Thikana News
২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

আটই ফাল্গুন

আটই ফাল্গুন
বাংলা কোন সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদেরা রক্ত দিয়েছে, ভাসিয়েছে রাজপথ; বাংলা কোন সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে, উড়িয়েছে পতাকা; আমার জানা নেই। জানতে চাইলে এর উত্তর গুগল করো। জ্ঞানী লোকেরা ভর্ৎসনা করলেও বিজয় দিবস বাংলা কোন সালে বা কত তারিখে বলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, ভাষা আন্দোলনে শহীদেরা তাদের রক্তে রাজপথ রাঙিয়েছিল আটই ফাল্গুন। বাংলার মাটি ও মানুষ যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। বাংলা ভাষা যে আমাকে ক্ষমা করবে না, তা আমি মেনে নিয়েছি। বইয়ের পাতা পড়েছি, পাস করে বড় হব। পাতায় পাতায় জ্ঞান ছড়ানো, তুলে নিইনি। সাহেব সেজেছি বটে, জ্ঞান নেই ঘটে। আজও মনে পড়ে ইংরেজি একাত্তরের ফেব্রুয়ারির একুশের ভোর, ফাল্গুনী শীত, হৃদয়ে আগুন, শহীদ মিনার, দলে দলে ছাত্রছাত্রীদের কোরাস, জনতার কণ্ঠে সুর- মা গো আটই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলব না। ঠেলাগাড়িওয়ালা, রিকশাওয়ালার অবাক চাহনি। রেসকোর্সের ময়দান, সবুজ ঘাসে শিশিরবিন্দু। খালি পায়ে শহীদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা। ফাল্গুন মাস, যৌবনের মাস, মানব বয়সের ফাগুন, বাংলা ভাষার ফাগুন, তরতাজা রক্ত আর মনে আগুন। সবুজ পাতা, আমের বোল, ভ্রমরের গুনগুন, শাখায় শাখায় মহুয়ার দোল। হেয়ার রোড, সিমসন রোড, সেগুনবাগিচায় কোকিলের রোল, প্রতি পদে পূর্ণ বিকাশের পাঁয়তারা।
বড় বোন হালিমনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র ছাত্রী। ঘুম থেকে ডেকে তুলেই সতীনাথে এক জোড়া স্যান্ডেল দিয়ে বলে, ধর, স্যান্ডেল পরে যাবি। বাংলা একাডেমির পর পা থেকে খুলে ব্যাগে নিস। আজ কোনো রিকশায় চড়িস না। পায়ে হেঁটে যাবি। সিদ্ধেশ্বরীর ভেতর গলি দিয়ে যাবি। বেইলি রোড, মিন্টো রোড পার হয়ে রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে রেসকোর্সে ঢুকবি। ব্যাগে একটা আমড়া, একটা খিরাই কেটে দেওয়া আছে, দুপুরে গরম পড়বে, খেয়ে নিস। বাইরে কিছু খাসনে।
ও হ্যাঁ, ভার্সিটির দিকে যাসনে, টিএসসির মোড়ে যত গন্ডগোল। কারও সঙ্গে কোনো তর্ক করিসনে। আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে বলিস, ঘরে বসে শহীদের জন্য দোয়া করব। হাতে শেফালি, গাঁদা বা গোলাপ, নেহাত একগুচ্ছ ঘাসফুল, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা আরও বাড়িয়ে দেয়। মনের গভীরে সাক্ষ্য দেয়। মা গো, আটই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলব না।
একটু একটু করে ভরে যায় ঢাকা শহীদ মিনার। বাংলার কোনায় কোনায়, ঘরে ঘরে মানুষের মনেপ্রাণে শহীদ মিনার। ফাগুনের আগমনে সব গাছই নিজের মতো সাজাতে চায়- কৃষ্ণচূড়া, কনকচাঁপা, গাবপাতা, বাঁশঝাড় সাজিয়েও নেয়। আসুক ঝড়, নামুক বাদল, ত্যাগ স্বীকারেই প্রাপ্তি। ফাগুন মাস, বাংলায় স্বর্ণাক্ষরে গাঁথা থাক। এ ধরায় প্রতি চৌদ্দ দিনে একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়, বাংলা তার মধ্যে নয়। আটই ফাল্গুনের রক্তভেজা রাজপথই রোপণ করেছে বাংলার স্বাধীনতার বীজ।
