Thikana News
০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

প্রদেশ গঠনের সুপারিশ প্রসঙ্গে

প্রদেশ গঠনের সুপারিশ প্রসঙ্গে
দেশের পুরনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেওয়ার পক্ষে এই কমিশন।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা না দিলেও ওই অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা তাঁদের সম্ভাব্য কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে চারটি প্রদেশ করার বিষয়টিও রয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে চারটি প্রদেশ করা। এই চার প্রদেশ হলোÑ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা।
বাংলাদেশে একাধিক প্রদেশ করার আলোচনা নতুন নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ‘রাষ্ট্র মেরামতের এখনই সময়’ শীর্ষক একটি লেখায় পাঁচটি প্রদেশ করার প্রস্তাব করেন। পাঁচ প্রদেশের কাজ কী হবে, সেই ধারণাও দেন তিনি। বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ।
জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি। ছোট দেশ হলেও এত বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারকে নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করা যেতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে দু’টি করে চারটি প্রদেশ এবং বৃহত্তর ঢাকা নিয়ে আরেকটি প্রদেশ। মেট্রোপলিটন ঢাকা কেন্দ্রশাসিত থাকবে। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমানা ও সমুদ্রনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো থাকবে।
বাকি বিষয়গুলোতে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধান থাকলেও প্রদেশগুলো ব্যবস্থাপনায় থাকবে।
প্রদেশ গঠন নিয়ে শুধু আলোচনা নয়, এ নিয়ে দাবিও আছে। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি ও জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল তিন দশক ধরে আটটি প্রদেশ গঠনের দাবি করে আসছে। এ ক্ষেত্রে এখন বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া খুবই যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সংগত। তবে আটটি প্রদেশ হবে, না পাঁচটি প্রদেশ হবে অথবা এর কমবেশি হবে, তা ঠিক করবে সরকার ও নির্বাচিত সংবিধান সভা। কারণ বিষয়টি সাংবিধানিক। অর্থাৎ সংবিধানের বিষয়। এখানে মনে রাখতে হবে, ১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার যে ভুল করেছিল, এবার আর তা করা যাবে না। তাই সংবিধান সভায় পাস করে এই সংবিধান গণভোটে দিয়ে দেশবাসীর মতামত নিতে হবে। নতুন সংবিধানে এক কক্ষবিশিষ্ট না দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও একাধিক প্রদেশ গঠন করে ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো করা হবে কি না, সে প্রশ্নের সমাধান করার এখনই সময়। কারণ এখন রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম চলছে। এই কার্যক্রমের মধ্যেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। এই সেবা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই সময়ের দাবি প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ। আর এই বিকেন্দ্রীকরণের সর্বোত্তম পন্থা হলো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রবর্তন। আর তা করতে হলে দেশকে বেশ কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করতে হবে। এরই মধ্যে এই প্রস্তাবও এসেছে।
অবশ্য এই প্রদেশ গঠন নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বেরও যথেষ্ট কারণ আছে। এই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের দেশের এলিট শ্রেণিরা যেমন ঢাকা ছাড়তে চায় না, ঠিক তেমনি সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঢাকার বাইরে বসবাসের চিন্তা পর্যন্ত করেন না। এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত বিসিএস ডাক্তাররা উপজেলায় কাজ করলেও তাঁদের স্ত্রী-পুত্র থাকে ঢাকা শহরে। তাই তাঁরা বৃহস্পতিবার অফিসে হাজিরা দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। যান  রোববারে দিনের শেষে। একই ঘটনা ডিসি-এডিসিদের বেলায়ও। অথচ এমন একদিন ছিল, যখন ডিসি-এডিসিরা পরিবার-পরিজন নিয়েই কর্মস্থলে থাকতেন। তাই এ ক্ষেত্রে আমলারা প্রদেশ গঠনে একটি বড় বাধা হতে পারেন। সেই সঙ্গে তথাকথিত এলিটরাও একটি বড় বাধা। এখানে মনে রাখতে হবে, যেদিন প্রদেশ গঠনের ঘোষণা আসবে, সেদিন সংশ্লিষ্ট এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। ১০টি ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি আনন্দ করবে ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, ক্ষেতমজুর। কারণ তারা জানবে তাদের আর যখন-তখন ঢাকায় দৌড়াতে হবে না।
