সাধারণভাবে ইংরেজি শেরিফ (Sherriff) শব্দ দিয়ে কোনো কাউন্টি বা শহরের প্রধান আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাকে বোঝানো হয়, যিনি বিচারিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা হিসেবে কোর্ট ও বিচারক প্রদত্ত নির্দেশ ও হুকুম তামিল করেন। মধ্যযুগের ইংল্যান্ডে শেরিফকে ইংল্যান্ডের রাজা বা রানির দ্বারা নিয়োগকৃত কর্মকর্তাকে (Officer of the crown) বোঝানো হতো। ক্যাজুয়েল আলাপচারিতায় কথা প্রসঙ্গে কেউ কেউ কখনো-সখনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকেও শেরিফ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
গত ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে দেশের শাসন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নতুন শেরিফের আগমন ঘটে। ওই দিন জো বাইডেনের হিসাবে ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্র পরিচালনার শপথ নেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ডিসির ক্যাপিটল ভবনে হওয়ার কথা থাকলেও হাড়-কাঁপানো তাপমাত্রা (২৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কাছাকাছি) ও সম্ভাব্য তুষারপাতের কারণে খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য মানুষের (৭০-৮০ হাজার) দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ক্যাপিটল ভবনের অভ্যন্তরে গোলাকার ছাদের নিচের হল ঘরে (Rotunda) স্থানান্তর করা হয়, যেখানে মাত্র ৮০০ মানুষের স্থান সংকুলান সম্ভব হয়। শপথ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সস্ত্রীক জো বাইডেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ বুশ, ওবামা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা, কংগ্রেস সদস্যরা ও ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বিলিয়নিয়ার উপস্থিত ছিলেন। হিলারি ক্লিনটন ও লরা বুশ উপস্থিত থাকলেও মিশেল ওবামা উপস্থিত হননি। ট্রাম্পের প্রতি তার দীর্ঘদিনের ক্ষোভের কারণে তিনি অনুষ্ঠানে আসেননি বলে কেউ কেউ ধারণা করেন। একই কারণে কয়েক দিন আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শেষকৃত্যেও তিনি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। সে অনুষ্ঠানে ট্রাম্প উপস্থিত ছিলেন।
শপথ নেওয়ার জন্য ক্যাপিটল ভবনে আসার আগে ট্রাম্প দম্পতিকে বাইডেন ও তার স্ত্রী জিল বাইডেন হোয়াইট হাউসে ‘Welcome back Home’ বলে অভ্যর্থনা জানিয়ে চা-চক্রে আপ্যায়িত করেন।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে এবং একই কোর্টের বিচারপতি ব্রেট ক্যাভানো ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেডি ভ্যান্সকে শপথবাক্য পাঠ করিয়ে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর কাজ সম্পন্ন করেন।
শপথ শেষে ট্রাম্প তার আধা ঘণ্টা স্থায়ী ভাষণে এই মুহূর্ত থেকে দেশে এক স্বর্ণযুগের সূচনার ঘোষণা দেন। বিগত কয়েক বছরে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে অবক্ষয়ের (Decline) পথে অগ্রসর হচ্ছিল, তা থেকে দেশকে উদ্ধারে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেন। তার ভাষায় ‘I will fix every crisis facing the country.’ এসবের মধ্যে দক্ষিণ সীমান্তের সব প্রবেশপথ সিল করে অবৈধ অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা, সীমান্ত দিয়ে মাদক ও হিউমেন ট্রাফিকিং কাজে নিয়োজিত কার্টেলগুলোকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করে তাদেরকে নির্মূল করা, অনুপ্রবেশকারীদের ধরে ছেড়ে দেওয়ার নীতি (Catch and Release) বাতিল, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদনের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে মেক্সিকোতে থাকার (Remain in Mexico) নীতি চালু এবং জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্ব (Birthright citizenship) লাভের নীতি বাতিল অন্যতম।
তা ছাড়া গ্রিন নিউ ডিল বাতিলের ও প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসার ঘোষণাও দেওয়া হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইলেকট্রিক গাড়ির বাধ্যতামূলক প্রচলনের নীতি বাতিল করা হয়। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে তেল-গ্যাস আহরণ (Drill Baby Drill) এবং তা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় নির্বাহী আদেশ জারি করা হবে বলে তিনি জানান। পানামা খাল দিয়ে চলাচলকারী মার্কিন বাণিজ্য ও নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর ওপর পানামার কথিত মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ ফি ধার্যের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। এহেন কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানান। এর অন্যথা হলে পানামা খালকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার হুমকি দেওয়া হয়, যেটাকে অনেকে ট্রাম্পের Termitaria Extension নীতির একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে এর সমালোচনা করেন। ট্রাম্প কর্তৃক ৬ জানুয়ারির দাঙ্গায় জড়িত ব্যক্তিদের ক্ষমার ঘোষণা নিজ দলসহ বহু মহলে ব্যাপকভাবে নিন্দিত/সমালোচিত হতে দেখা যায়। ক্ষমাপ্রাপ্ত দেড় হাজার ব্যক্তির কারও কারও বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও সহিংসতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ বাতিলের ঘোষণা মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেটাও বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে।
ট্রাম্প তার ভাষণে নির্বাচনে তাকে বর্ধিত সংখ্যায় সমর্থনের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপ্যানিকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি তার স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট থাকবেন বলে জানান। তার ভাষায়, ‘I will try to make his dream come true.’
নিউইয়র্ক টাইমস ও ইপসসের (IPSOS) এক সাম্প্রতিক জরিপে ট্রাম্পের ঘোষিত নীতির প্রতি অধিকাংশ (৫৫ ভাগ) মার্কিন নাগরিকের সমর্থন রয়েছে বলে দেখা যায়, যদিও তাদের অনেকের কাছে তিনি ব্যক্তিগতভাবে তেমন পছন্দনীয় নন। ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি দিনটিকে মুক্তির দিন (liberation) বলে উল্লেখ করেন, যা বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দিনটির কথা মনে করিয়ে দেয়, যেদিন বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ফিরে পেয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ট্রাম্পের ভাষণকে বেশ বাস্তবানুগ (Substantive) মনে হয়েছে। মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের জন্য এটি ছিল এক প্রচণ্ড ধাক্কাস্বরূপ (Shock and Awe)। ভাষণের দু-একটি বিষয় বাদ দিলে এটি বিপুলসংখ্যক মার্কিন নাগরিকের মনে ধরেছে বলে প্রতীয়মান হয়। আর এটাই মূলত ডেমোক্র্যাটদের কপালে চিন্তার ভাঁজের কারণ হয়েছে। ট্রাম্প যেভাবে রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে তাদেরকে ক্রমাগতভাবে টেক্কা দিচ্ছেন, তাতে করে আগামী দিনে তাদের পক্ষে রাজনীতিতে সাফল্য লাভ করা কষ্টকর হবে বলে মনে করি। লেখক : কলামিস্ট