Thikana News
০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
একজন নবীন লেখক বরাবর খোলা চিঠি

লেখকের দায়বদ্ধতা, স্বাধীনতা এবং প্রাপ্তি

তোমার লেখায় উঠে আসবে মানুষের কথা। এ বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের কথা। বিশ্বমানবতার কথা। আমি বলব একেবারেই সোজাসাপ্টা কথা। তাদের পক্ষেই তুমি কলম ধরো। তাদের কথাই লিখো
লেখকের দায়বদ্ধতা, স্বাধীনতা এবং প্রাপ্তি
[প্রথম পর্ব]

হে নবীন,
সাহিত্যজগতে তোমাকে স্বাগত!
তুমি সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছ। এ জন্য তোমাকে জানাই অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। এই সময় ‘লেখকের দায়বদ্ধতা, স্বাধীনতা এবং প্রাপ্তি’ শিরোনাম দিয়ে তোমার বরাবর লিখতে বসেছি আমার খোলা চিঠি। 
হে ব্রতধারী,
প্রথমেই জেনে রাখো, তুমি যে বন্ধুর পথে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছ, সেই পথ থেকে ফিরে আসার উপায় নাই! এবং তোমার কোনো মুক্তি নাই! তোমার দায়কে এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য কোনো পথ নাই। মূলত তোমার নিজের শৃঙ্খলে তুমি নিজেই বন্দী হয়ে আছ। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে চলেছ নিয়তই, ‘তুমি এখন কার? শুধুই কি তোমার?’ না আছে তোমার অর্থ, না আছে বিত্ত, না আছে প্রভাব-ক্ষমতা। তার পরও বুঝি। টের পাও তুমি। তোমার বিবেক আমাকে টানা দংশন করছেই, ‘দাও। দাও। মানুষকে। সমাজকে। যা পারো দাও!’ আমিও বলি, না। মানুষ তোমার কাছ থেকে চায় না অর্থ সাহায্য। চায় না বৈষয়িক কিছু। কিন্তু তারা চায় তুমি তাদের কথা বলো। তুমি তাদেরকে দেখো। নিরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ করো। তাদের কথা শোনো। তুমি হাত বাড়াও। সে হাতে থাকবে তোমার কলম।
তোমার লেখায় উঠে আসবে মানুষের কথা। এ বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের কথা। বিশ্বমানবতার কথা। আমি বলব একেবারেই সোজাসাপ্টা কথা। তাদের পক্ষেই তুমি কলম ধরো। তাদের কথাই লিখো। তোমার প্রতিবেশী মানুষকে দেখাও তুমি, তোমার আছে এই একটি মাত্র সম্পদ। যা দিয়ে উপরতলায় আওয়াজ তুলতে পারো। নিচের তলার মানুষদের কথা জানান দিতে পারো। এর চেয়ে বেশি কিছু তো তারা তোমার কাছে চায় না। তারা তোমার কাছে অধিক কিছু আশাও করে না এবং যা তুমি দিতে পারো, নিশ্চিত জেনো অন্য অনেকেই তা পারে না। আবার কেউ কেউ পারে। তো তারা আবার তোমার মতো নয়। তুমিও তাদের মতো নও। যার যার মতো, সকলেই তা করবে। তুমিও করবে। তাই তুমিও সম্ভাব্য সবকিছু করো, যা অন্যদের মতো হবে না। তুমিও কিছু বলো, যা অন্যদের মতো হবে না। তোমার নিজের মতো লিখো।
তোমার লেখা হবে আলাদা। তোমার সেই লেখা হবে হৃদয়স্পর্শী। মানুষের কাছে তা হবে গ্রাহ্য। তোমার পাঠক তারা, তাদের আশার, ভাষার এবং ভরসার কথা খুঁজে পাবে তোমার প্রচ্ছদের অভ্যন্তরে। তোমার অন্তঃসলীলে প্রবহমান ধারায়, তাদের হৃদয়ের স্পন্দন অনুরণিত হবে। তবে আর চুপচাপ বসে থাকা কেন? কেন তুমি নিজেকে এত অগ্রাহ্য, অপাঙ্্ক্তেয় মনে করছ? তুমি নিজেকে ‘অকৃতী-অধম’ হিসেবে মূল্যায়িত করছ। হ্যাঁ, নম্রতা গুণীর ভূষণ। যে যত গুণী, সে তত নম্র। বিনয়ী। সাধারণ মানুষ কারও ঔদ্ধত্য পছন্দ করে না। সে অর্থবিত্তের বা শিক্ষা-জ্ঞানের অধিকারী, যেই হোক না কেন। সাধারণ মানুষ যেমন বিনয়ী হয়, সরল হয়। হ্যাঁ, তোমাকেও সেই বিনয় ও সরলতাকে তোমার সত্তায় ধারণ করতে হবে। তোমার পোশাকে, তোমার চলনে, তোমার বলনে এবং তোমার স্থিতিতে তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। এমনকি যেখানে তুমি পা বাড়াবে, তোমাকে বুঝে নিতে হবে; পাশের মানুষেরা তোমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তারা তোমাকেই নিরীক্ষণ করছেন। তুমি তাই এমন কোনো পথে পা বাড়াবে না, যা তাদের কাছে অগ্রহণীয় হবে। এমন কোনো আচরণ প্রকাশ করবে না, যা তাদের দৃষ্টিকটু মনে হবে। তুমি বাহ্যত তাদের কাছে সৃজনশীল একজন মানুষের প্রতীক হয়েই আছ। তা তোমাকে জানতে এবং মানতে হবে।
তুমি তোমার সৃষ্টির বিনিময়ে, মানুষের শুধু প্রশংসাই পাবে, তা আশা করো না। বরং প্রশংসার বিপরীতে নিন্দাবাদের জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে তোমাকে। তোমার লেখা যাদের বিপক্ষে যাবে; তারাই তোমার নিন্দা করবে। তারা তোমার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। এবং তুমি যা বলছ, যা লিখছ তার মধ্যে সামান্যতম খুঁত থাকলেও মানুষ তা গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হবে। তা তোমাকে মনে রাখতেই হবে। সাধারণ মানুষ; তোমার পাঠক, তোমার দর্শক। তাঁদের মন-মর্জির ওপর লক্ষ রেখেই তোমাকে অগ্রসর হতে হবে। তাই তুমি তোমার নীতি বিসর্জন দেবে না। তোমার বিকৃত মনের পরিচয় মানুষের সামনে তুলে ধরবে না। তোমার মনের পঙ্কিলতাকে; সাধারণ পাঠক-মানুষের নাগালে ছড়িয়ে দেবে না তুমি। তাতে তাদের মধ্যেও তার প্রভাব বিস্তৃত হবে। সাধারণ মানুষ, ওই পাঠক-সমাজের সবাই তো একই শ্রেণির নয়। কেউ কেউ সহজেই মত ও পথ পাল্টে ফেলে এবং একসময় তাদের কাছে তুমি, পরিত্যাজ্য, পরিত্যক্ত হয়েই যাবে। তাই তোমার লক্ষ্য থাকবে, সুন্দর একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বলীয়ান অবয়ব তাদের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষের মাঝে সৌন্দর্য সৃষ্টির মোহনীয় আবহ এই তোমাকেই শুরু করতে হবে।
তোমার সামগ্রিক লেখক-সত্তার চেতন, সংবহন-প্রক্রিয়ার প্রগলভতায় হবে সম্ভূত। তোমার দর্শন, সক্রিয় বিষয়-ভাবনা, আত্মসমীক্ষা হৃদয়ের জারণ-রসে জারিত হয়ে প্রাঞ্জলতার মাত্রা পাবে। সেগুলো হবে আত্মসমীক্ষামূলক। সেখানে সময়ের এবং মানুষের প্রয়োজনে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে অন্য আরেক পরিমণ্ডল। অভূত পরিবেশ এবং তোমার অধ্যবসায়ের, নিষ্ঠার ও পরিশ্রমের চিত্রও। তোমার সৃষ্ট লেখাগুলো সাহিত্যনিষ্ঠ গবেষকদেরও প্রয়োজন মেটাবে। পাশাপাশি সেগুলো কালের দলিল ও ইতিহাস আকারে সংযোজিত হয়ে থাকবে জগতের ইতিহাস-গ্রন্থের সূচিপত্রে। মানুষের জীবনের সঙ্গে তোমাকে যোগসূত্র এবং নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক রচনা করতে হবে। তোমার নিজের প্রতি পক্ষপাত নয়। মানুষের পক্ষেই তোমাকে অবস্থান নিতে হবে। তোমার দৃষ্টিভঙ্গি হবে মানব-সমাজের কোথায় কোন স্তরে রয়েছে ঘনীভূত অন্ধকার। রয়েছে জীর্ণতা। অব্যবস্থার শিথিলতা। শ্রেণিবৈষম্যের দেয়াল। সমাজে বর্তমান সমস্ত অচলায়তনের বিপক্ষে তোমাকে দাঁড়াতেই হবে। তখন নজরুলের ভাষায় তোমাকে বলতেই হবে, ‘লাথি মারো, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দিশালায় আগুন জ্বালা। ফেলো উপাড়ি!’ এবং সেখানে কীভাবে আলোর ছটা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। জীর্ণতাকে মেরামত করা যায়। ব্যবস্থার কঠিন বলয় নির্মাণ করা যায়, তার সম্ভাব্য পথ বাতলে দিতে হবে।
