২০২৬ সালে ভারতের পাঁচটি রাজ্য-আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালা, পুণ্ডচেরী ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভার নির্বাচন হবে। এর মধ্যে পুণ্ডচেরী ইউনিয়ন রাজ্য যা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে, আসাম বিজেপির দখলে, কেরালা বামদের, তামিলনাড়ুতে আঞ্চলিক দল ডিএমকে ও কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির একক দখলে। এর মধ্যে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে বিজেপির ক্ষমতা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তারা সব সময় আশাবাদী থাকে। গত তিনটি নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মরণপণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু মমতার এক ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে কোনোবারই বিজেপি সফল হতে পারেনি। প্রথম দুটি নির্বাচনে বিজেপি কোনো হিসাবের মধ্যেই ছিল না, কিন্তু ২০২১ সালের নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিজেপি ৩৮ শতাংশ ভোট এবং ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৭৭টি পেয়ে দ্বিতীয় স্থান ও বিরোধী দলের আসনে চলে যায়। মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়। মমতার এই ৪৮ শতাংশের মধ্যে ২৮ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট, যা কখনো নড়চড় হয় না। ২০২৬ সালের নির্বাচনে বিজেপির মূল লক্ষ্য মমতার কাছ থেকে ৫-৬ শতাংশ হিন্দু ভোট ছিনিয়ে আনা। এই ৬ শতাংশ নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা। কেন্দ্রীয় বিজেপির নেতারা দফায় দফায় পশ্চিমবঙ্গে আসছেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ১০ দিন কলকাতায় অবস্থান করে ছক কষে গিয়েছেন এবং এই ছকে অবশ্যই বাংলাদেশ একটি উপাদান।
গত ২৮ মার্চ বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা দিল্লিতে গিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করেছেন, যা একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার। ড. ইউনূস ভারত সফর করতে চাইলেও অনুমতি মেলেনি। থাইল্যান্ডে একটি সম্মেলনে মোদি ও ইউনূস উভয়ে অংশ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে ঢাকা মোদির সাক্ষাৎ চাইলে আবারও প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারতীয় সেনাপ্রধান বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না বলে মত দিয়েছেন। ড. ইউনূসের চীন সফরকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি বলে মিডিয়ার খবরে প্রকাশ। আমেরিকার ১৬টি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, ভারতেরই বংশোদ্ভূত তুলসী গ্যাবার্ড দিল্লি সফর করে বাংলাদেশ-বিরোধী কিছু নেতিবাচক কথা বলে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গের একজন বিজেপি সাংসদ বাংলাদেশি তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। আর ট্রাম্প তো বাংলাদেশকে মোদির হাতে তুলেই দিয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশকে দেখভাল করার দায়িত্ব পাওয়া তুলসী গ্যাবার্ডের সংখ্যালঘু নির্যাতনের সত্যায়ন, তসলিমা কার্ড, তার সঙ্গে জঙ্গি ও মৌলবাদী, পাকিস্তানের দোসর ইত্যাদি তকমা দিয়ে একটি সুস্বাদু রাজনৈতিক ট্যাবলেট পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের জন্য বানানোর মোক্ষম সুযোগ বিজেপি নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদি তাতেও কাজ না হয়, তাহলে বাংলাদেশে দেশব্যাপী একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিত নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারে, সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ বাধা মোটেও অবাস্তব কিছু নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীরা লুকিয়ে আছে, এই অজুহাতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করার খবর তো কিছু ভারতীয় মিডিয়া অনেক আগে থেকেই বলে আসছে। আর কিছু কিছু নাশকতামূলক কাজের জন্য পতিত আওয়ামী লীগের শত শত কর্মী তো সদা প্রস্তুত রয়েছেই। বিষয়গুলো অনুমানভিত্তিক হলেও ঢাকাকে ওই পরিস্থিতির জন্য, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা, এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে গোয়েন্দা, মিডিয়া ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।
বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং এই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে তারা ব্যবহার করে মুসলিম বিদ্বেষ। অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি কিন্তু অতটা সাম্প্রদায়িক ছিল না, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি তার পরম বন্ধু ইসরায়েলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক কৌশল গভীরভাবে অনুসরণ করেন। সে কারণেই মোদি প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলিম জঙ্গিবাদ, মুসলমানদের সন্তান বেশি, মুসলমানদের কেন্দ্র করে নাগরিকত্ব আইন, কংগ্রেস জিতলে মুসলমানদের মধ্যে সব ভাগ করে দেবে ইত্যাদি মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে থাকেন। প্রতিবেশী মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের প্রতি সব সময় অবজ্ঞা ও ঘৃণা স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও বাংলাদেশের অবস্থা ছিল কিছুটা ভিন্ন। গত ১৬ বছরে বহু হিন্দু নির্যাতন, মন্দির ভাঙচুর বা তাদের জমি দখলের ঘটনা ঘটলেও নরেন্দ্র মোদির পরম মিত্র শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকায় বিজেপি সেদিকে কোনো নজর দেয়নি। বরং কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনো সাংবাদিক হিন্দু নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন করলে বলা হতো ওটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের পর সবকিছু পাল্টে