বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের জীবন সদস্য অধ্যাপক সিরাজুল হক আর নেই। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) নিউইয়র্ক সময় সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে কুইন্স হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
গত ১০ এপ্রিল আশঙ্কাজনক অবস্থায় নিউইয়র্কের কুইন্স হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি জটিলতাসহ একাধিক রোগে ভুগছিলেন এবং সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করতে হতো।
অধ্যাপক সিরাজুল হক ছিলেন একাধারে বর্ষীয়ান সাংবাদিক, শক্তিশালী ভাষাবিদ ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন এক সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। তিনি বরিশালের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই মাতৃ-পিতৃহীন হয়ে বেড়ে ওঠেন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, কিন্তু শিক্ষাজীবনে বরাবরই ছিলেন মেধার শীর্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স ও এমএ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ আবদুল হাই, ড. নীলিমা ইব্রাহীমসহ দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরা।
সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা তাঁর ছাত্রজীবনেই শুরু হয়। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বরিশালের কামারখালী কলেজে অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বরিশাল ফেরার পথে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তাঁর ডায়েরিতে বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতাদের নাম ও নম্বর পাওয়ায় সন্দেহের তীর তাঁর দিকে ছোড়া হয়, তবে অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
পরবর্তীতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করে ‘দৈনিক জনপদ’-এ দীর্ঘকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ইংরেজি ‘ওয়াল ফজর’, ‘দি ডন’, মাসিক ‘তাহজীব’ ও ‘নিউজ লেটার’-এর প্রধান সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিক ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় তিনি সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ও আনোয়ার জাহিদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়ে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিক ফজলে রশীদ, আতাউস সামাদ, নির্মল সেন, রিয়াজ উদ্দীন আহমদ, আমানউল্লাহ কবীরসহ বহু খ্যাতিমান সাংবাদিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত সাহিত্যিক ও কবি। শিশুতোষ সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী বহু বইয়ের রচয়িতা ও সম্পাদক তিনি। এ ছাড়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর অনুবাদগ্রন্থও রয়েছে। ইরানে তেহরান টাইমস ও রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। তিনি তেহরানের প্রপাগেশন সেন্টারের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সমাজসেবায় নিবেদিত, বন্ধুবৎসল, মানবিক ও সততার মূর্ত প্রতীক অধ্যাপক সিরাজুল হক তাঁর কর্মজীবনে বহু তরুণকে সাংবাদিকতা ও শিক্ষা পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে নিঃস্বার্থভাবে সহায়তা করেছেন।
পেশাগত কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি, লিবিয়া প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন। একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিদেশ সফরেও তিনি সাংবাদিক প্রতিনিধি হিসেবে সঙ্গে ছিলেন।
শেষ জীবনে তিনি নিউইয়র্কে দীর্ঘদিন বসবাস করছিলেন তাঁর জামাতা কবি ও কলামিস্ট এবিএম সালেহ উদ্দীন ও বড় মেয়ে সাঈদা আখতার রেজভীনের সঙ্গে।
অধ্যাপক সিরাজুল হকের মৃত্যুতে প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ঠিকানা/এনআই