সাতই মার্চের ভাষণের প্রস্তুতি চলছে। এই ভাষণেই দিকনির্দেশনা কোন দিকে যাবে বাঙালি জাতি। বাঙালিরা যুদ্ধ চায় না। শান্তিপ্রিয় মানুষ। স্বাধীনচেতা মানুষ। মোড়ে মোড়ে বালির বস্তা, কী যেন ঘটবে। বাংলা মোটর, টয়েনবি রোড, টিকাটুলির মোড় নাম দিয়েছে চেকপোস্ট। রুখো রুখো কাহা যা রাহা হো? বাসায়। ইয়ে বাসায় কেয়া হোতা হায়? এদার ঠেরো। একজন ঠোলা ডেকে জেনে নেয়, বাসায় শব্দের অর্থ কী। ঠোলা যদি নারাজ থাকে, তবেই সেরেছে। রিকশার সিট খুলে দেখবে। মোটরসাইকেলের সিট তোলা যায় না, তবু সিটে একটা থাপ্পড় মেরে মনের জ্বালা মেটায়। মা ঘরে বসে জায়নামাজে বসে তসবি গুনছে। বাবা পায়ে হেঁটে বন্ধ অফিসের জরুরি নথি সামলে রাখায় ব্যস্ত। সবার মনে একই ভয়- কী যেন কী হয়। মিটিং আর মিছিল নিত্যদিনের সাথি। আইয়ুব, মোনায়েম দুই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই। ইয়াহিয়া, টিক্কাকে নিয়ে কত কথা, কত স্লোগান। পার্কে আর পাটখেতে সবাই সজাগ। যার ভাষা বুঝি না, সে আমার কিসের ভাই?
ঢাকায় যেটুকু সবুজ ঘাস দেখা যায়- বাহাদুর শাহ পার্ক, রমনা পার্ক, রেসকোর্স সবই যেন বুটের শব্দে ক্লান্ত। ধূপখোলা মাঠ সব সময় সবুজহীন ধুলোয় ভরা। দলে দলে সবাই খেলে, মাঠে আনন্দ লাগে, নিজের সন্তান। মাটি একটু শান্তি খোঁজে, খোঁজে একটু মুক্তি। বুটের ভয় নয়। খালি পায়, পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়, বেলি ফুল হাতে মাথা নিচু। ফাল্গুনী শ্রদ্ধা জানায়। এই তো পাশে ফজলুল, সোহরোয়ার ঘুমায়, নাজিম হতবাক। কোথায় পেল শ্রদ্ধা, কে-ইবা শেখায়? বাকরুদ্ধ আইয়ুব আলী, ইয়াহিয়া ঘুরপাক খায়। আর বুলি আওড়ায়- কিউ কিয়া বায়ান্নপে ইয়ে কেয়া হো রাহা হায়। মুজিবের হাতে জনবল, ওদের হাতে কৌশল। জনবল সভ্য জাতির স্বাধীনতার সম্বল। সেই আমি আজ ম্যানহাটনে, আরেক ফাগুনে, শীতে কাতর ব্যস্তময় শহর নিউইয়র্কে। ব্রডওয়ে, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল, বড় বড় বালাখানা থেকে ভেসে আসে ‘সোনা নয় তত খাঁটি তার চেয়েও খাঁটি বাংলাদেশের মাটি’, সেই গান। নিউইয়র্ক শহর, সাঁকো আর সুড়ঙ্গের শহর, মানুষ আর বালাখানার সমাহার, নানা জাতের, নানা ভাষার মানুষ। নানা রঙের, নানা ঢঙ্গের, নানা ভাষার কলরব। হাজার মানুষের ভিড়ে বাংলাকে চেনে সবাই। এখানেও আছে সেন্ট্রাল পার্ক, প্রসপেক্ট পার্ক, মেডো পার্ক আরও বেশি। মন ভরে না কিছুতেই। কুয়াশায় ঢাকা পার্ক দেখেছি, শিশিরভেজা ঘাস দেখেছি, শত জনতার ভিড় দেখেছি, জীবনের বেগ দেখেছি, ভাষার জন্য আবেগ দেখিনি। সবই হয়, সবই আছে, তবু যেন শূন্যতা-ব্যর্থতা।
আমারও কাঁদে মন, হৃদয়ে বাজে সচীনের ধূন। কোকিলের সুর, আমলকী বনে বিরহী দোয়েলের কান্না। জীবন যেন ভাটিতে ভাসা কচুরিপানার মতো। হালিমনি বুবু ফোনে কথা বলে। শহীদের স্মৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য দান প্রটোকল মাত্র। আগের মতো বেলি আর ঘাস ফুলে শ্রদ্ধাদান নয়। হয়তো কোনো সংগঠনের ফুলডালা ছুঁয়ে মিডিয়ার কভারেজ। ঘরে বসে শহীদের আত্মার শান্তির দোয়া, সময় কোথায়। পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল উন্নত দেশ গড়ার শপথ। উন্নতির দিকে দেশ, প্রগতির দিকে দেশ। প্রযুক্তির কল্যাণে আরও এগিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে। হালিমনি বুবু কি পারবেন একুশে পদককে বদলে ফাল্গুনী পদক বলতে? একুশে বইমেলার বদলে আটই ফাল্গুন মেলা? অথবা অন্য কোনো নাম বাংলায়? ইংরেজ দেশ ছেড়েছে বহুকাল আগে। ইংরেজি ভাষাকে রেখেছে সজীব। নাম বাংলায় পরিবর্তনে পদক বা মেলার মান একটুও কমার কথা নয়। অন্যসব পরিপক্ব ভাষায় মাস, সন, বার নিজ ভাষায় দিয়ে থাকে। বাংলাও বিশ্ব মানচিত্রে পরিপক্বতা অর্জন করেছে। বাকিটা জ্ঞানী লোকদের হাতে। লেখক : প্রাবন্ধিক

কমেন্ট বক্স