আবার জীবনের যা কিছু আলোকিত, মাধুর্যমণ্ডিত, কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাকে ‘এসো শ্যামল, সুন্দর!’ বলে স্বাগত জানাবে। তোমার লেখার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি চরণে, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং হৃদয়বৃত্তিক অভিযোজন প্রতিভাত হবে। মননের পরিশীলিত-শিল্প এবং তার কলামাধুরী পরিস্ফুট হয়ে উঠবে, লেখার অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে। মোহনীয় পেলবতার স্পর্শে তোমার ভাষা, শব্দশৈলী এবং ছন্দ অনুরণিত হবে। হয়েই যাবে! মোটকথা, সাহিত্যের ইতিহাসে তোমার সৃষ্টি উল্লেখিত হয়েই থাকবে। এবং ব্যাপক পটভূমিকায় বর্তমান পরিস্থিতির লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করার ভাষ্য, সময়ের পুস্তকে অনিবার্য পাণ্ডুলিপিরূপে সংরক্ষিত হয়েই থাকবে। সেখানে তুমিও স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে থাকবে।
মানুষের নিত্যকার জীবনাচরণে উপলব্ধ প্রপঞ্চ, তোমার লেখনীর আঁচড়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। মানুষের প্রবৃত্তির অংশ ভয়, ক্ষোভ, উষ্মা, প্রতিহিংসা, আনন্দ, বিহ্বলতা ইত্যাদি পরিস্থিতির বাস্তব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সেগুলোর উপস্থিতি ও বিস্তার তুমি তুলে আনবে তোমার কলমের আঁচড়ে। বোধগম্য, বোধের বিপরীতে নিম্ন কাঠামোর শ্রেণিগুচ্ছকে উপরি কাঠামোর শ্রেণিগুচ্ছ তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রভাব ও কর্তৃত্ব স্বীকারে বাধ্য করে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠর (ধর্মীয়, জাতিগত ও প্রান্তিক) ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপ প্রয়োগ এবং তাদের অনুশাসনের নিগড়ে ক্রমাগত ভয়ের যে আবহ সৃষ্টি করে, সেই বাস্তব চিত্র সুচারুরূপে নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ করে তোমার লেখায় ফুটিয়ে তুলবে।
তোমার সৃষ্ট সাহিত্য হবে শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। উৎকর্ষের, উপযোগিতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। তোমার লেখা হবে, ভাবে-বৈচিত্র্যে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণধর্মী। মানুষের মনে সৃষ্ট বেদনা, বিভাজন, বৈরিতার উন্মুলতা এবং আনন্দের-উচ্ছ্বাস তোমার কলমে বাস্তব হয়ে উঠবে। তোমার মনের পটে প্রতিবিম্বিত, বাস্তব চিত্র অঙ্কন করাই হবে তোমার লক্ষ্য এবং অর্জন। তোমাকে হতে হবে একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রগতিশীল লেখক। