আমি বারবার ‘সফট্ পাওয়ার’ এর গুরুত্বের কথা বলে আসছি। বলে আসছি সকল ঝামেলার উৎস হলো ‘সফট্ পাওয়ার’। বলতে গেলে বিপথগামী বা উদ্দেশ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, সেই ‘সফট্ পাওয়ার’। এই যে বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিজন, গণমাধ্যমকর্মী এরা হলেন ‘সফট্ পাওয়ার’ এর অংশ এবং তাদের অনেকেই বিপথগামী। এদের কাজ শক্তি প্রদর্শন নয়, সংঘাত নয়, বিক্ষোভ-সমাবেশ নয়; তবে এসবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়া। কিছুদিন আগে শিল্পকলায় নাটক প্রদর্শন বিষয় নিয়ে তুলকালাম হলো। নাটক বন্ধ করলেন শিল্পকলার ডিজি। অথচ নাটক বন্ধের কোনো দাবি ছিল না প্রতিবাদকারীদের। সেই নাটকের এক কুশীলব জুলাই বিপ্লবের বিপক্ষে ছিলেন এবং ফ্যাসিজমের পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন, তাকে নাটক থেকে বাদ দেওয়ার দাবি ছিল প্রতিবাদকারীদের। কিন্তু ওই যে ‘সফট্ পাওয়ার’, সংস্কৃতিজনেরা এটাকে তুলে ধরলেন নাটক করতে বাধা দেওয়ার চিত্র হিসেবে। আড়ালে পড়ে গেল সেই ইতর শ্রেণির কুশীলব, যাকে অভিনেতা বা সংস্কৃতিজন বলা হয়, যিনি জুলাইয়ের নির্মমতা উপভোগ করেছেন, তার বিকৃত উপভোগের কর্মনামা। উল্টো বাটে পড়লেন যারা সেই নির্মমতার প্রতিবাদ করতে গেলেন। এখানেই ‘সফট্ পাওয়ার’ এর ক্যারিশমাটা। একটা প্রকৃত ঘটনাকে উল্টে দিতে লাগে এই ‘সফট্ পাওয়ার’। আর সেই উল্টে দেওয়া ঘটনাকে সামনে রেখে মাঠে নামে ‘হার্ড পাওয়ার’ এর দৃশ্যমান কর্মীরা। সামান্য একটি শব্দকে উপলক্ষ করেও তারা তুলকালাম করতে পারে। হালে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে ঘিরে ‘সফ্ট পাওয়ার’ এর আমলনামা দেখলেই তা টের পাবেন। বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের এখন লড়তে হচ্ছে সেই ‘সফ্ট পাওয়ার’ এর বিরুদ্ধে। অথচ এই ‘সফ্ট পাওয়ার’কে চিহ্নিত করা প্রথম দিকে সম্ভব হয়নি। এদের শুরুতে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। এরা যখন-তখন খোলস পাল্টাতে পারে। গিরগিটি বলতে পারেন। জুলাই বিপ্লবেও এরা বিপ্লবের পক্ষে ছিল কিংবা থাকার ভান করেছে। যখন নিজেদের স্বার্থে টান পড়েছে, তখনই তারা তাদের আসল রূপ দেখাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক প্রমাণ দিই। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র-বিষয়ক সর্বদলীয় সভায় যায়নি সিপিবি। বিএনপিও প্রায় না যাওয়ার ফাঁদে পড়েছিল। কিন্তু শেষটায় বুঝতে পেরে কোনো রকমে এবারের মতন পার পেয়েছে। অনেকে কথায় কথায় বলেন সিপিবির জুলাই বিপ্লবে ভূমিকার কথা। হ্যাঁ, ছাত্র ইউনিয়নের কথা বলতে পারি, তারা জুলাই বিপ্লবে সাহসী ভূমিকা রেখেছে। প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়, ছাত্র ইউনিয়নের কারা সে ভূমিকা রেখেছিল। ইউনিয়ন এমনিতেই বিভক্ত। একটা অংশ আগে থেকেই সিপিবির কর্মকাণ্ডে ত্যক্ত-বিরক্ত ছিল। সে কেচ্ছাকাহিনি সবাই জানে। সিপিবি শেষ পর্যন্ত জুলাই বিপ্লবের পক্ষে ছিল এবং সম্ভবত তাদের থাকতে বলা হয়েছিল। এসপিওনাজ এর ক্ষেত্রে ‘স্লিপার সেল’ বলে একটি কথা রয়েছে, যা যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে কাজে লাগে। বিপ্লবের পরও বিপ্লব বেহাত হয়ে যায় এবং সেই বেহাত হওয়ার কাজটা