের জন্য তারা পেছন থেকে ছুরি মারতে দ্বিধা করে না। বন্ধুত্বের প্রশ্নেও এদের সম্পর্কের কোনো স্থায়িত্ব নেই। তারা শুধু তাৎক্ষণিক লাভকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যেকোনো শ্রেণি-পেশার লোকের মধ্যেই সুযোগসন্ধানী রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করাটাও কিন্তু বিপজ্জনক! ফলে বর্তমান লেখার শিরোনাম পাঠককে হোঁচট খাওয়ার জন্য নয়, আমাদের বোধগম্য হওয়ার পথটাকে মসৃণ করার লক্ষ্যে অবতারণা।
বর্তমান সময়ে সাহিত্যজগতের অবস্থা এতই করুণ ও স্পর্শকাতর, যা ভাবলে মনে হবে সাহিত্যের আত্মহনন। ইদানীংকালের সুযোগসন্ধানী কবি ও লেখকের চালচলন, আচার-আচরণ, লেখার স্টাইল, ফর্ম-ফরম্যাটের ওপর কোনো মন্তব্য না করাই ভালো। তাদের সম্পর্কে কিছু বলা মানে উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো। সাহিত্যে কিংবা সুশীল সমাজের যেকোনো সেক্টরে সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশ এবং সাহিত্যাঙ্গনের দুর্বৃত্তায়ন সম্পর্কে কোনো কথা বলাটাও রীতিমতো বিপজ্জনক। আবার শিল্প-সাহিত্যের নানা রকম বৈষম্য ও বৈপরীত্যের চিত্র দেখে চুপ থাকা যায় না। তাই বিবেকের তাড়নায় তবু দুয়েকটি কথা বলা দরকার মনে করছি।
কোনো লেখক যদি বুঝেশুনে লোভী ও সুযোগসন্ধানী হয়ে যান, তখন কষ্ট লাগে। তাদের অনেকের সুবিধাভোগী চিন্তা এবং ভাবসাব দেখলে লজ্জা পাই। তখন আমার দুঃখবোধের সীমা থাকে না। যদিও স্বার্থান্ধ লোকেরা সেসব কেয়ার করেন না। নিজের স্বার্থে ব্যস্ত থাকেন। প্রকৃত সাহিত্যদর্শনের ওপরও সুবিধাবাদীদের কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না এবং এখনো নেই। মননশীল ও মানবধর্মী সাহিত্যদর্শনে তাদের কোনো অনুশীলন নেই। সরকারি তোষামোদের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধাকে নিজের লেখার মধ্য দিয়ে পদক-পদবি এবং নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা আয়ত্ত করার কৌশলকে সামনে রেখেই তারা বিভিন্ন ধরনের বিষয়ে লিখে থাকেন।
একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির কল্যাণধর্মী আদর্শ বিলুপ্তির পথে। আগেকার জনকল্যাণমুখী রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো মিল নেই। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দলগুলোর মূল টার্গেট হচ্ছে ক্ষমতা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ এবং সেই ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার মাধ্যমে নিজস্ব লোভ-লালসা ও স্বার্থ চরিতার্থ করার তীব্র মানসিকতায় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক। সুবিধাবোধ নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করলেও ক্রমে ক্রমে তা ক্ষমতাসীনদের হাতে চলে যায়। এটাও আমাদের কালচারে পরিণত হয়ে গেছে যে সুযোগসন্ধানীদের সুবিধার কোনো সাইড না থাকলে রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ হয় না! আমাদের সমাজে রাজনীতির সুশীল ধারার অবনতি ও ক্রমাগত বিলুপ্তির দিকেই চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের মানসিক অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, কতিপয় পেশাদার সরকারের সুবিধাভোগী লোকদের দৌরাত্ম্য লক্ষণীয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই সুবিধাভোগীরা কথা বলেন না। শুধু সরকারের গুণগান করে থাকেন। তাদের অনেকে গুণকীর্তনের জন্য ভাড়া খাটেন।
