সোয়ামি যার ঘরে নাই-
তার অত দেমাগ কিসের? কিসের অত ফিটফাট?
স্নো পাউডার মাইখ্যা, শাড়ির ভাঁজে কুচি তুইল্লা
কিসের অত হাউস আহ্লাদ!
সাধে কি আর কই ‘বারোভাতারি মাইয়া-ছিলা’?
দুয়াই থুয়াই কিচ্ছু মানে না!
পাঁচ কানে কথা উঠন কি ভালা?
মাইয়া মানুষ হইব মাটির লাহান;
সাত চড়েও মুখে ‘রা’ কইব না।
তা না, তিনার পাঙ্খা গজাইছে।
বউকাল তো আমাগোও ছিল!
আন্ধার রাইতে খাইতাম, আন্ধার রাইতে শুইতাম।
কাকপক্ষীও টের পাইত না! আপনারাই কন দেহি,
মাইয়া-পোলার মুখে অত কথা ক্যান?
কথা তো কইব মর্দ-পোলারা!
কথাগুলো বলল-
ছেলে দুবাই থাকে বলে যার অনেক গৌরব;
উঠানে লাগানো বিদেশি ফুলের সৌরভ,
চার ভিটায় চারখান পোস্তা করা ঘর
দুই জোয়ালের হালের গরু
আর সাদাকালো টেলিভিশনের সাথে
বাড়িতে হ্যাজাক বাত্তি জ্বলে;
সেই পাশের বাড়ির চাচিশাশুড়ি কদবানু বিবি।
গাড়া টুপি মাথায়-
মুরব্বি মতো একজন বলল
গেরামের আর কিছু রইল কই?
বেইজ্জতি কারবার! অজু ভাইঙ্গা যায়!
মাইয়া ছাওয়ালের কি অতটা তুফান হইলে চলে?
হ হ ঠিক কইছেন!
আমরাও দেহি, তয় কিছু কইবার চাই না।
হক কথা হইলো-
বউ-মানুষ হইয়া সমিতি করে, কিস্তি চালায়, হাঁস-মুরগির খামার;
মাথায় ঘোমটা নাই, বাড়ি চইড়া ব্যাপারী আসে!
এইগুলান কি মাইন্যা নেওনের মতো!
কী জামানা আইলো! দাঁত খিলাল করতে করতে
তার সঙ্গে যুক্ত হলেন এক ক্রোশ দূরের বারেক মিয়া।
কিছুটা খেঁকিয়ে শাশুড়ি-মা শুধাল-
এত এত কাইর্যকলাপের পর,
এই বাড়িতে কেমনে হইব ঠাঁই?
‘পুত আমার, মোবারক! তুই কইয়া দে-
কইয়া দে, এই সংসারে তার আর কোনো জায়গা নাই।’
হেমন্তের বাতাস বইছে।
দু-একটা জোনাক পোকা ঠাহর করা গেলেও
অতুল আঁধারে মুখগুলো সুস্পষ্ট নয়।
কেবল টের পাওয়া গেল একধরনের মেয়েলি ফিসফাস।
নিরুদ্দেশের ষোলো বছর পর
বাড়ির মানুষ বাড়ি ফিরেছে, উপচে পড়া ঘর!
এবার মাতব্বর সাবের পালা-
শোনো মোবারকের বউ, ‘এইটা সালিসি মজমা’।
যা কইবা ভাইবা চিন্তা কইবা।
আছিয়ার মনে পড়ে-
বাপের মৃত্যুসংবাদে শেষবার যখন বাপের বাড়ি যাওয়া;
মায় বিলাপ কইরা কইছিল
উইন্যা যায় বাইস্যা যায় বুকে পাষাণ বান্ধি।
হালটের পানি শুকায়, সিন্দুরা গাছের আম পাকে
বকনা বাছুরটাও ডাঙ্গর হইয়া বছর বছর পোয়াতি অয়।
পাগাড়ভর্তি শৈল-গজারের পোনা ঘুল্লি মারে দেইখ্যা ভেতরটা কান্দে।
কতবার তর বাজানরে পাঠাইলাম, তুই আইলি না।
তুই নিষ্ঠুর-পাষাণ।
ফেরার কালে ছোটবেলার সই
নলিনীর ঠাম্মা মুখের দিকে চাইয়া কইছিল, আমি বুঝি!
শ্বশুরবাড়িতে সোয়ামি হইলো আসমানের চান্দের লাহান।
ভাশুর, ননদ, হউরি; অন্য হগগোলেই হইলো তারা।
আকাশভর্তি তারা থাকলেও চান ছাড়া যেমন সব অন্ধকার
তেমনি সোয়ামি ছাড়া মাইয়াগো জীবনও অন্ধকার।
তয় একখান কথা-
মাইয়া মানুষ মাটি তুইল্য। মাটিই খাঁটি!
শত কষ্টেও স্বামীর ভিটা ছাইড়ো না। কামড় দিয়া পইড়া থাইকো।
ঠাকুর একদিন ঠিক মুখ তুইলা চাইবো।
মনে পড়ে-
বিয়ার পর স্বামী একদিন কইছিল,
উড়াল দেওয়া পাখির ঘরে আইছো তুমি
পাখিদের কি ঘর বান্ধা সাজে?
তার পরও তোমারে পাইয়া মনে হইতাছে
আমাদের এজমালি ঘরে আইবো, সমুদ্দুরের হাওয়া!
আমারে ছাইড়া কোনো দিনও যাইও না তুমি
এই পৃথিবী আমার চাই না
তুমিই আমার সবটুকু ভূমি। মনে পড়ে-
সোয়ামির আদরে সেইদিন মেঘ নাইম্মা আইছিল ঘরে!
মাতব্বরের কথায় সংবিৎ ফেরে।
‘চুপ কেন? কথা কও। তোমার জবানে বেবাকেই কিছু শুনবার চাই।’
আছিয়া উদাস চোখে
উঠোনভর্তি অন্ধকার-মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে
অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে- ‘মানুষটা ফিরা আইছেন, মাজারে শিন্নি দিমু।
আমার আর কিছুই চাউনের নাই।’
আছিয়ার সেই কঠিন-কোমল কণ্ঠস্বর
শীতল-রাতের গীতলতা ছুঁয়ে
মুহূর্তে স্পর্শ করে হগগলের মন।
তখন বাতাসের ফিসফাসে ভাসছে
নলিনীর ঠাম্মার কথা-
মাইয়া মাইনষের সোয়ামি ঘিরাই শ্যাষ আয়োজন!