রোমেনা লেইস
আমি সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে এসেছি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের ক্যাম্পাসটি শান্তি এবং শক্তির এক অনন্য সমন্বয়। ইউনিভার্সিটিটি একটি সুন্দর জাতীয় উদ্যান দ্বারা বেষ্টিত। গাছপালায় ঘেরা। ছায়া ছায়া মায়া মায়া চমৎকার পরিবেশ। থাকি ব্রাইটনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে। ব্রাইটনের সঙ্গে চমৎকার পরিবহনের লিঙ্ক রয়েছে, প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে সহজ অ্যাক্সেসসহ। ব্রাইটন থেকে একটি শর্ট ট্রেনওয়ে আছে। সহজেই যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বাকি অংশগুলোতে ভ্রমণ করা যায়। আমার বোন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। আমার বোন আমার ছয় বছরের বড়। ওর পড়া শেষ হতে না হতে ওকে ইউকে প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন আব্বু-আম্মু। আপা যখন ইংল্যান্ডে চলে গেল, তখন এক ভয়াবহ শূন্যতা আমাকে গ্রাস করেছিল।
তবু সবাই খুশি হয়েছিলাম যে আপা ভালো আছে। কিন্তু একদিন জানতে পারলাম, আমার আপা ভালো নেই। অমানুষটার সঙ্গে থাকতে না পেরে আপা তার এক বান্ধবীর বাসায় চলে গিয়েছিল। আর ফিরে যায়নি। পরে ডিভোর্স হয়ে যায়। আমি বুয়েটে গ্র্যাজুয়েশন করে চলে এসেছি আমার বোনের কাছে। আমাদের আব্বু-আম্মু মাঝেমধ্যে এসে থেকে যান। বেশ শান্ত নিরিবিলি শহরটি। কিন্তু এখানেই জীবনের প্রথম রেসিজমের শিকার হয়েছি এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে। আমি রীতিমতো দুধসাদা ফরসা। বাদামি হলেও উজ্জ্বল বাদামি। আমাদের গ্রামে আমার দাদি আম্মার কাছে চান্দের টুকরা।
ক্যাডেট কলেজে আমরা একই নামে দুজন ছিলাম। আমাকে ধলা রনজু ডাকত সবাই। আর সেই আমিই কিনা বর্ণবিদ্বেষীদের হামলার শিকার হলাম। যে আমার ওপর চড়াও হয়েছিল, তার গায়ের রং ছিল আমার চেয়েও কালো। ঘটনা-দুর্ঘটনাবহুল একটা ব্যস্ত সপ্তাহ কাটানোর পরে ঈদের পরের রাতে ভিনদেশের এই নিরিবিলি শহরের রাস্তায় একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম। ভাইবোনের এ শহরে বোন আরেক দেশের আরেক ভার্সিটিতে ক্লাস নিতে গেছে। বন্ধুরা সব ঘুমিয়ে গেছে। তাই গভীর রাতে কাউকে না ডেকে নিজেই হালকা পায়চারি করে ফেরত আসার প্ল্যান।
‘যদি আমি চলে যাই..
দূর নক্ষত্রের পারে..