শিল্প-সাহিত্যে সুবিধাবোধ ছিল। কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তার জলাঞ্জলি ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনীতির আদর্শের সঙ্গে একীভূত হয়ে এমন নগ্নভাবে কবি-সাহিত্যিকের লেজুড়বৃত্তি আগে খুব একটা দেখা যায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের মতো সুবিধাবাদী কবি-সাহিত্যিকদের এমন নগ্ন রাজনৈতিক রূপ ব্রিটিশ আমলেও ছিল না। এর ফলে বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ ও উন্নতি সাধন বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো একটা টানাপড়েন চলছে।
বর্তমানে শিল্প-সাহিত্যে সুবিধাবোধ ঢুকে পড়েছে। রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যাদর্শকে সুবিধাভোগীদের মিশিয়ে গুলিয়ে ফেলে কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। আমার দৃষ্টিতে কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের উচিত দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থাকা। কিন্তু তা না করে বিশাল সাহিত্য পরিসরকে একপেশে করে রেখে কতিপয় সুবিধাভোগী কবি-সাহিত্যিক রাষ্ট্র ও সমাজের সকল সুবিধা নিজেদের পকেটে নিয়ে নিয়েছেন। সৃজনশীল সাহিত্য রচনা এবং পাঠ্যসূচির সিলেবাস প্রণয়নের কাজেও ক্ষমতাসীনদের দাসত্বের ওপর ভিত্তি করেই সবকিছু করা হয়।
সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্য গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই প্রয়োজন। দেশের প্রকৃত সাহিত্যবিশারদ, বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে সেই চর্চা হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেটি নেই বললেই চলে। সাহিত্যে মানুষের মনের মাঝে একটা উজ্জ্বলতম পরিবর্তনের দোলা দেয়, যা মানুষের সামগ্রিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। সাহিত্য মনের দর্পণ। মনের খোলা জানালা, যা দ্বারা মানুষের সব ধরনের আবেগ ও অনুভূতিময়তার প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। যেমনটি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছেন :
‘The purpose of playing„ is to hold, as Õtwere, the mirror up to nature.’
‘নাট্যকলা ও শিল্প-সাহিত্যের উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির সামনে একটি আয়না ধরে রাখা।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বর্তমান বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চায় সেসবের ন্যূনতম দৃষ্টান্ত নেই। একজন আরেকজনকে ডিঙিয়ে নিজের সুনাম অর্জন ও সুবিধার পথকে প্রশস্ত করার জন্য সবাই ব্যস্ত।
সাহিত্যজগতের মধ্যেও যে সুবিধাবাদ ও সুযোগসন্ধানের ব্যবস্থা গেঁথে দেওয়া হয়েছে, ব্রিটিশ আমল থেকেই আস্তে আস্তে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পাকিস্তান আমলে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন স্তরে সীমিত আকারে সুযোগসন্ধানীদের ভূমিকা থাকলেও বর্তমান বাংলাদেশে তার প্রভাব অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত বছরগুলোতে সরকারের লেজুড়বৃত্তিমূলক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের মুখচেনা কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রভূত সুযোগ-সুবিধা নিতে ভুল করেননি। সেটি ক্রমাগত প্রকট আকার ধারণ করেছে। 
