বিন্দু বিন্দু জলরাশি একত্রিত হয়ে এক বিরাট সাগরের সৃষ্টি করে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের জলরাশি আমাদের জানান দেয় তার অস্তিত্ব, সাগরের বিশালতা আমাদের বুঝতে শেখায় যেকোনো কিছুই তুচ্ছ নয়। বর্তমানে যাকে আমরা ক্ষুদ্র কিংবা ছোট ভেবে তুচ্ছ মনে করি, কোনো না কোনো সময় তা বিশাল সাগরে পরিণত হয়ে নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এই বিশাল সমুদ্রে কত শত রহস্য যে লুকিয়ে আছে, তার কোনো হিসাব জানা নেই, সেখানে বিদ্যমান রয়েছে কত শত জলজ জীব, তার ইয়ত্তা নেই। সমুদ্র আমাদের শিক্ষা দেয় গভীর মনোভাবি হতে আর বুঝিয়ে দেয় যে জীবনে দৃঢ়তার সঙ্গে পথচলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তাই হয়তো প্রবাদে উল্লেখিত আছে, ‘সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না।’ স্বাধীনতা, মুক্ত বাতাস এবং দুঃসাহসিক হওয়ার অদম্য প্রেরণা। এগুলো আমি সমুদ্রের মাঝেই পেয়েছি, সাগরের থেকেই শিখেছি। সমুদ্র আমায় দিয়েছে মানুষের প্রয়োজনের শিক্ষা। একজন ব্যক্তির কতটুকু প্রয়োজন সেটাই মুখ্য বিষয়, কতটা প্রয়োজন সেটা নয়। ঘরের ভেতর বসে বসে নিরর্থক অপেক্ষা না করে বাইরে বেরিয়ে আসুন, দু’চোখ ভরে এ বিশ্বকে দেখুন, জানুন, জীবনটাকে উপভোগ করুন। উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি স্পর্শ করুক আপনার শরীর ও মন, সাগরের বিশালতার মাঝে নিমজ্জিত হোন।
সমুদ্রের ঘ্রাণ নিয়ে আকাশের বিশালতাকে অনুভব করা, জীবনের হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ সেই পাওয়া। যেখানে আকাশ করেছে সাগরকে স্পর্শ, আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য সেই স্থানে, যেখানে দিগন্তের শুরু হয়। এক ফোঁটা জলবিন্দুতে মহাসাগরের সব রহস্য যেন লুকিয়ে আছে। সমুদ্রের বিশালতা ও গভীরতা আমাদের মনে শক্তি জোগায়, অনুপ্রেরণা দেয় নতুন কিছু করার, শিক্ষা দেয় থেমে থাকতে নেই, চলার নামই জীবন। আপনি জলের যে প্রতিটি বিন্দু গ্রহণ করেন, প্রতি মুহূর্তে যে প্রশ্বাস নেন প্রাণভরে, তা সমুদ্রের সঙ্গেই জড়িত। আপনি পৃথিবীর কোথায় অবস্থান করছেন, তা বিচার্য নয়।
সমুদ্র অন্তহীন আর অন্তহীন পথচলাই জীবন। আলো আর নির্জনতায় সমুদ্রের সঙ্গে একলা হওয়ার রোমাঞ্চই আলাদা। যেখানে আকাশ আর সমুদ্র মিলিত হয়, সেখানেই মনে হয় মুক্তির ঠিকানা। সমুদ্রের ঢেউ বলে দেয় জীবনের গল্পÑউত্থান-পতন সবই সৌন্দর্যের অংশ। সমুদ্রের নীল স্রোতে হারিয়ে যায় মন, খুঁজে পাই নতুন আশা। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই জীবন, কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। নীল জলরাশির মাঝে খুঁজে পাই একান্ত মুহূর্তের শান্তি। সমুদ্রের গর্জনে লুকিয়ে থাকে পৃথিবীর সব গান। যখন কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, তখন সমুদ্রের ঢেউ হয়ে কথা বলে। যতবার সমুদ্র দেখি, ততবার মনে হয় আমি নতুন করে বাঁচতে শিখছি। নীল সমুদ্র, সাদা ঢেউ আর এক আকাশ স্বপ্নÑজীবন এভাবেই সুন্দর।
সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ মনে করিয়ে দেয়, সবকিছুই নতুন করে শুরু করা যায়। সমুদ্র কখনো শেষ হয় না, যেমন আমাদের স্বপ্নও শেষ হয় না। সমুদ্রের গভীরতা আমাদের হৃদয়ের গভীর অনুভূতিগুলোর মতোই অজানা। যখন কিছুই বুঝতে পারি না, তখন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজি। সমুদ্রের নীরবতায় লুকিয়ে থাকে হাজারো গল্প। সমুদ্র বলে দেয়, জীবন অনেক বড় আর প্রতিটা দিনই নতুন। সমুদ্রের তীরে বসে বুঝতে পারি, প্রকৃতির কাছে আমরা কত ছোট। সমুদ্র কখনোই হাল ছাড়ে না, তার ঢেউ সব সময় এগিয়ে যায়। সমুদ্রের মতো ভালোবাসাÑগভীর, অবারিত আর অনন্ত।
যেখানে সমুদ্র শেষ হয় না, সেখানেই শুরু হয় অনন্তকালের সৌন্দর্য। সমুদ্র আমাকে শেখায় ধৈর্য, শক্তি আর অগাধ বিশ্বাস। জীবন সমুদ্রের মতো, যা সর্বদা ওঠানামা করে। আমার ভাবনাগুলোর খোঁজ পাবে না কখনো কেউ, সে কখনো নদী, কখনো আবার সাগরের ঢেউ। পৃথকভাবে আমরা প্রত্যেকেই একবিন্দু জলকণার মতো। সামগ্রিকভাবে আমরা একটি মহাসাগর সৃষ্টি করতে পারি। আলো যেখানে আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না, তরঙ্গগুলো আপনাকে বহন করে নিয়ে চলে। সমুদ্রের ভেতর যে রকম একটি নদী হারিয়ে যায়, তেমনি স্বার্থের সমুদ্রে নিজের সদগুণকে হারিয়ে যেতে দেবেন না।
সমুদ্র সংযত হতে পছন্দ করে না। সাগর তার রূপের মহিমা দিয়ে মানুষকে যেমন সুন্দর জীবনের হাতছানি দেয়, তেমনি মানুষের মনেপ্রাণে জাগ্রত করে তোলে বিচিত্র আবেগ ও অনুভূতি। প্রত্যেক মানুষের সমুদ্রের ঢেউ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত; পুরোনো বা অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুনকে আলিঙ্গন করে নেওয়াই যে জীবন। যার যেখানে স্থান, সে সেখানেই উপযুক্ত; ভূমিতে যেমন মানুষের রাজত্ব, সাগরেও তেমনি মৎস্যকুলের। মানুষের মন ও তার চিন্তাভাবনা হতে হবে সমুদ্রের মতো অসীম ও উদার। সমুদ্রের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারই-বা আছে?
মানবতা সমুদ্রের মতো, সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা যদি নোংরা হয়ে যায়, তবে সমগ্র মহাসাগর ময়লা হয়ে যায় না। আপনার চিন্তা, অনুভূতি এবং সংবেদনগুলো হলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, যা অনবরত আসা-যাওয়া করে। সাগরের মধ্যে যেমন আছে বিশাল সুকঠিন তরঙ্গ, তেমনি নরম কোমল তরঙ্গরাশিও সেখানে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এর সবকিছুই জল ও সমুদ্রের অংশবিশেষ। সমুদ্রের সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা আমাদের জীবনকে বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়, যা আমাদের কল্পনার অনেক বাইরে। একসঙ্গে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে থাকলে সমুদ্রের মতো গভীর এবং আকাশের চেয়েও উচ্চতর যেকোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারি।
জীবনসমুদ্রের মুক্তোগুলো সন্ধান করতে হলে আপনাকে উপকূলের অনেক দূরে যেতে হবে। ‘আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান। দাঁড় ধ’রে আজ বোস্ রে সবাই, টান রে সবাই টান॥ বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী, ঢেউয়ের ‘পরে ধরব পাড়িÑযায় যদি যাক প্রাণ। ওই সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাজল ভেরী, বাজল ভেরী। কখন আমার খুলবে দুয়ারÑনাইকো দেরি, নাইকো দেরি। আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে। বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে।’ নদী যদি বলে সাগরের কাছে যাব না, তাই কি হয়? মেঘ যদি বলে আকাশের বুকে ভাসব না, তাই কি হয়?