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তুমি হয়ে উঠবে একজন পরিশীলিত কথাশিল্পী! তো একজন দায়বদ্ধ লেখক হওয়ার জন্য তোমাকে বিশ্ব সাহিত্য পাঠ করার পাশাপাশি তোমার পাঠকদের মনের ভাষাও পাঠ করা প্রয়োজন। তাদের চাহিদার ব্যাকরণ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান তোমাকে রাখতেই হবে। প্রথমত, সমাজের এবং মানুষের প্রতি তোমার দায় সম্পর্কে সচেতন হতেই হবে। তোমার নিজের সঙ্গে নিজেরই বোঝাপড়া করতে হবে। শিল্প-সাহিত্যের উপযোগিতা নিয়ে ভাবতে হবে। সঙ্গে তোমার সামগ্রিক লেখক-সত্তার চেতন-সংবহন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই নিজেকে জারিত করতে হবে। একজন লেখক তার চিন্তা-চেতনায় ত্রি (তিন) বিষয়ের এবং সত্তার সঙ্গে নিজের মননকে সংযুক্ত রাখেন। তিনি তার জীবৎকালে, সময়ের তিন কালকে একই সমান্তরালে দেখতে প্রবৃত্ত হন। এগুলো হলো অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। তিনি ভাবেন, স্রষ্টা, মানুষ এবং সমস্ত সৃষ্টিকুল নিয়ে। আমি (আমরা), তুমি (তোমরা) এবং সে (তারা)Ñএই তিন ব্যক্তিসত্তা নিয়েই হয় তার লেখার বিচরণক্ষেত্র।
আবার বলা যায়, ব্যক্তি, কাল এবং পুরো সৃষ্টিজগৎ নিয়েই তিনি তার লেখনী সচল রাখেন। আমরা মানুষ, আমাদের ধর্মীয় মতে, ত্রিজগৎ বিশ্বাস করি। লেখক তিনিও; মর্ত্য, স্বর্গ এবং নরক নিয়ে ভাবেন এবং তিনি লেখক সমস্ত কিছুই দেখেন, তার তৃতীয় নয়নের দৃষ্টিতে।
বলছি, তুমিও তা-ই অনুশীলন করবে। তুমি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হয়েই তোমার লেখার জগতে বিচরণ করবে এবং তোমার সার্বভৌম সত্তাকে লালন করবে তুমি। তোমার সমাজকে, সমাজের মানুষকে একরকম শর্তহীন চুক্তিতে বিনা মূল্যেই অনেক কিছু দিতে হবে। তার বিনিময়ে একজন লেখকের প্রাপ্তি, অর্থমূল্য বা বৈষয়িক কিছু বিচার্য বিষয় হতে পারে না। পাঠকের গ্রহণযোগ্যতাই লেখকের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। লেখক হিসেবে তোমার যা কিছু বলার স্বাধীনভাবেই তা লিখবে। তোমার পাঠক, সচেতন হয়েই তা পাঠ করবে। তারাও তোমার মতো চিন্তা করতে প্রণোদিত হবে। তাদের আচরণে তুমি তা প্রত্যক্ষ করবে। এটাই তোমার জন্য বড় পাওনা!
মানুষের সঙ্গে তোমাকে সংযুক্ত হতে হবে। তুমি নিজের কথা লিখবে না। তাতে তুমি মানুষের সংলগ্নতাকে স্পর্শ করতে পারবে না। তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তুমি লিখবে মানুষের আনন্দের, দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জাত, তোমার লেখায় থাকবে, ‘বিন্দুতে সিন্ধুর গভীরতা’ এবং ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ নিগূঢ় শৈলী! তোমার পাঠক বারবার তোমার লেখায় তোমাকেই আবিষ্কার করতে চাইবে। তোমার মধ্যে থাকবে তোমার শিল্পকে প্রশ্নহীন প্রত্যয়ে নির্বিকল্প উচ্চতায় তুলে ধরার নিরবচ্ছিন্ন প্রবণতা। এবং নৈর্ব্যক্তিক মনন, আবেগ ও চরিত্র দর্শনের সম্মিলনে প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ও কর্মের গতিশীলতা। তুমি হবে একটি প্রশান্তির জগৎ নির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টা! হবে বিনম্র শ্রদ্ধা, প্রেরণা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস উদ্রেকের স্রষ্টা। হবে তুমি ভরসা-পুরুষ! সহজাত প্রতিভার জাদুকরি মুগ্ধতা দৃষ্ট হবে তোমার মাঝে!