বিগত বছরগুলোর বইমেলায় প্রকৃত কবি-সাহিত্যিকদের দেখা না মিললেও পদক-পদবিধারীদের উৎকট ও নির্লজ্জ পদচারণে রমনার নরম মাটির সিক্ত পরিবেশ নির্লিপ্ত, নিষিক্ত আঁধারে হাবুডুবু খেয়েছে। দেশের সুবিধাবঞ্চিত সুশীল সাহিত্য সমাজ উগ্র সুবিধাবাদী বখাটেদের বিষাক্ত বাতাসে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তারা এখন আর বইমেলায় যান না। অনেকে চাইলেও বখাটেদের উপদ্রবের ভয়ে যেতে পারেননি। উগ্র রাজনীতির ধ্বংসনিকষ উৎপাতে এবং প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে সমাজ ও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। একজন পাঠক যখন মেলায় আসেন নিজের পছন্দের বইটির সন্ধান করে, কিন্তু অধিকাংশ পাঠক সেটি থেকে বঞ্চিত ও প্রতারিত হন।
সুবিধাবাদীদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকে। তাদের লেখাগুলো যখন প্রকাশিত হয়, সেগুলোকে অতিমাত্রিক প্রচারণার মাধ্যমে বাজারজাত করার ব্যবস্থা থাকে। অপরদিকে সিংহভাগ লেখকের ভালো বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে না। এমন প্রচলনও রয়েছে, সুযোগ-সুবিধার জন্য কেউ কেউ ভাড়া খাটেন। তাদের লেখায় কোনো কোনো বিত্তবান নিজের নামের সঙ্গে লেখক পদবিতে ভূষিত হয়ে যান। তাদের সেসব লেখালেখির মাল-মসলা, রসদ-পানিজল পূর্ব থেকেই (পরিকল্পিতভাবে) ঠিক করা থাকে। পাঠক ও বইয়ের ক্রেতা বাছাইয়ের এ রকম নগ্নরূপ যত চলতে থাকবে, বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ ও উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। পাঠক যখন সেসব পড়তে থাকেন, লজ্জিত হন। অন্তরে দুঃখ জাগে এবং জাতীয় জীবনের গ্লানিবোধ চাঙা হয়ে ওঠে। সুবিধাভোগীদের অপকর্মের ফলে সংক্ষুব্ধতায় সুশীল সমাজের অনুভূতি যখন নাড়া দিয়ে ওঠে, সেগুলোকে গোপন করাও মুশকিল হয়ে পড়ে। তিক্ত হলেও সত্যি, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির প্রবৃদ্ধিতে সুশীল সমাজ ও সংস্কৃতিমানরা নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসছেন না। বরং যা আছে, বেশির ভাগ কোনো না কোনো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের বর্তমান লেখক সমাজ এ দুটি ধারার মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক আদর্শের ক্রমবর্ধমান লোভনীয় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছেন।
শিল্প-সাহিত্যের আসল প্রাণ হচ্ছে প্রেম, প্রকৃতি, পৃথিবী, মানুষ ও মানবতা। কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নির্মোহভাবে মানুষের কল্যাণ সাধন। সাহিত্য যেমন সবার জন্য সর্ববিস্তারী, তেমনি জনতা-পাঠক ও লেখকের মিলনবিন্দু। একজন বোদ্ধাপাঠক যখন বই পড়তে শুরু করেন, তার হৃদয় ও মননজগতে লেখকের ছবিটি ভেসে ওঠে। চোখে কখনো না দেখলেও লেখকের কল্পিত ছবিটিও পাঠকের চতুর্দিকে ঘোরাঘুরি করে। তার জীবনসত্তার সৌম্যচিত্রে প্রকৃত প্রেম এবং মানবসত্তার শুদ্ধতম মানসকে লালন করার আলো ঝলকিত হয়ে ওঠে। পাঠকের অনুভূতিময়তায় শুদ্ধ সুন্দর অস্তিত্বভিসারী অন্বেষণের আলো-ছায়া উঁকি দিতে থাকে। আবার যখন কোনো সমাজ ও মানবতাবিরোধী কোনো লোকের হেন কর্মকাণ্ড চলতে থাকে, তখন সেই সঙ্গে তার কুৎসিত চেহারাটিও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