প্রদেশ বা রাজ্য গঠন নিয়ে আরো একটি কথা না বললেই নয় তা হলো, অনেকেই বলে, আমাদের ছোট্ট একটি দেশ, এই দেশকে ভাগ করার কী দরকার? এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩৫ কোটি। অথচ রাজ্য ৫০টি। গড়ে প্রতিটি রাজ্যে এক কোটিরও কম লোকের বসবাস। বিশ্বের আরেক বৃহৎ দেশ রাশিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ১৪ কোটি। অথচ রাশিয়ায় রাজ্যের সংখ্যা ২১। ওরা অবশ্য রাজ্য বলে না, বলে রিপাবলিক। এ ছাড়া আছে ৯টি অঞ্চল, ৪৬টি বিশেষ অঞ্চল, একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ও চারটি স্বায়ত্তশাসিত জেলা। ফ্রান্সের জনসংখ্যা মাত্র সাত কোটি। অথচ এই দেশটি ১৮টি অঞ্চলে বিভক্ত। জার্মানিও একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। রাজ্য সংখ্যা ১৬। অথচ দেশটির জনসংখ্যা মাত্র আট কোটি ৪০ লাখ। ইতালির জনসংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটি। অথচ ইতালি ২০টি অঞ্চলে বিভক্ত। এ ছাড়া ভ্যাটিকান ও সান মারিনো নামে দু’টি স্বাধীন নগর রাষ্ট্র আছে ইতালির ভেতরে। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল আমাদের মতোই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশ। জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি। এই দেশটিও ছয়টি প্রদেশে বিভক্ত। ফেডারেল কাঠামোর দেশ। আরেক প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ। প্রদেশের সংখ্যা ৯। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাতের জনসংখ্যা মাত্র এক লাখ। রাজ্য সাতটি। আরেক প্রতিবেশী পাকিস্তানের আছে চারটি প্রদেশ। একইভাবে আফগানিস্তানের জনসংখ্যা মাত্র চার কোটি ২৯ লাখ। অথচ দেশটিতে রয়েছে ৩৪টি প্রদেশ। তাহলে আমাদের বাংলাদেশ চার-পাঁচ বা ছয়-সাতটি প্রদেশে বিভক্ত হতেই পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এতে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল কেন্দ্র ঢাকা থেকে সরে বিভিন্ন প্রদেশে যাবে। তখন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক খেলাও বদলে যাবে। কোনো একটি একক দল কেন্দ্রে ও সব প্রদেশে সরকার গঠন করতে পারবে না। প্রতিটি প্রদেশে পৃথক দলের সরকার হবে। এতে ভোটের রাজনীতি গতি পাবে। নেতারা রাজ্য ছেড়ে রাজধানীতে কমই আসবেন। সর্বোপরি যে রাজ্যে ভালো শাসকদল থাকবে, সে রাজ্যের উন্নতি বেশি হবে। এতে রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা হবে।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো- সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন অথবা একেবারে নতুন করে নতুনভাবে সংবিধান রচনাসহ সামগ্রিক রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে জুলাই অভ্যুত্থানের জন-আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে।
এই বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী একটি জাতীয় দৈনিকে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার নতুন সংবিধান সংসদে পাস না-ও করতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নুরুল আমিন বেপারী এ বিষয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা হলো নির্বাচিত সরকারের প্রশ্ন। আমি মনে করি, এই প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। কারণ এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, এটি যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে এটিও সত্য যে এই সরকার জন-আকাক্সক্ষার, জনগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সরকার। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এই সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের সরকার; যে আন্দোলনে ছাত্র-জনতা শুধু সমর্থনই দেয়নি, ওই অভ্যুত্থান সফল করতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, জনগণ সার্বভৌম হলে ‘নির্বাচিত সরকার’, ‘নির্বাচিত সরকার’ বলে এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা কেন? এই প্রচেষ্টা প্রকারান্তরে সাবেক ফ্যাসিবাদকেই সমর্থনের নামান্তর।
যা হোক, তার পরও বলব, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সমন্বয় করে যত দ্রুত সম্ভব তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করবে। আরেকটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ সংসদ নির্বাচন দেওয়ার আগে অবশ্যই একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সভা গঠন করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি এই সংবিধান সভা নতুন সংবিধান পাস করবে। তারপর গণভোট হবে। তার পরও কি পরবর্তী সরকার ও সংসদ নতুন সংবিধানকে অস্বীকার করবে? না করতে পারবে? কখনোই না। আর যদি তা করার প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে ধরে নিতে হবে, ওই সরকারে ফ্যাসিবাদের পেতাত্মা ভর করেছে। যা হোক, এ দেশে ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মাদের কোনো স্থান নেই। স্থান হবেও না কোনো দিন।
সব শেষে আবারও বলছি, অতীতে বাংলাদেশ বারবার বিজয়ী হয়েছে; কিন্তু প্রতিবারই বিজয় ছিনতাই হয়ে গেছে। এবার যেন তা না হয়। এই বিষয়ে অরর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সঠিকভাবেই বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, সেটি যেন হাতছাড়া না করে ফেলি। এই সুযোগ আবারও হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাবো। তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, আর আমরা পরাজিত হবো না। আমরা বিজয়ী হবো। জাতি হিসেবে দুনিয়ার বুকে মাথা তুলে দাঁড়াব মান-মর্যাদা আর সাহসের সঙ্গে। এটিই বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার ছাত্র-জনতার কাম্য।
তাই আশা করি, আর ব্যর্থতা নয়। এবারই আদায় হোক জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ। প্রশাসন পৌঁছে যাক জনগণের কাছে। জনগণের দোরগোড়ায়।
লেখক : কলামিস্ট।
 

কমেন্ট বক্স