দিন বা সকাল-সন্ধ্যা নয়, ঘণ্টায় ঘণ্টায়ও বদলে যাচ্ছে রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ। দৃশ্যপটেও পরিবর্তন। গুজব-গুঞ্জনের মধ্যে মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দিনের মধ্যদুপুর একটায় উপদেষ্টা পরিষদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক। সত্যি সত্যি প্রধান উপদেষ্টার কাছে পদত্যাগপত্র তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের। আগস্ট বিপ্লবে অর্জিত ছাত্র-জনতার শক্তিকে সংহত রাখতে তাদের সঙ্গে মাঠে থাকাকে গুরুত্ব দিয়ে পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। নাহিদ শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ঘোষণা হতে যাওয়া ছাত্রদের দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যাচ্ছেন, তা আনুষ্ঠানিক জানালেন। দিনটিতেই তার সহকর্মী জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ধমকিয়েছেন রাজনীতিকদের। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকে দেশের মানুষ আরও দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করে বলে মন্তব্য তার।
এর আগে এদিনের সকালের প্রহরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার দিয়েছেন কঠিন বার্তা। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর বিরোধে সর্বনাশ ঘটার সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, এতে সর্বনাশ নামতে পারে। আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেছেন। তাদের এ বিরোধকে অপরাধীরা সুযোগ হিসেবে নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সেনাপ্রধান। সতর্ক করেছেন সশস্ত্র বাহিনীকে কথার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু না করতে। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, হানাহানি বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। তার এ বক্তব্যের ক্লিপ ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়াসহ গণমাধ্যমের ডিজিটাল সাইটে।
এর আগের দিন দেশের চলমান পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করতে সেনাসদস্যদের আহ্বান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান। সাভার ক্যান্টনমেন্টে ফায়ারিং প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দেওয়া তার বক্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। রয়েছে কিছু মেসেজও। বলেছেন, আমরা (সেনাবাহিনী) ভাবছিলাম দ্রুত কাজ শেষ করে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাব। কিন্তু কাজটা দীর্ঘদিন ধরে করে যেতে হচ্ছে। পরদিন মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) নানা ঘটনার মাঝে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে জামায়াতের গণঅবস্থান কর্মসূচি ‘আপাতত স্থগিত’ ঘোষণাও একটি ঘটনা। জামায়াতের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তারা কর্মসূচিটি স্থগিত করেছেন। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন) যমুনায় এ বৈঠক হয়।
টানা মাস কয়েক ধরেই রাজনীতির মাঠে নানাভাবে অনেকটা একতরফা খেলছে জামায়াত। বিএনপিই তাদের এ খেলার টার্গেট কোনো না কোনোভাবে। আমির ডা. শফিকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রতিদিনই কোনো না কোনো ইঙ্গিতবহ বক্তব্য দিচ্ছেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ছাত্ররাই ঘটিয়েছে, রাজনীতিকেরা নন। এ ছাড়া যত দরকার সময় নিয়ে নির্বাচন, সংস্কার শেষ করে নির্বাচন, আগে স্থানীয় নির্বাচন পরে জাতীয় নির্বাচন, শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিস্টদের বিচার না করে নির্বাচন নয়, এক দল খেয়েছে আরেক দল খেতে চায়- এ ধরনের কথা সরাসরি বিএনপিকে উদ্দেশ করেই দেওয়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দাবিও এ রকমই। এসব বক্তব্যের একটি ওজন ও বাজারদর রয়েছে। কিন্তু বিএনপির টপ টু বটম নেতাকর্মীদের জন্য তা সহ্য করা কঠিন। সময় যত গড়াবে বিএনপি তত বিপাকে পড়বে, পরিস্থিতি প্রতিকূল হবে- সেই ভাবনা থেকেই তাদের এ কৌশল। থিওক্রেটিক, এনার্কিক, অতি সুশীলদের কারও কারও এতে বাতাস দেওয়ার তথ্য আছে বিএনপির কাছে। কিন্তু স্পর্শকাতর এ পরিস্থিতিতে তা বলাও যাচ্ছে না। এর পরও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আহ্বান জানিয়েছেন, অতি তত্ত্ব না আওড়াতে। সংস্কার নিয়ে অবান্তর কথা না বলতে।
এদিকে সরকারের জন্যও সময় কেবল খারাপ হয়ে উঠছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তার দ্বিতীয় ইনিংস বললেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ১৪, ১৮, ২৪ সালের ভেজাল নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ডিসি-এসপিদের বরখাস্ত, শাস্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একদিকে ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরেছেন, আরেকদিকে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে একটি বার্তা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা কিছুটা ফুরফুরে হয়ে কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। ছোলা-চিনিসহ কিছু নিত্যপণ্যের দামে লাগামে টান দিয়েছেন। খাদ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। বন্দরগুলো দিয়ে সমানে মালামাল আসছে। এর মাঝেই আবার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি। রাজধানীতে সমানে ছিনতাই-ডাকাতি। চলন্ত বাসে ধর্ষণসহ কিছু জঘন্য ঘটনাও ঘটেছে। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা ভর করেছে। পাহাড়ি অঞ্চলেও উত্তাপ। রাঙামাটির সাজেকে মাইলকে মাইল রহস্যজনক আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শতখানেক রিসোর্ট-কটেজ ও বসতঘর। তার ওপর কক্সবাজারে বিমানঘাঁটিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় হতাহতের ঘটনা।
অপারেশন ডেভিল হান্টের মাঝেই এসব ঘটনায় গোটা দেশ এক আতঙ্কপুরীতে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে ছয় মাসের মাথায় এসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ নাজুক অবস্থা ধারণা বা ভাবনার অতীত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে সমাবেশ-মিছিলও হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আরও বিপাকে পড়েছেন এই উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। আইজিপি বলেছেন, দিনে-রাতে ছিনতাই বেড়েছে। তাদের এ ধরনের কথা নিয়ে গোটা সরকারকে নিয়েই চলছে নিম্নমানের ট্রল।