বিগত ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে (অনেক দিন পর) স্বদেশে গিয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যখনই মেলায় গিয়েছি, আমার উপলব্ধি হয়েছে, বইমেলার প্রাণশক্তির বিলোপ ঘটিয়ে সাহিত্যের প্রকৃত ইমেজ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, বইমেলা সুবিধাভোগী কবি-সাহিত্যিক ও নষ্ট রাজনীতির তোষণনীতিতে প্রাধান্য দিয়ে উঠতি বয়সী চেংরা বখাটেদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। যেখানে সাহিত্যের প্রাণশক্তির চিহ্ন নেই। কিন্তু সুবিধাবাদীদের সরকারি দাসত্বের নমুনায় একই ধাঁচের প্রাণহীন সাহিত্যের গ্রন্থমালার সমাহার। বইমেলায় ঘুরতে আসা মানুষের ভিড় থাকলেও প্রকৃত সাহিত্যিক, পাঠক ও ভালো বই ক্রেতার খুব অভাব যেন প্রকট হয়ে উঠেছে।
বইমেলা হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। সেই তরুণতম সময় থেকে অমর একুশে বইমেলায় যোগদান করে আসছি। কিন্তু আমেরিকায় যাওয়ার পর স্বদেশের বইমেলায় নিয়মিত যোগদান করা সম্ভব হয়নি। প্রবাসের ঝক্কি-ঝামেলায় ন্যস্ত থাকার ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর বাংলাদেশে আসা-যাওয়া সম্ভব হয়নি।
যা-ই হোক, চির কাক্সিক্ষত জাতীয় বইমেলায় দেখা গেল লেখক-প্রকাশক ও অংশগ্রহণকারীদের ভিড়। আগের মতোই প্রায়, কিন্তু বাড়তি কিছুর মধ্যে ডিক্টেটর মেশিনের চেকিংয়ের ব্যবস্থার কঠিন সিকিউরিটি সিস্টেম চোখে পড়ার মতো। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাহারার ব্যবস্থা। পাশাপাশি মাঝেমধ্যে সরকারি দলের লোকজন (নারী-পুরুষ) দলবেঁধে বইমেলায় প্রবেশের রমরমা পদ্ধতির নিরঙ্কুশ উপস্থিতি। কোনো কোনো সরকারি আমলা কিংবা ব্যাংকারসহ কিছু পেশাজীবী লেখকের বই প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট স্টলে লোকদেখানো উপচে পড়া ভিড় দেখানোর দৃশ্য অনেকের কাছে ভীষণ বিরক্তিকর। অথচ বইমেলায় সেসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। পাঠক ও জনগণের পাল্স বোঝার ক্ষমতাটিও সুবিধাবাদীদের নেই। তারা শুধু নিজের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ।
ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা, মাতৃভাষার সংরক্ষণ, স্বাধিকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও চেতনার মাস। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকায় পাকিস্তানি শাসকের পুলিশি গুলিতে কয়েকজন সূর্যসন্তান শাহাদাত বরণ করেন।
সেই থেকে শহীদ স্মরণে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটিকেই ভাষাশহীদ মাস হিসেবে পালন করা হয়। আর তাকে পুঁজি করেই বইমেলায় সরকার ও তার অনুগতদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ, বিকাশ এবং জাগরণের প্রত্যাশায় গোটা ফেব্রুয়ারি মাস বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। আসলে এতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলেও সুবিধাভোগীদের জয়জয়কার নিশ্চিত হয়। এ মাসটি বাঙালির আবেগ ধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যুক্ত হয়েছে বাংলা অমর একুশে বইমেলা। আমাদের দেশে প্রধান যে উৎসবগুলো পালিত হচ্ছে, বইমেলাও সে রকম আনন্দের আবহে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
