দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কর্মসূচি দেবে বিএনপি। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদ, দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দাবিতে ১ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ, ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক কঠোর হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণা না দিলেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে মাঠে থাকবে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে বেশ সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংগঠনের নেতারা চাচ্ছেন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন দলের নাম ও আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করতে। জানা গেছে, দলের নেতৃত্বে কারা আসবেন সেটিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে গরম হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন দল গঠন করা হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণ হবে। আর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে বিপক্ষের শক্তিগুলো সক্রিয় হলে রাজপথে উত্তেজনা ছড়াতে পারে। ফলে রাজনৈতিক নানা ঘটনার কারণে ফেব্রুয়ারি মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
তবে রাজনীতির নিষ্ঠুর বাস্তবতা বুঝতে বড় দেরি করে ফেলেছেন ইউনূস সরকারের ক্ষমতার উৎস ৫ আগস্ট বিপ্লবের ফ্রন্টলাইনাররা। আওয়ামী লীগের টার্গেট তারা আগে থেকেই। এখন বিএনপিসহ অন্যদেরও চক্ষুশূল। আবার তাদের নিজেদের কেউ কেউ, মানে কয়েক সমন্বয়ক জড়িয়ে গেছেন নানা বাজে কাজে। আগের সেই ইমেজ-সম্মানও নেই। সেদিন সাত কলেজের আন্দোলন থামাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে ফিরেছেন অন্যতম আলোচিত সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে আর কিছুক্ষণ অবস্থান করলে তার প্রাণহানিও হতে পারত। কোথাও কোনো গন্ডগোলের খবর শোনামাত্র একাই ছুটে যাওয়ার একটি বৈশিষ্ট্য এবং চর্চা রয়েছে হাসনাতের মধ্যে। ৩ জানুয়ারি মধ্যরাতেও নেমেছিলেন। সেই পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে চলে যান জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের আহতরা। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বিক্ষোভরত আহতদের শান্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে বলেন, সৎ উপদেষ্টারা যে এত আমলানির্ভর হবেন, এটা আমরা বুঝিনি। এর আগে একবার বলেছেন, রাজনীতিকেরা যত তৎপর হচ্ছেন তত ফাঁসির রশ্মি তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এ ঝুঁকিতে হাসনাতসহ কয়েকজন সমন্বয়কই।
নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার প্রস্তুতিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। একদিকে আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে চাপা পড়ে গেছে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা-সংক্রান্ত ফাইল, চিকিৎসায় অবহেলাসহ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ওয়াদা ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে তারা। আরেকদিকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল থেকে হুমকি-খোঁচা আসছে সমানে। ছাত্র সমন্বয়কেরা বড় রকমের ভুল ৫ আগস্টেই করে ফেলেছে। বিপ্লবী সরকার করেনি, যা চাইলেই তখন করতে পারত। প্রক্লেমেশন বা ডিক্লারেশন ঘোষণাও করেনি। এ ছাড়া ৬৯ বা ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ২০২৪ এর অভ্যুত্থানে যে বিস্তর তফাত ছিল-আছে, তা বুঝে উঠতে পারেনি।
ওই দুটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ফ্রন্টে ছাত্ররা থাকলেও নেতৃত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। চব্বিশের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল নীরবতায় বা মৌন সমর্থনে। ছাত্রদের ডাকে সব দলের রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে। শহীদের তালিকায় ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণির মানুষ রয়েছে। ছাত্ররা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে তখন বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল না করে কথিত আওয়ামী সংবিধান বহাল রেখে সরকার গঠনে সম্মত হয়েছিল। এখন হোঁচট খাচ্ছে প্রতি পদে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করতে দাবি তুলেও পিছু হটতে হয়েছে রাজনৈতিক সমীকরণের কাছে। নতুন সংবিধান রচনার দাবিতেও বাধা। ঘোষণাপত্রও আটকে গেছে রাজনীতির চোরাবালিতে।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক এবং আখতার হোসেনকে সদস্যসচিব করে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। তখন থেকেই ছাত্রদের নতুন দল গঠন করার বিষয়ে নানা আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এখন এটিকে দলীয় কাঠামোতে রূপান্তর করার চেষ্টা চলছে।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলে নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে। অবশ্য এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দল গঠন ও পদত্যাগের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে সরকারে থেকে কোনো রাজনৈতিক দলে থাকব না।’