যায়। বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি মিডিয়া সেল সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের স্লোগান দিতে দিতে ওয়াশিংটন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এমনকি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন এমপিকে ম্যানেজ করে এ বিষয়টি নিয়ে অভিযোগও উত্থাপন করাতে সমর্থ হয়। কিন্তু পরে ওই এমপি অনুধাবন করেন এসব কাহিনি অর্ধসত্য বা মিথ্যায় পরিপূর্ণ এবং তখন তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। এর মধ্যে অবশ্য বিবিসি ও আল-জাজিরা ওইসব অতিরঞ্জিত কাহিনি নিয়ে রিপোর্ট করে। রিউমার স্ক্যানার নামক একটি সত্য-মিথ্যা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানও প্রমাণ করে দেখায়, কীভাবে বিজেপির মিডিয়া সেল অপতথ্য ব্যবহার করে ইউনূস সরকারকে সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস বিজেপির ওইসব অভিযোগের দিকে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপই করেননি, শুধু বলেছেন আপনারা সরেজমিনে এসে দেখে যান। ড. ইউনূস ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এত দিন আগ্রহী না থাকলেও সম্প্রতি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকতেই হবে। এখন কিন্তু ভারত বেঁকে বসে ড. ইউনূসের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখাচ্ছে। গত ৭ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জয়সওয়াল বলেন, আমরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দিকে নজর রাখছি। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, ৬ আগস্ট থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে মোট ২ হাজার ৩৭৪টি হিন্দু নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে ১ হাজার ৩৫২টি রাজনৈতিক সহিংসতার কথা বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য মোটেই দায়িত্বশীল নয়। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের তিনটি বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচন আয়োজনে ভারত সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও এখন অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতে হবে বলে দাবি তোলার একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। আওয়ামী লীগ তো মাঠে নেই, কোনো নেতাকর্মী রাস্তায় দাঁড়াতেও সাহস পায় না। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না আসতে পারলে ভারত যে বসে থাকবে না, তারই ইঙ্গিত দিল।
বিজেপির অবশ্য কিছু ক্ল্যাসিক প্রোপাগান্ডার কৌশলও রয়েছে, যা ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তারা ব্যবহার করেছে। তার একটি হচ্ছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংস কাহিনি। এই কাহিনিটি ভারতের প্রতিটি ভাষায় অন্তত ১০টি করে ইউটিউব চ্যানেল, প্রচুর লেখালেখি এবং ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। এই কাহিনিটির মূল বক্তব্য : একজন মুসলমান ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি ওই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (ইউটিউবে সার্চ দিলে সে বিষয়ে শত শত ভিডিও পাওয়া যাবে) বিষয়টি আংশিক সত্য, কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে খিলজির আক্রমণের আগে বহুবার হিন্দু রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম উচ্ছেদের জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করে একটি রুগ্্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দিয়েছিল, যা কোনো হিন্দু লেখক বা ইউটিউবাররা উল্লেখ করেনি। ইতিহাসটি সংক্ষেপে এ রকম : ভারতের বর্তমান বিহার রাজ্যে ৪২৭ সালে নালন্দা নামে বৌদ্ধদের একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। সে সময় বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা একটু ব্যাকফুটে চলে যায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেবের অহিংস বাণী প্রচার করা হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শৌর্য-বীর্যে জ্ঞানচর্চার এক মহান কেন্দ্রে পরিণত হয়। চীন, জাপান, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে শত শত ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসে এবং এটি রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নাকি অঙ্কশাস্ত্রে শূন্য যোগ হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি একটি রিপোর্ট করে ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যা বিশ্বকে পরিবর্তন করে দেয়’ শিরোনামে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের আগে বৌদ্ধধর্মকে উচ্ছেদ করার জন্য হিন্দু রাজারা বহুবার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। খিলজি যখন আক্রমণ করেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয় তখন মৃতপ্রায়।
‘It was not the first attack on Nalanda, though,Õ Sharma said, as we strolled through the ruins. ÔIt was attacked by the Huns under Mihirkula in the 5th Century, and again sustained severe damages from an invasion of the Gauda king of Bengal, in the 8th Century.’ (বিবিসি রিপোর্ট)
আমাদের সবাইকে এটা স্বীকার করতেই হবে, বিজেপির মিডিয়া একটি মাস্টার ক্লাস প্রোপাগান্ডা মেশিন। এই তো তিন-চার দিন আগে বাংলাদেশকে নিয়ে এক গুজব উৎসবে মেতেছিল-সেনাপ্রধান গোপন মিটিং করছেন, বাংলাদেশে সামরিক বা জরুরি অবস্থা আসন্ন, ইউনূসের কয়েকজন উপদেষ্টা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের প্রোপাগান্ডা এতই জোরালো ছিল যে প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান ও পররাষ্ট্রসচিবকেও এসব মিথ্যা বলে বিবৃতি দিতে হয়েছে। এই গুজব মেশিন ২০২৬-এ তাদের নির্বাচনের আগে আরও জোরালো, এমনকি সহিংসও হতে পারে, যার প্রস্তুতি ঢাকার নেওয়া খুবই জরুরি।
-নিউইয়র্ক