বইমেলার কথা মনে হলেই চোখে ভাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ। যদি ফিরে তাকাই ছাত্রজীবনের তরুণতম সময় আশির দশকের দিকে। সৃজনশীল প্রকাশনা সাহিত্যের জাগরণের উন্মেষ যদিও আরও আগে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের বইমেলার দিকে তাকালে দেখা যাবে, কীভাবে বাংলাদেশের সাহিত্য সম্প্রসারণের পথ খুলে যায়। প্রকাশনা ব্যবসায় যুক্ত থাকা এবং প্রতিবছর বইমেলায় অংশগ্রহণ করার বদৌলতে মোটামুটি ধারণা করা যায়, তখনকার বইমেলার চরিত্র ও সাজসজ্জা ছিল একেবারেই আলাদা। যেখানে শুধু বই, লেখকের ব্যাপক উপস্থিতি এবং জনসাধারণের সমাগম। তখন লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক ছিল উচ্ছ্বসিত ও প্রাণবন্ত। তখন বইমেলা হতো কেবল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং টিএসসির সামনের রাস্তায় বিক্রি হতো ভারতীয় বাংলা বই-পুস্তক থেকে শুরু করে নানা রকমের মনিহারি পণ্য। যদিও বর্তমানে ভারতের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে সেটি নানামুখী অঙ্গনে ছড়িয়ে আছে। হিন্দি কালচারের বৃত্তবিন্দু থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে ভারতের পাইরেসি বই-পুস্তক সয়লাব হয়ে আছে।
২০২২ সালের বইমেলায় গিয়ে আরও বেশি লক্ষণীয় ছিল মেলার সিকিউরিটি সিস্টেম। ইদানীংকালের বইমেলার মতো এত টাইট সিকিউরিটির ব্যবস্থাও তখন ছিল না। তবে সব সময়ই লেখক-পাঠক ও সর্বস্তরের মানুষ বইমেলায় আসেন এবং বইমেলা উপভোগ করেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে যত সৃজনশীল বই প্রকাশিত হয়, সেই তুলনায় পাঠক বৃদ্ধি পায়নি, বরং ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। এবারের বইমেলায় একটি বিশেষ দিক চোখে পড়ল। পাঠকের চেয়ে কতিপয় সরকারি দালালগোছের মুখচেনা লেখক এবং তাদের ভক্ত অনুসারীর আনাগোনা। আগের তুলনায় স্বনামধন্য সিনিয়র বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের সংখ্যা অপ্রতুল। যেখানে সেখানে লেখক নামে নতুন নতুন সুযোগসন্ধানীর পদচারণা। তাদের ভক্ত-অনুরাগী যেমন তৈরি হয়, তেমনি তাদের হয়ে কাজ করে একশ্রেণির সুবিধাভোগী। মুখচেনা লেখকদের সঙ্গে সরকারের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশও থাকে। তাদের মাধ্যমে অখ্যাত লোকদের বইও বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়।
ইদানীং আমরা যারা লিখছি (নামকরা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকসহ) তারা নিজেদের বইয়ের প্রচার নিজেরাই করেন। বইমেলায় আগেকার বড় মাপের লেখক এখন আর চোখে পড়ে না। যারা বাংলা সাহিত্যের সম্মান ও মর্যাদাকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, বইমেলায় তাদের পদচিহ্ন নেই। যাদের ত্যাগ ও মননের ফলে বাংলা একাডেমি ও একুশে বইমেলার উৎপত্তি, তাদের নিয়ে ভিন্ন কোনো গ্যালারি কিংবা আর্কাইভ নেই। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে বাংলা সাহিত্যের কবি, লেখক ও সাহিত্যিক এবং তাদের অবদান নিয়ে অধিকতর সভা-সেমিনারের ব্যবস্থা খুব একটা ব্যবস্থা নেই। বইমেলা চলাকালীন বই-পুস্তকের সমাহারের সাথে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন রকমের সাহিত্য সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠান।
একইভাবে বইমেলায় যারা বাংলা সাহিত্যের সুউজ্জ্বল আদর্শ নিয়ে শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন, তাদের বই পাওয়া যায় না! যাদের সাহিত্য পড়ে আমরা বড় হয়েছি, বর্তমান সুবিধাভোগীদের দৌরাত্ম্যে সেই সব কিংবদন্তি লেখকের সাহিত্যের প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি নেই। তাদের দায়বদ্ধতা এখন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য নেই। তাদের সকল দায় সরকারের সুবিধাভোগী কথিত সুশীলদের প্রতি। যারা সরকারের অন্যায়, অত্যাচার ও অসংগতির বিরুদ্ধে কথা বলেন না।