অন্যদিকে ১৮ দিনের কর্মসূচি নিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সরকার থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর এটিই দলটির সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। বলা চলে, প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিও পালন করবে দলটি। যদিও শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে তারা। কর্মসূচির প্রথম দিনে লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কোথাও কোথাও তাদের গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
জানা গেছে, গত ২৮ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ট্যাঙ্গরা এলাকায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। সরকার পতনের পর এটিই ছিল দলের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা। ওই অঞ্চলে একটি বাসায় অবস্থান করছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার বাসায়ই বৈঠকটি করা হয়। কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ওয়ার্কিং কমিটির যেসব সদস্য অবস্থান করছেন, তারা প্রায় সবাই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ভারতে থাকছেন না এমন সদস্যরা এতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও টেলিফোনে সভায় যুক্ত ছিলেন। তিনি সবার বক্তব্য শোনেন এবং দিকনির্দেশনা দেন। ওই বৈঠক থেকেই ফেব্রুয়ারির কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিএনপি অবশ্য আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে অতটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই ইস্যুতে ঘোষণা দিয়ে কোনো কর্মসূচি পালনের পক্ষেও নয় তারা। দলের নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কোনো গুরুত্ব নেই। তাদের ঠেকাতে কর্মসূচি দিয়ে গুরুত্ব বাড়ানো এবং ইস্যু তৈরি করার কোনো মানে হয় না। বিএনপির নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি জনজীবনে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারবে না। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করবে। বিএনপির প্রধান সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এরই মধ্যে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। জামায়াত আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি না দিলেও তারা জুলাই গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবি করে আসছে। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে খুবই সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে গঠিত জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে গেছেন সারজিস আলম। বিয়ে করে দাম্পত্যজীবন আর নতুন দল গঠনে ব্যস্ত তিনি। অভ্যুত্থানের ছয় মাসেও আহত অনেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। তারা প্রায়ই রাস্তায় নামছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা ড. ইউনূসের হার্ড কোরের মানুষ। তার কার্যক্রম তেমন দৃশ্যমান নয়। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা। উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা থাকলেও মাঝপথে বাগড়া পড়েছে। সেখানেও নানা সমীকরণ। এসবের মাঝে নানান কিছু আউলাঝাউলা হয়ে যাচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের কিছু কথা ও কাজে। বড় চেয়ারে বসার পর অনেকটা খেই হারানোর মতো অবস্থা এই সজ্জন-মার্জিত-শিক্ষিত ব্যক্তির। নানা শিশুসুলভ ভঙ্গি ও কাণ্ড ঘটিয়ে ভাইরাল তিনি।
শফিকুল আলমের নিয়োগকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারকে এর জন্য বাড়তি সমালোচনা সইতে হচ্ছে, যা ধারণা বা হিসাবের মধ্যেও ছিল না। ছাত্ররাও বিব্রত-অপমানিত। তারা তাকে স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই করতে পারছে না। সেই সঙ্গে সামনের সম্ভাব্য ঝুঁকির পুরোটা ছাত্রদেরই। কারণ একটা সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেস সচিবই নয়, চলে যাবে ড. ইউনূসের সরকারও। সমন্বয়কসহ ও নতুন দল করতে যাওয়া ছাত্রদের মাঠে থাকতে হবে। বহু মত-পথের প্রতিপক্ষের সঙ্গে টিকে থাকা তাদের জন্য তখন কত কঠিন হবেÑএ ভাবনা পেয়ে বসেছে সংশ্লিষ্টদের। আর তারা টিকে গেলে নির্ঘাত বড় রকমের ঝামেলায় পড়বেন দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ভর করে থাকা আদু ভাইরা। যারা রাস্তা ছাড়েন না, পাশও কাটেন না। জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসা এ আদু ভাইরা এবারের ছাত্র আন্দোলনকারীদের চোখে কেবলই জঞ্জাল।