তোমার লেখনীতে ধরা পড়বে আধুনিক বিজ্ঞান-বাণিজ্য-ধর্মনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত সমাজ-সভ্যতার চিত্র। তার সঙ্গে চিত্রিত হবে পূর্ববর্তী পৃথিবীর আদিম প্রকৃতির মানুষ যাপনের রূপ, রীতি, সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য। লেখার ক্যানভাসে নিশ্চিত ফুটে উঠবে অকৃত্রিম আনন্দের পরিবেশ, অসীমের হিল্লোল, অপরিমেয় শক্তির রং-বেরঙের ঊর্মিমালা। আর সকল সংস্কারের বাইরে, সহজাত উত্তরাধিকারের স্নায়ুবাহিত আনন্দ, সংবেদনা, উদারতা, যৌথ জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত মহিমা, দায়বদ্ধতা প্রকাশিত হবে।
তোমার লেখা হবে শিল্পগুণে গুণান্বিত। তা হবে না কোন আপসের বৃত্তে বন্দী। ভাষার এবং শব্দের পরিশীলিত কলেবরে এবং নান্দনিকতার ব্যাপ্তিতে স্বাধীন হয়েই তুমি নিজে বিচরণ করবে। তাতে সাধারণ মানুষ তোমাকে তাদের পার্শ্বচরিত্রের একজন সতীর্থ মনে করেই তোমার পাশে এসে অবস্থান নেবে।
তোমার লেখায়, মানুষের জীবন ও তার সংজ্ঞা সম্পর্কে, একজন লেখকের পরিবর্ধমান ধারণার অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। জীবনের ব্যঞ্জনার সমস্যা, শাস্ত্র, লোকাচার, নির্বিচারে আনুগত্য এবং শৃঙ্খলিত জীবনের মধ্যে নতুনত্বের ঢেউ জাগানোই হবে তোমার লক্ষ্য। দ্রোহ নিয়েই লিখতে হবে তোমাকে। এই দ্রোহ, সংস্কার ভাঙার অন্দোলনে সক্রিয় তোমার নিজের শিল্পী-সত্তা। এই সত্তাকে সৃষ্টিকর্মের সমস্ত আপাত অসংগতি এবং উৎকেন্দ্রিক বিক্ষেপ, যা গভীর সামঞ্জস্যে গ্রন্থিত করে দেবে। তোমার উদ্ভাবনী প্রতিভা এবং এই অভিযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার দুঃসাহসিকতাকে নিশ্চয় তোমার পাঠককুল সজ্ঞানেই স্বীকৃতি দেবে।
সাহিত্যের এবং শিল্পের বিভিন্ন আঙ্গিকে ও প্রকরণে নিজেকে খুলে তুলে ধরবে তুমি। তোমার পাঠক-সমাজ তোমার মাঝে দেখবে সুপ্ত শিল্পবোধ, নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনা। মানুষের মানবিক সান্নিধ্যে এবং প্রকৃতির ওম-সাহচর্যে বেড়ে উঠবে তুমি। কারণ লেখক তুমি আত্মসন্ধানী উপাচারের আশ্রয়ে লালিত হয়ে এসেছ।
সদা সর্বদাই তোমার বিবেক তোমাকে তাড়া করেই যাবে। তার দহন অনুভব করবে; তুমি তোমার সত্তায়। যা কিছু চলমান এবং ঘটমান, তুমি দেখবে চোখের সামনে, তাতে তুমি একধরনের তাড়া অনুভব করবে। তুমি বুঝতে পারবে, কেউ অনবরত তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কে যেন তোমার পিছু নিয়েছে। সারাক্ষণই অনুসরণ করছে তোমাকে। অদৃশ্য কোনো ছায়া তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। তুমি সুস্থির হয়ে শুয়ে থাকতে, বসে থাকতেও পারবে না। এমনকি অন্য কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকলেও তোমার পাশের ছায়া বলবে, ‘কলম ধরো! লিখো! এই কথাটি, এই শব্দটি এখনই লিখে রাখো। তা না করলে এক মুহূর্ত পরই তুমি তা ভুলে যাবে। তোমার ভেতরের এই কথামালা বা শব্দমালা হারিয়ে যাবে। ফের তুমি তা শত চেষ্টা করেও গুছিয়ে আনতে পারবে না। তুমি লিখো।’
আমিও বলছি, তুমি লিখো। তোমার এই ছোট্ট কথাটি বা শব্দটি হতে পারে বড় কিছুর শুরু। শক্ত ভিত্তি। তাকে সম্বল করেই তুমি লিখো। যা তোমাকে নিয়ে যাবে অনন্য এক উচ্চতায়। তোমার সেই লেখা পাঠ করে, তোমার পাঠক-সমাজ আন্দোলিত হবে। তোমাকে মনে রাখতে হবে, তোমার কোনো লেখাকেই চূড়ান্ত বিচারে মানসম্মত ভাবার সুযোগ নেই। তুমি অহংকারকে প্রশ্রয় দিয়ো না। তোমার অহংবোধ তোমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করেই দেবে। তোমাকে থামিয়ে দেবে। তুমি তখন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় ব্যাকুলতা অনুভব করবে না। অতীত তোমাকে পেছন থেকে টেনে ধরবে। [চলবে...দ্বিতীয় পর্ব]
 

কমেন্ট বক্স