ইছমত হানিফা চৌধুরী
কাছের এবং দূরের সবাইকে জানাচ্ছি সাদর সম্ভাষণ। যাদেরকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্য হয় না, তাদেরই অন্যতম হচ্ছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের প্রিয় কবি। ছোট-বড় সবার জন্য তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য লেখা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) এবং মাতা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬-১৮৭৫)। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান।
সাহিত্যভাবনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শিশুর ভাবনা, শিশুর কল্পনা, শিশুর স্বপ্ন, শিশুদের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত করেছেন এবং শিশুরা কবিগুরুর মনকে নাড়া দিয়েছে। ফলে তার কবিতা, নাটক, ছড়া, গল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিশুরা এসেছে ঘুরেফিরেই। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন শিশুদের নিয়ে নাটক যেন শিশুশিক্ষার অঙ্গ হয়ে ওঠে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাকাহিনী’ সম্পূর্ণ শিশুশিক্ষা নিয়ে লেখা একটি ক্ষুদ্র গল্প বা ছোটগল্প। তাই একজন সংবেদনশীল কবি বললেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে বলা যায়। অর্থাৎ তিনি একজন প্রকট অনুভূতিসম্পন্ন কবি। নানা বৈচিত্র্যের এই নোবেলজয়ী কবি শিশুদের নিয়ে নানা আঙ্গিকের লেখা ছাড়াও শিশুদের জন্য গান, নৃত্যনাট্য ইত্যাদি লিখে গেছেন।
তার অসংখ্য সৃষ্টি ও অবদান। তাকে আমরা ভালোবাসি শুধু কবি, সংগীত রচয়িতা বা সুরস্রষ্টা হিসেবেই নয়; আমাদের মাতৃভাষার উন্নয়নে তিনি যে কাজ করে গেছেন, মাতৃভাষাকে বিশ্ব অঙ্গনে পরিচিত করানোর জন্য তার যে অবদান, সে জন্যও আমরা তাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, সংগীত, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য প্রভৃতি; যার মধ্যে বেশ কিছু লেখা তিনি লিখেছিলেন শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে।
আবার তার এমন কিছু লেখা আছে, যা সরাসরি শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা না হলেও তারা পড়তে পারে নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্য। রবীন্দ্রনাথ তার লেখনীতে বাঙালির জীবনযাপন, সংস্কৃতিকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি বাঙালির চিরদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনারও রূপকার তিনি। জগতের সকল বিষয়কে তিনি তার লেখায় ধারণ করেছেন। মানুষের এমন কোনো মানবিক অনুভূতি নেই, যা রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায় না। তার সম্পর্কে কবি দীনেশ দাশ বলেছেন, ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা।’ সভ্যতার সকল সংকটে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নির্বিশেষ আশ্রয়। অন্ধকারে এক আলোকবর্তিকা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি সারা জীবনের সাধনায় অসাধারণ রূপলাবণ্যমণ্ডিত করেছেন। অতুলনীয় ও সর্বোতমুখী প্রতিভা দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করে বাঙালিকে এক বিশাল মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন।
শিশুর মনের ভেতর থাকে এক কল্পজগৎ। শিশুদের নিয়ে লিখতে গিয়ে কবি নিজেও যেন শিশু বনে গেছেন। শিশুদের চাওয়া-পাওয়া, আধো আধো কথা বলা তার শিশুকাব্যে হয়েছে জীবন্ত-প্রাণবন্ত। কবির শিশুমন গলির পাশের ফেরিওয়ালাকে দেখে ফেরিওয়ালা, মালিকে দেখে মালি, পাহারাদারকে দেখে পাহারাদার আর ঘাটের মাঝি হতে চায়। এভাবেই শিশুর চাওয়া-পাওয়া, আধো আধো কথা তার কাব্যে আরও প্রাণবন্ত ও জীবন্ত হয়ে ওঠে। বৃষ্টিস্নাত মৌসুমে ছুটির ঘণ্টা বাজানোর ঢংয়ে তিনি লিখেছেন :
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।’
শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ছন্দের ঢেউ-তোলা মিষ্টি মিষ্টি ছড়া-কবিতা। লিখেছেন মজার মজার গল্প ও নাটিকা। তার লেখা শিশুতোষ গানের সংখ্যাও অনেক, যা ছোট-বড় সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শিশুদেরকে রবীন্দ্রনাথ ভীষণ ভালোবাসতেন। ওদের জন্য কখনো তিনি সৃষ্টি করেছেন কল্পনার জগৎ, কখনো সাজিয়েছেন বাস্তবতার চিত্র। তার লেখা ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘শিশু’, ‘ছড়ার ছবি’ ইত্যাদি আমাদের শিশুসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার লেখা ছোটগল্পে ফুটে উঠেছে এ দেশের অজপাড়াগাঁয়ের কিশোর-কিশোরীদের কথা।
‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মতো চিরচঞ্চল চরিত্রকে তিনি চিত্রিত করেছেন। শিশুতোষ নাটক ‘ডাকঘর’-এ তিনি এঁকেছেন অসুস্থ বালক অমলের আকুতিকে। অমল চায় বাইরের পৃথিবীটাকে দু’চোখ ভরে দেখতে। কিন্তু কবিরাজের বারণ। তাকে সেরে তোলার জন্য সারাক্ষণ একটি ঘরে বন্দী রাখা হয়। সে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাইকে অনুনয় করে বলে তাকে মুক্ত করে দিতে। রাজবাড়ির ঘণ্টা, দূরের আকাশ, গাঁয়ের পথ ওকে হাত বাড়িয়ে ডাকে।
প্রকৃতিদরদি এই কবি প্রকৃতির নানান বিষয়কে তুলে এনেছেন শিশুতোষ ছড়া-কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ যখন ছোটদের জন্য লিখেছেন, তখন তিনি নিজেকে ছোট্ট শিশু ভেবেছেন। শিশুর কচি চোখের দৃষ্টিতে দেখেছেন আর লিখেছেন শিশুপাঠ্য ভাষাতেই। তাই কবি যখন ছোট নদীর কথা লিখলেনÑ
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’
কবিতাটি পড়তে পড়তে শিশুরা নিজের চোখে দেখা নদীটির মিল খুঁজে পায়। কেউ কেউ ধরেই নেয় তাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির কথাই লেখা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সচেতন খেয়ালি মনের মানুষ। বিচিত্র রকম সাধ বা ইচ্ছে ছিল তার মনের মধ্যে। ছোটদের মতো তার মনটাও যখন যা দেখেছে তা-ই করতে চেয়েছে, তা-ই হতে চেয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সব্যসাচী লেখক কবিগুরু সাহিত্যের সকল শাখায় পদচারণ করেছেন সগৌরবে। শুধু বড়দের নয়, ছোটদের নিয়েও তিনি অনেক লেখা লিখে গেছেন। ছোটদের নিয়ে যে কবিতা, গল্প, নাটক লিখেছেন, তার ভেতর আছে গভীর কোনো তত্ত্ব। বিশেষ করে, ‘শিশু’ ও ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যে কবি শিশুমনের নানান রহস্য উন্মোচনে উদ্যোগী হয়েছেন। শিশুদের নিয়ে লেখা তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে সহজপাঠ-১, সহজপাঠ-২, খাপছাড়া, ছড়া ও ছবি, গল্পস্বল্প, ছড়া, ছেলেবেলা, বিশ্বপরিচয়, লিপিকা, মুকুট প্রভৃতি। এ ছাড়া সোনার তরী, কাহিনী, কড়ি ও কোমল, চিত্রা, ক্ষণিকা, কল্পনা, লেখন প্রভৃতি বড়দের বইয়েও শিশু-কিশোর উপযোগী অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
আধুনিক যুগে উন্নত চিন্তা এবং সাহিত্য প্রকাশের নতুন নতুন যেসব ধারা দেখা যায়, তার মধ্যে ছোটগল্প একটি। উনিশ শতকে এসে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাÑএই তিন মহাদেশে কয়েকজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক একযোগে ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। তারা হলেন ফ্রান্সের ‘গি দ্য মপাসা’, রাশিয়ার ‘আন্তন চেখভ’, ইংল্যান্ডের ‘সমারসেট মম’, ভারতবর্ষের ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। তারা প্রত্যেকেই ছোটগল্প শুরু করেন নিজ নিজ দেশে নিজেদের মাতৃভাষায়।
বাংলা ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোতে থাকে। উনিশ শতকের শেষ দশক এবং বিশ শতকের প্রথম দশকে নিরন্তর গতিতে এগিয়ে চলা তার ছোটগল্প ক্রমে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদরূপে বিবেচিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে পদ্মার বাঁধভাঙা ঢেউ, ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্র্য এবং ভাগ্যহত মানুষের গভীর জীবনবোধ স্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। তার ছোটগল্পে উঠে এসেছে গ্রাম-বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য, নদীর কুল কুল বয়ে চলা, পালতোলা নৌকার সারি।