বইমেলায় সেই সব সুবিধাভোগী লেখকের জয়জয়কার (!) এবং তাদের বইয়ের ছড়াছড়ি ছিল লক্ষণীয়। কোনো রাজনীতিক লেখক, ব্যাংকার অথবা এমন রাতারাতি বিত্তবান হয়ে যাওয়া নবাগত লেখকের পেছনে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মিডিয়ার নির্লজ্জ কৃত্রিম প্রচারণায় স্তুতির সেতু নির্মিত হয়। বিপরীতে সুশীল, শুদ্ধাচারী সর্ববিস্তারী লেখকের মর্যাদা উপেক্ষিত হয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যাদের আদর্শের কথা বলতেন, তাদের সম্পর্কে বই-পুস্তক রচিত হয় না। রচিত হয়, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতা ও তোষণ কাসুন্দির কল্পিত রচনা।
প্রকৃত লেখকের অনুপস্থিতিতে আমাদের সমাজের চক্ষুষ্মান বুদ্ধিজীবীরাও আপাতসাধারণের পথ থেকে সরে গিয়ে যখন দুর্বোধ্যতার দিকে ধাবিত হন। তখনই আসল পাঠকের সাথে লেখক সাহিত্যিকের একটা অদূরপণীয় দূরত্ব ও অন্তরাল সৃষ্টি হয়ে যায়। অনেক বছর পর বাংলাদেশের বইমেলার দৃশ্যপট আমাকে যেমন আপ্লুত করেছে, তেমনি একপেশে সাহিত্য সম্ভারের উদগ্র সমারোহে বিব্রতকর হতে হয়েছে।
সাহিত্যের নিজস্ব গণ্ডি বলতে কিছু নেই। সাহিত্য সর্ববিস্তারী। এটাকে একপেশে একচোখা করে রাখাই অর্বাচীনতা। এ ধরনের মানসিকতা পোষণকারী লেখক ও কবির টার্গেট থাকে নিজস্ব আত্মপ্রকাশের সঙ্গে পদক কিংবা পুরস্কার হাতিয়ে নেওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা। বর্তমান সময়ের কোনো কোনো কবি ও সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে সেটি বেপরোয়া নির্লজ্জতার দিকে ধাবিত হতে দেখা যায়। কবিতার ক্ষেত্রে সেটি আরও কঠিনতম সত্য।
কবিতার সৌন্দর্য অবশ্যই সর্বজনবিদিত এবং সর্ববিস্তারী। কবিতার শক্তিমত্তার সৌন্দর্যকে যে যত বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারবেন, পাঠকদের নিকট থেকে তিনি যথাযথ ক্রেডিট পাবেন। তিনি পাঠকের কাছে ততই বেশি গ্রহণীয় হবেন।
নির্মল সৃজনশীলতার নিরীক্ষাধর্মী নিরন্তর আখ্যান তৈরি করাই কবির কাজ। কবি কখনো উগ্রচণ্ডী মনোভাব পোষণ করতে পারেন না। কবি কখনো অন্যকে আঘাত করার মাধ্যমে কারও পথের কাঁটা, মতের কাঁটা ও চক্ষুশূল হওয়ার জন্য নয়। কাব্যের গুণমান সৃষ্টিকে সুউচ্চ, অম্লান, তৃপ্তিকর করে তোলাই মূলত কবির বাহিত জীবনের অন্যতম কাজ ও প্রধান চরিত্র হওয়া উচিত।
কবি তা না করে যদি প্রচারমাধ্যমের একেশ্বরবাদী, একচোখা হয়ে যান; কবি যদি কতিপয় লৌকিক উপহার-উপঢৌকনের সার্থক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিলাসের মহিমাকীর্তনের হাতিয়ার হয়ে যান; এ ধরনের হীনম্মন্য মানসিকতা গণবিরোধী, অনুর্বর ও অমানবিক। এমন মানসিকতা সাহিত্যের আদর্শ পরিপন্থী, ক্ষতিকর এবং সাহিত্যবিকাশের পথের কাঁটা ও অন্তরায়।
কবির মধ্যে যেমন মানুষ, প্রাণিকুল ও প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেম ও নিখাদ ভালোবাসা থাকা বাঞ্ছনীয়, তেমনি অন্যায় ও অমানবিকতার প্রতিবাদের ভাষা থাকতে হয় কঠোর ও শাণিত। যে ভাষায় সমগ্র মানবসত্তা জেগে উঠতে পারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য কবিতার ভাষার মতো শক্তিশালী আর কিছু নেই। শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। মানুষের ভাষার শক্তিমত্তার কাছে সবকিছুই হার মানতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে থমাস জেফারসন বলেন,