জানি আমি-
তুমি আর আসিবে না
খুঁজিতে আমারে।’
কবিতাটা মগজের ভেতর ঘুরছে। হাঁটতে থাকি সমুদ্রের দিকে। আজ আমার অন্ধকারে হাঁটতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে একাকী হাঁটতে শুরু করেছি। এখন মধ্যরাত। আকাশে তৃতীয়ার চাঁদ উঠেছে। ভেবেছিলাম, একটা অন্ধকার রাত পাব। কিন্তু রাস্তার লাইট আর তৃতীয়ার চাঁদের আলোয় নিঃসঙ্গতা উপভোগ করতে পারছি না। আজ রাতে আমি একটা ডুবে যাওয়া অন্ধকার রাত চেয়েছিলাম। শুধু নক্ষত্রজ্বলা আকাশ। এমন একটা রাত আমি আজ চেয়েছিলাম। এখানে অন্ধকার মানে কেবল নিঃস্ব হয়ে যাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া। এত দূর হারিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে ফিরে আসা আর যায় না। আজ কি আমার মন খারাপ? তা আমি নিজেও জানি না। আমি অবশ্য এই জীবনের অনেক কিছুই এখনো জানি না। ছেঁড়া মেঘের মতো টুকরো টুকরো স্মৃতি মাথার ভেতর দাপাদাপি করছে। উত্তরবঙ্গের গাড়িয়াল ভাইয়ের দেশ থেকে আজ আমি এখানে। মা-বাবা দেশে। আমি আর আপা এখানে। তবে মা-বাবার কাছছাড়া হয়েছি কিশোর বয়স থেকে। ক্যাডেটে পড়তে গিয়ে বছরে কিছুদিন শুধু বাসায় থাকা হতো। ক্যাডেট কলেজ শেষ করে বুয়েটে পড়তে চলে যাই ঢাকায়। পুরোপুরি বাড়ি ফেরা আর হলো না।
রাত দুটো প্রায়। রাস্তা পার হওয়ার জন্য সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি। পুরো রাস্তায় কেউ নেই। সেই খালি রাস্তার ফুটপাতে এক ব্রিটিশ ষাটোর্ধ্ব মহিলা হেঁটে আসছিলেন। আমাকে দেখে কেন জানি থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলেন, কিছু বললেন না, নাকি বললেন! আমি একটা ভদ্রতাসুলভ হাসি দিয়ে রাস্তা পার হয়ে অপর প্রান্তে যাওয়ার পরে তিনি হঠাৎ ডাক দিয়ে বললেন, ‘এই যে তুমি, একটু অপেক্ষা করো। তুমি কি এখানে এক সেকেন্ডের জন্য আসতে পারবে দয়া করে!’
আবার রাস্তা পার হয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘তুমি কি ঠিক আছ? কোনো অসুবিধা?’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভালো আছি প্রিয়, ঠিক আছি। আমি তোমাকে ডাকছি, কারণ তুমি দেখতে আমার ছেলের মতো, যাকে আমি দুই বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে এই রোডে হারিয়েছিলাম। তুমি অবিকল ওর মতো। তুমিও সেই একই পথে হাঁটছ। তার বয়স ছিল তেইশ।’ সেই মা আমাকে বুকে চেপে ধরেন। কিছুতেই ছাড়বেন না।
আমি উত্তর দিলাম, ‘ওহ প্রিয়! আমারও তেইশ চলছে। আমি সত্যিই চাই যে আমি যদি তোমার সেই ছেলেটি হতাম কিন্তু আমি হতাশ যে আমি সে নই।’
তারপর তিনি অশ্রুসজল চোখে বললেন, ‘আমি জানি আমার ছেলে আর এই পৃথিবীতে নেই। আমি জানি সে চলে গেছে কিন্তু আমি এখনো এই সময়ে রাস্তায় নেমে আসি শুধু ওকে খোঁজার জন্য। আজ দুই বছর পর আমি খুঁজে পেয়েছি তোমাকে, যে দেখতে সম্পূর্ণরূপে তার মতো। আমি কি তোমাকে ভবিষ্যতে আরও দেখতে পাব?’
আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালাম, ‘এখানে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে আমারও মা নেই, বহুদূর দেশে আমার মা আছেন। তবে আমি আজ তোমার কাছ থেকে যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি। আমাকে আর খুঁজবে না, আজকে যেমন করেছ তেমনি রাস্তায় অন্য মাতৃহীন শিশুদের তোমার ভালোবাসা দিয়ো, যদি পারো।’
তিনি সেই আবেগাপ্লুত চাহনি আর কান্নাভরা চোখেই মুখে হাসি এনে বললেন, ‘বিদায় আমার ছেলে, আমি তোমাকে মনে রাখব, তোমাকে মিস করব কিন্তু তুমি আক্ষরিক অর্থেই আমার দিন তৈরি করেছ।’
তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হয়ে পেছনে তাকাই। তার মায়াভরা মুখখানা দেখে আবার হাহাকার লাগল, কিন্তু কিছু করার নেই, ঘরে ফিরতে হবে। জাস্ট হাসিমুখে বললাম :
‘বিদায় মা, নিজের খেয়াল রাখবে যথাসাধ্য।’
জীবন সব সময় সুন্দর নয়, তবে জীবনে কিছু সুন্দর মুহূর্ত আসে, যা আমাদের শেষ অবধি বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করে।