Thikana News
২১ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

নজরুলের বিপ্লবী দর্শন ও সাহিত্যকর্ম

নজরুলের বিপ্লবী দর্শন ও সাহিত্যকর্ম



 
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন, তিনি একাধারে রাষ্ট্রচিন্তক ও সমাজ পরিবর্তনের একজন মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক ও দূরদর্শী প্রতিনিধি।
শিল্পকর্ম, সাহিত্যকর্ম, কাব্যরচনা ও সামগ্রিক জীবনদর্শনে আমরা তাঁকে দেখতে পাই একজন অপ্রতিরোধ্য সাহসী পুরুষ হিসেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা তিনি ছিলেন সোচ্চার এবং প্রতিবাদী। তিনি তাঁর আপসহীন বিদ্রোহী সত্তা, মানবতার পক্ষে সাহিত‍্য রচনা ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সকল প্রকার কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে সমাজের সর্বস্তরের আমূল পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন। তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্ম এবং বিপ্লবী দর্শন সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য এবং সব সময়ই প্রাসঙ্গিক।
ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষায় শিল্প-সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে গেছেন। সব সময়ের উপযোগী বিপ্লবী রাজনৈতিক দর্শন ও কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি অসামান্য অবদান রেখে নিজেকে অবিস্মরণীয় করে তোলেন।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর কলমকে অস্ত্র হিসেবে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উঠে এসেছে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও অপমানের গ্লানি থেকে সর্বপ্রকার দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করার কালজয়ী আহ্বান।
কখনো আগুন, কখনো ঝড়-সাইক্লোন, টর্নেডো ও বিপ্লবী নেতা; আবার কখনো যুদ্ধের ময়দানে রণবীর রূপে বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগ্রত করেছেন। সকল প্রকার কুসংস্কার, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। ধর্মে মহান স্রষ্টার ইবাদত-উপাসনা এবং মানবতাবোধকে সম্মান জানিয়ে তিনি ধর্ম-কর্ম করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ধর্মীয় উন্মাদনার নামে নৃশংসতা এবং অমানবিক পন্থা কোনো ধর্মের মূলনীতি হতে পারে না।

প্রাচীন যুগ থেকে ধর্মের নামে ভারতবর্ষের হিংসাবর্তী মানুষের মাঝে অমানবিক উন্মাদনার সৃষ্টি করা হয়। মানুষকে অপমান, অবহেলা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন প্রতিবাদী। তিনি যেমন কখনো অন্যের অধিকার হরণ করেননি, তেমনি গণমানুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি সর্বদা নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত মানুষের পক্ষে প্রত‍্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লড়াই করেছেন।

নজরুল বিশ্বাস করতেন, ধর্ম মানুষের অন্তরের বিষয়, ধর্ম কখনো মানুষের মধ্যে ফ‍্যাসাদ ও বিভেদের সৃষ্টি করে না। সমাজের একশ্রেণির ভণ্ড লোকেরা ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। মানুষের মনে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ ও হিংসার বীজ ছড়ানো হয়।
ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিমদের ঐক্য এবং সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যেমন ফিল্ডে কাজ করেছেন, তেমনি তাঁর রচনায় সকল দল, জাত ও ধর্মের মানুষের মাঝে সমন্বয়, সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতি স্থাপনের আদর্শ উজ্জ্বলরূপে ফুটে উঠেছে। তাঁর মতে, ধর্ম শুধু ইবাদত/উপাসনাতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মানবিকতা হচ্ছে ধর্মের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের কাজকে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা প্রকাশের মধ্য দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছেন মানবতার প্রতীক। মানবতাবোধ এবং সর্বপ্রকার সামাজিক অবক্ষয় ও বিভাজন থেকে দূরে রাখার প্রদর্শনা। বরং ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টি এবং মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ চালানো একধরনের সামাজিক শোষণ। মানুষের মাঝে সাম‍্য-মৈত্রী, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বমূলক ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাঁর বিভিন্ন লেখা ও কবিতায় সেটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে :
‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কবি, যিনি তাঁর লেখনী ও চিন্তাধারার মাধ্যমে উপমহাদেশে স্বাধীনতা ও সাম্যের পক্ষে বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর বিপ্লবী দর্শন মূলত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানবতার মুক্তির আহ্বান। সমগ্র পৃথিবীতে অনবরত যে মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে, কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যদর্শন ততই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে।