মূলত, জমিদারি-সূত্রে বাংলাদেশে অবস্থানকালে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি এবং প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা মানুষের কাছাকাছি এসে নতুন করে গল্পলেখায় অনুপ্রেরণা পান রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় ১২৮৪ সালের শ্রাবণ মাসে ‘ভারতী’ পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায়। গল্পটির নাম ‘ভিখারিনী’। ১৮৯১ সালে সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ছয় সপ্তাহে ছয়টি গল্প রচনা ও প্রকাশ করেন। গল্পগুলো হলো দেনা-পাওনা, গিন্নি, পোস্টমাস্টার, তারাপ্রসন্নের কীর্তি ব্যবধান এবং রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা।
‘সাধনা’ পত্রিকা সম্পাদনার সময় রবীন্দ্রনাথ বারো মাসে বারোটি গল্প লেখেন। এগুলো হলো খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, সম্পত্তি সমর্পণ, দালিয়া, কঙ্কাল, মুক্তির উপায়, ত্যাগ, একরাত্রি, একটি আষাঢ়ে গল্প, জীবিত ও মৃত, স্বর্ণমৃগ এবং জয়ই পরাজয়। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনা চলতে থাকে।
ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মমতা দিয়ে শিশু চরিত্রগুলো অঙ্কন করেছেন। মূলত, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিশু-কিশোর গল্পগুলো রবীন্দ্রনাথের হাতেই লেখা। তার লেখা কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনি আর দূরদেশের এক কাবুলিওয়ালার কথা ভোলা যায় না। স্নেহ-ভালোবাসা যে দেশকাল বা জাতপাত মানে না, এ গল্পে তা-ই ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। এ ছাড়া পোস্টমাস্টার, ছুটি, বলাই, ইচ্ছেপূরণ প্রভৃতি গল্প আজও মানুষের মনে দোলা দেয়।
রবীন্দ্রনাথের রচনাবলির উল্লেখযোগ্য অংশ শিশুতোষ। ১৮৯৪ সালে কবির প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘ছোটগল্প’। এরপর আরও অনেক গল্পের বই প্রকাশিত হয় তার। পরবর্তী সময়ে সব গল্প একত্র করে গল্পগুচ্ছ নাম দিয়ে চার খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। কবির সর্বশেষ গল্পের নাম ‘প্রগতি সংহার’। তবে ‘শেষ পুরস্কার’ নামের একটি খসড়া গল্পও রেখে যান তিনি। সমাজব্যবস্থার শেকড়ে অবগাহন করে রবীন্দ্রনাথ তার গল্পে কঠিন বাস্তবতাকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেখানে আজও তিনি শ্রেষ্ঠতম আসনে অধিষ্ঠিত।
রবীন্দ্রনাথ তার লেখায় বাঙালির চিরদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া এবং সুখ-দুঃখের যে ছবি এঁকেছেন, সময় পরিবর্ত হলেও তা আজও অম্লান। বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষের এ বিরল সাধক যখন যেখানে হাত দিয়েছেন, তখন তা হয়ে উঠেছে আরও সরস, উর্বর ও বৈচিত্র্যময়। মূলত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বস্তরের মানুষের কবি। তাই শিশুরাও তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। বাঙালির চেতনাপ্রবাহের এই ত্রাণকর্তার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়নি শিশু-কিশোরেরা।
রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে শিশুর গণ্ডিবদ্ধ জীবনের বাইরে পাখির মতো স্বাধীনভাবে ডানা মেলে দেওয়ার ইচ্ছে যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মুক্ত জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে ‘সাধ’ কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর। বাংলা সাহিত্য যত দিন বেঁচে থাকবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকবেন আপন মহিমায়।