এই সাগরের কত রূপ দেখেছিÑকখনো শান্ত রূপে কখনো অশান্ত, সে আমি শুধু চেয়ে চেয়ে থেকেছি। মনে হয় এ তো নয় বালুচর, আশা তাই বাঁধে ঘর; দাঁড়ায়ে একলা শুধু ঢেউ আর ঢেউ গুনি, এ গোনার নেই যে বিরাম আজ, সবকিছু দিয়ে আমি জানি না তো কী যে নিলাম। সাগর... ডাকে আয় আয় আয়, আমার গানে, জীবন আনে, চলার ইশারায় চঞ্চল হৃদয় এর স্বপ্নস্রোতে চিহ্ন রেখে যাই প্রেম সৈকতে ডেকে ডেকে উদ্যম এই সংগীতে আকাশের শূন্যতা চাই ভরে দিতে, আমার ধ্বনি প্রতিধ্বনি বাতাস ছড়িয়ে যায়।
সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত, কখন তো হই নাই ক্লান্ত, তথাপি মনের মোর প্রশান্ত সাগরে উর্মিমালা অশান্ত- মোর মনের প্রশান্ত সাগরের বক্ষে জোয়ারের নাই আজ অন্তঃঅজস্র লহরী নব নব গতিতে এনে দেয় অফুরন্ত আশা। উন্মুক্তভাবে নিজেকে সমুদ্রের বুকে ছেড়ে দিয়ে দেখে নাও তুমি কেমন। সমুদ্র সীমাহীন...মানুষের জীবনও ঠিক একটি সমুদ্রের মতো, যার স্বপ্ন ও চাহিদার কোনো অন্ত নেই।
শত্রু এবং সমুদ্র যদি শান্ত ও ধীর থাকে, তাহলে সবাই অনায়াসেই অস্ত্র ধরে রাখতে পারে। মানুষের ভালোবাসা সমুদ্রের মতো অন্তহীন হওয়া উচিত, যা কখনো ফুরোবে না। সাগরের একটি ভগ্নতরঙ্গ যেমন পুরো সমুদ্রকে ব্যাখ্যা করতে পারে না, তেমনি মানবজীবনের একটি অসাফল্যের ঘটনা তার পুরো জীবনকে ব্যাখ্যায়িত করতে পারে না। মানসিক অবসাদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সমুদ্রের পাশে বসে কাল যাপন করা।
মানুষের জীবনের সুখ, শান্তি ও আনন্দঘন মুহূর্তগুলো ঠিক একটি সাগরের ঢেউয়ের মতো; যা সব সময় ফিরে আসে না। যে ব্যক্তি কোনো দিন সাগরের রূপ দর্শন করেনি, সে জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্যের সম্মুখীন হওয়া থেকে বঞ্চিত। মাছ ধরার উদ্দেশ্যে যেমন সমুদ্রে নামতেই হয়, তেমনি সফলতা পেতে গেলে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেই হবে। সমুদ্রের সঙ্গে নারীর সদৃশ, চেহারা নাকি চাঁদের কণা, চুল নাকি বিদিশার নিশা? সাগরের মতো গভীর নয়ন তোমার ডুবে যাই বারেবার। তোমার সাগর দুটি চোখে আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার যাত্রাপথ। যত ভাবনা আমার, যত স্বপ্ন আমার, সব দিয়েছি তোমায়। তুমি নেবে কি আমায়, ডেকে নেবে কি আমায়?
হে সাগর, যখনই তোমায় দেখি, তোমার অন্ত নাহি পাই দু’চোখে জল নিয়ে ভাবি আমিও সাগর হয়ে যাই। দেখো, তোমার আমার কত মিল, আকাশের রঙে তুমি নীল, আমিও আমার দুটি নীল চোখে তোমার নীল রং মেখে নিতে চাই। সমুদ্র তার সৌন্দর্যে আমাদের যেমন বিলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি তার অস্তিত্ব কেড়েও নিতে পারে। সমুদ্র কখনো-বা উদার হওয়ার শিক্ষা দেয়, আবার কখনো-বা কঠোর হতেও পরামর্শ দিয়ে থাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। সমুদ্র তার গর্জনেই তার অস্তিত্বের জানান দেয়। সমুদ্র তেমনি নিয়ে নিতেও জানে; কত শত প্রাণ যে সে হরণ করেছে, তার খোঁজ কেউ রাখতে পারেনি।
হে সমুদ্র, কত রত্ন আছে তোমার বুকে, কত মুক্তা ঝরে তোমার প্রবালে। দেখো, আমার চোখের ঝিনুকে এই বুকে তা জানে না তো কেউ, আমার হৃদয়ে উপচে ওঠে আর পড়ে যায় তোমারই মতো শত সহস্র ঢেউ। তোমার মতন যেন আমার বেদনা উথালিপাথালি করে আমার এ বুকে, আমার ক্ষণিক জীবনধারায় বেঁচে থাকা সুখে আর দুঃখে। তুমি অবিচল, অবিরাম, অবিনশ্বর এই ধরায়। তোমার গভীরতা অনুধাবন করার জন্য সমুদ্রভ্রমণ আমাদের একান্ত প্রয়োজন। সুবিশাল অস্তিত্বের অধিকারী তুমি। তোমার শুধু শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। ও হে সমুদ্র নীল দরিয়া, তোমাকে হৃদয়ে ভরিয়া, সুখের করিয়া রাখিব আজনম ধরিয়া।