কাজী নজরুলের বিপ্লবী কবিতা ও গান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে পরিপূর্ণ। তাঁর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ (১৯২২) হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ। এই কবিতায় তাঁর বিপ্লবী ভাবনার সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। মানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা সর্বাত্মক গণবিপ্লবের প্রেরণা রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায় তিনি নিজেকে কখনো অগ্নি, কখনো তুফান, কখনো বজ্র-বিদ্যুৎ অপ্রতিরোধ্য শক্তিরূপে শাসকের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে শোষকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
‘আমি চিরবিদ্রোহী বীর-
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’
ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে কাজী নজরুল ইসলাম নিজেকে উৎসর্গ করেন। নজরুল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর রচনায় তিনি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন এবং মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি বলেন :
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’
নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নে শ্রেণিবৈষ্যেমের ঊর্ধ্বে নজরুল সমাজে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও কবিতায় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নারী কেবল ভালোবাসার প্রতীক নন। নারী শুধু ঘর-সংসার করেই ক্ষান্ত থাকবেন না, বরং সমাজের সর্বস্তরে নারীর ভূমিকা থাকা জরুরি। নারী শক্তি ও প্রতিবাদের প্রতীক। উদাহরণ : কবিতা ‘নারী’তে তিনি বলেন :
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
সমাজ ও রাষ্ট্রের শোষণের বিরুদ্ধেও নজরুল ছিলেন সোচ্চার। তাঁর সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিশ্বজনীন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তাঁর রচিত বিপ্লবী গান ও কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ রয়েছে। তাঁর লেখায় সমাজতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী চেতনার ছাপ স্পষ্ট। গণমানুষের জাগরণের জন্য দুর্বার আন্দোলন করেছেন। পাশাপাশি শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে শোষকের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর কণ্ঠে সেই কালজয়ী প্রতিধ্বনি শুনতে পাই-
“শোন্‌ অত্যাচারী! শোন্‌ রে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্বহারা, হব সর্বজয়ী।
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ।
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ;
এই ‘জনগণ-অন্তর-সংহতি’ রে
হবে নিখিল মানবজাতি সমুদ্ধত।”
সংগীত ও নাটকের মাধ্যমে নজরুলকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অধিনায়কও বলা যায়। কেননা তিনি শিল্প-সংস্কৃতিতে গণমানুষের মুক্তি ও অধিকারের কথা বলেছেন। শুধু কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাঁর বিপ্লবী দর্শনে গণমানুষের চেতনায় নবজাগরণের দীক্ষা রয়েছে। গণমানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য জনগণকে জাগানোর জন্য অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেছেন। বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সেসব পত্রিকার একটি ছিল ‘ধূমকেতু’।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে, তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল।

এই পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। যার প্রতিটি সংখ্যায় ছিল গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের দাবিতে সংগ্রামের প্রাণশক্তি। যার শিক্ষা এখনো পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের বিপ্লবী দীক্ষায় ধ্বনিত হয়। তাঁর গানগুলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল।

কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী দর্শন শুধু রাজনৈতিক বিদ্রোহে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল একটি সামগ্রিক মানবিক মুক্তির আহ্বান। তিনি একজন সর্বজ্ঞানী মুক্তিচিন্তক হিসেবে মানবতা, ন্যায় ও স্বাধীনতার পতাকা বহন করেছিলেন। তাঁর বিপ্লবী দর্শন আজও যুগোপযোগী, অসাম্য-মৈত্রীর প্রতীক।

অপ্রতিরোধ্য নজরুল : ঝড় থেকে উঠে আসা মহা সাইক্লোন নজরুল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য সাহসের ফলে বৈচিত্র্যের মধ্যে বিস্ময়কর প্রতিভার মাত্রা অতিক্রম করে তিনি নিজেই পরিণত হন ঝড়। একসময় দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম পরিণত রাজনীতিবিদ হিসেবে। তিনি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মেও যোগদান করেন। বিশেষ করে, রাজনৈতিক অঙ্গনে তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে’ প্রভৃতি।

এ ছাড়া সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলে অংশগ্রহণ করে শহর প্রদক্ষিণ করেন। সেই মিছিলে নিজ রচিত সংগীত পরিবেশন করেন, ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’। নজরুলের সেই সময়কার সাহিত্য, কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের বার্তা প্রকাশিত হয়েছে। যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেন :
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে, তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন। পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে সেই বাণীটি লেখা থাকত।

ধূমকেতু পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। সেই কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দি নামক বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করে।

১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন, তখন (১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন।

রবীন্দ্রনাথের সেই গীতিনাট‍্য গ্রন্থের প্রকাশে নজরুল বিশেষভাবে আনন্দিত ও উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসেই নজরুল ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন।
একইভাবে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ঝড়ের মতো ঝলসে ওঠেন। তাঁর ঝড় কবিতা সেই সাক্ষ্য বহন করে। তিনি লেখেন :
‘উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার,
ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!
কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই,
ভ্রুকুটি-ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই।
তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়,
হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায়’...
বিপ্লবী মনোভাবের ফলেই বোধ হয় ১৯১৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম চলে যান সেনাবাহিনীতে। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। একপর্যায়ে তিনি কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি পল্টন ভেঙে যায়। করাচিতে থাকাকালীন ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে (১৩২৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা)। প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’।

অতঃপর নজরুল ১৯২০ সালে করাচি থেকে ফিরে এলেন কলকাতায়। কয়েকদিন থাকার পর চলে আসেন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিসে। এখানেই মুজফফর আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয়। তারপর নজরুলের কলম দুর্বার গতিতে চলে। ১৯২০-১৯৪২ সাল পর্যন্ত নজরুল ছিলেন সৃষ্টিশীল। তারপর তার অগ্নিবীণা, প্রলয় শিখা, বিশের বাঁশি, ভাঙার গান, দোলন চাঁপা, সিন্ধু হিন্দোল, ছায়ানটসহ ১৮টি কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধগ্রন্থ মিলে নজরুল দিয়ে গেলেন বিশাল সৃষ্টিসম্ভার। তিনি দিয়ে গেলেন সাড়ে পাঁচ হাজার গান। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। নজরুল শুধু বিদ্রোহী কবি নন, তিনি পূর্ণমাত্রায় বিপ্লবী কবি, প্রতিবাদের কবি, পূর্ণ স্বরাজের কবি, দিনবদলের কবি, সমাজবদলের কবি, রোমান্টিক কবি, প্রেমের কবি।

ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নজরুল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও ঔপনিবেশিক বিরোধিতায় তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। নজরুলের বিপ্লবী দর্শনের মূল দিকগুলো নিয়ে যত বেশি গবেষণা ও আলোচনা হবে, ততই গণমানুষের অধিকার আন্দোলনের পথ সুগম হবে। (জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবন্ধটি রচিত)
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
 

কমেন্ট বক্স