‘যখন অনিয়ম, দুর্নীতি একটা আইন হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে প্রতিবাদ করা একটা দায়িত্ব বনে যায়।’
আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তি মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন,
‘যতক্ষণ না আমাদের পৃথিবীতে দারিদ্র্য, অন্যায় এবং স্থূল বৈষম্য অব্যাহত থাকবে, আমরা কেউই সত্যই বিশ্রাম নিতে পারি না।’
শিল্প-সাহিত্য বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বই। উন্নত মানের সাহিত্যচর্চা ও রচনায় গণমানুষের কল্যাণের সম্প্রসারণ করতে হবে। কেননা জ্ঞানী লোকের জ্ঞানের ভান্ডার ও সাহিত্য সর্বসাধারণের জন্য উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে সৃজনশীল সাহিত্যের সম্প্রসারণ এবং সর্বব্যাপী সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে এর পরিণাম সুখকর ও শোভনীয় নয়। এতে নতুন-পুরোনো উভয় শ্রেণির সৃজনক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চৈতন্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল, বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে অতীতের গৌরবময় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে নতুন জেনারেশন। কিন্তু এই জেনারেশন যদি বড়দের অবদানের কথা ভুলে যায়, তাহলে বিপদ আরও বেশি ঘনীভূত হবে।
বর্তমান সমাজের প্রচারমাধ্যম ও মিডিয়ায় একশ্রেণির সুবিধাভোগী লোক আধিপত্য বিস্তার করে আছে। প্রচারের আলোর অভাবে সমাজের অনেক প্রতিভাধর সৃজনশীল সাহিত্য পাঠকের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়। সুবিধাভোগীদের আধিপত্যের কারণেই সেটি হচ্ছে! সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক গুণমানসম্পন্ন থিওরির মতো সৃজনশীল কর্মের জন্য অন্যদের বহুমাত্রিক প্রতিভার ক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। এটি শুধু অন্যায়ই নয়, অমার্জনীয় অপরাধ। অন্যকে উপেক্ষা করে দু-একজনকে খ্যাতির সিংহাসনে বসানোটাও কিন্তু সামাজিক অন্যায় এবং গুরুতর অপরাধ। কোনো কবি অথবা সাহিত্যিক যদি নিজের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার হীন স্বার্থে সরকারের তোষণনীতি অবলম্বন করে এবং সাহিত্য রচনা করেন, সেটি গণবিরোধী ও অমানবিক।
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের দুটি উক্তি দিয়ে এবারের লেখাটির ইতি টানব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
‘সাহিত্য জীবনকে সুন্দর করে, কারণ সাহিত্য জীবনকেই সুন্দর করে প্রকাশ করে। সাহিত্যের কাজ জীবনের সৌন্দর্যকে প্রকৃতি, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে ছড়িয়ে দেওয়া।’
এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম আরও দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলেছেন :
‘সাহিত্য হচ্ছে মনের মুক্তি ও ভাবনার স্বাধীনতা। যার মাধ্যমে প্রকৃতি, পৃথিবীর পরিবেশ নির্মল করা যায়। মানুষের মাঝে সত্য-সুন্দর পথের সন্ধান দেয়। মানুষকে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাধীন করে তোলে। সুযোগসন্ধানীদের থেকে সাবধান থাকা জরুরি, কারণ এরা কৌশলে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে এবং সময়মতো সেই বিশ্বাসকেই ভেঙে দেয়।’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

কমেন্ট বক্স