করে সেই রাজনৈতিক ‘স্লিপার সেল’। তারা বিপ্লবীদের বিভক্ত করে নানান ব্যাখ্যা এবং সংজ্ঞায়। এতে অনেকেই বিভ্রান্ত হন, তাদের পক্ষে সত্যটা বোঝা দুরূহ হয়ে পড়ে। সিপিবি বা বামঘেঁষা রাজনীতিতে ‘সফ্ট পাওয়ার’ এর গুরুত্ব অসীম। তারা জানে, তাদের জনসম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু তার পরও তাদের প্রাসঙ্গিক করে রাখা সম্ভব শুধু ‘সফট্ পাওয়ার’ এর মাধ্যমে। পাঠ্যবইয়ে একবার ‘ওড়না’ শব্দ নিয়ে মহাঝামেলা হলো। ‘ওড়না’ শব্দটি ইসলামিক বলে জানান দিল সেই বিপথগামী ‘সফট্ পাওয়ার’। সঙ্গে সঙ্গে কোরাস ধরল ‘হার্ড পাওয়ার’। শুরু হলো সারা দেশে সাম্প্রদায়িক বাহাস। অথচ ‘ওড়না’ শব্দটির উৎপত্তি কিংবা ‘ওড়না’র আদি নিবাস নিয়ে কথা বললেন না কেউ। সব সেই ‘সফট্ পাওয়ার’ এর চাপাবাজি এবং ‘হার্ড পাওয়ার’ এর উল্লম্ফনে চাপা পড়ে রইল। অর্থাৎ ‘সফট্ পাওয়ার’ চাইলেই ব্যাকস্টেজ থেকে স্টেজটা তৈরি করে দিতে পারে। তারপর সেই স্টেজে চলে মামদোবাজি। একজন বক্তা, সে হোন রাজনীতিক কিংবা ধর্মীয় কোনো ব্যক্তিত্ব, তার বক্তব্যে হঠাৎ করেই শব্দচয়নে কোনো ভুল হলো কিংবা না জেনেই কোনো একটি বেফাঁস বলে ফেললেন। আর যায় কোথা, সেই ‘সফট্ পাওয়ার’ সেটাকে ধরে নিয়ে মাঠে ছেড়ে দিল, সেই কথাকে সামনে রেখে মাঠে নেমে পড়ল ‘হার্ড পাওয়ার’। তারপর আর কী, যা হবার তা-ই হলো, সেই বক্তার বারোটা বেজে সারা। সঙ্গে শুরু সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক ক্যাচাল।
এখন চলছে ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে ‘সফ্ট পাওয়ার’ এর খেল। পুরো মাদারির খেলা। ‘ভূমিপুত্র’ আর ‘আদিবাসী’ শব্দ দুটির মধ্যে ভয়াবহ রকম ফারাক রয়েছে। ‘আদিবাসী’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘মূল বাসিন্দা’। অনেকে বলেন, ল্যাটিন ‘Aboriginal’ শব্দ থেকে এসেছে ‘আদিবাসী’ শব্দটি। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলে অন্য কথা। তাদের ভাষায় ‘আদিবাসী’ শব্দটির ক্ষেত্রে ‘অ্যাবোরিজিন’ ব্যবহার করা সঠিক নয়। অ্যামনেস্টির ভাষাতেই বলি, ‘In international law, Indigenous acknowledges that a personÕs lived on particular lands, before new people arrived an became dominant.’ অর্থাৎ দাঁড়াল আদিবাসী তারাই, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে অন্যরা আসার পূর্ব পর্যন্ত বাস করে আসছিল। কিন্তু আমাদের যে ‘আদিবাসী’র দাবি, তা কতটা অ্যামনেস্টির সংজ্ঞার সঙ্গে যায়। আমাদের পাহাড়ে যারা মঙ্গোলিয়ান জনগোষ্ঠীর মানুষ থাকেন, তারা কি পাহাড়ের ভূখণ্ডে অন্যরা আসার পূর্ব থেকেই বাস করে আসছিল? না। ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাস বলে, প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সিলেট এমনকি ময়মনসিংহ অঞ্চলেও। এই হাতিয়ার ব্যবহারকারীদের বলা যায় ‘আদিবাসী’। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে এসব এলাকায় মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল বলে প্রাগৈতিহাসিক কালের হাতিয়ার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু আমাদের ‘সফট্ পাওয়ার’ যাদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে, তারা মূলত মঙ্গোলিয়ান। এখন যদি এ দেশে মঙ্গোলিয়ানদের প্রবেশের সময়কাল চিহ্নিত করা যায়, তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। তার আগে আসি ১৮৬৯ সালে ইংরেজ প্রশাসক লুইনের কথায়। তিনি জানিয়ে গেছেন তখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমাদের সঙ্গে বাঙাল গ্রামের অবস্থানের কথা। অর্থাৎ সেই সময় থেকেই বাঙালরা পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে। আরও আগের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এসব অঞ্চলের ‘আদিবাসী’ মূলত বাঙালরাই। প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ারও সে সাক্ষ্যই দেয়। মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো প্রমাণই ‘সফট্ পাওয়ার’ দাবিকৃত ‘আদিবাসী’ সংজ্ঞার সঙ্গে যায় না। কারণ পাহাড়ে কেউ কাউকে হটিয়ে দখল করেনি। সেখানে আগে থেকেই বাঙালরা ছিল। উত্তর আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট অথবা ময়মনসিংহের মঙ্গোলিয়ানদের মিলিয়ে ফেললে হবে না। কারণ উত্তর আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের হটিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা দখল নিয়েছিল। রেড ইন্ডিয়ানরা সেখানে আদিবাসী। ইতিহাস তা পরিষ্কারভাবে জানান দেয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও তা-ই। সুতরাং ‘Indigenous’ অর্থাৎ আদিবাসী তারাই, যাদের হটিয়ে অন্যরা দখলদারিত্ব কায়েম করেছে। আমাদের ‘ভূমিপুত্র’দের হটিয়ে কেউ জায়গা দখল করেনি এবং তাদের ‘Dominant’ও করেনি। সুতরাং ‘আদিবাসী’ শব্দটি পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তর্কের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য। আর এটাই ‘সফ্ট পাওয়ার’ এর কাজ। তারা ‘স্লিপার সেল’ হিসেবে কিছু একটা রেখে দেয়, যখন প্রয়োজন হয় তখন সেই ‘স্লিপার সেল’কে জাগ্রত করে। ‘আদিবাসী’ বিষয়ক উল্লম্ফন সেই ‘স্লিপার সেল’ এর ক্যারিশমা।
জুলাই বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। লুকিয়ে থাকা ‘স্লিপার সেল’ এখন কাজ শুরু করেছে বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং বিপ্লবীদের বিভক্ত করার মিশনে। খেয়াল করলে দেখবেন, একটা কথাও তারা মাটিতে ফেলতে দিচ্ছে না। সামান্য একটা কথা নিয়েও তারা তুলকালাম করছে। যে কারণে বিপ্লবীরা তাদের লক্ষ্য স্থির রাখতে হিমশিম খাচ্ছে আর সরকারও তাদের কাজ ঠিকঠাক এগিয়ে নিতে পারছে না। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা হচ্ছে। প্রথমত, বিপ্লব ও সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। দ্বিতীয়ত, পতিত ফ্যাসিজমের কর্মকাণ্ডকে আড়াল করা। এতে কার কী লাভ, তা বলতে গেলে দুই কথাতেই শেষ করা যায়। বিপ্লব ও সরকার ব্যর্থ হলে সেই ‘সফট্ পাওয়ার’ বলা শুরু করবে ‘আগেই তো ভালো ছিল’। ‘ইতর’ শ্রেণির দু-একজন এখনই তা বলতে শুরু করেছে। দ্বিতীয়তে যাওয়ার আগে ‘ইতর’ শব্দটির ব্যবহারিক কারণ বর্ণনা করি। ‘ইতর’ শব্দটির অর্থ হলো নিম্নশ্রেণিভুক্ত প্রাণী। অর্থাৎ যার মানবিক বোধ নেই। মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে এই মানবিক বোধ। যাত্রাবাড়ীতে পাখির মতন গুলি করে মানুষ হত্যার দৃশ্য যাদের বোধ জাগায় না। ইয়ামিনের শরীর এপিসি থেকে ছুড়ে ফেলতে দেখে যাদের বোধ কাজ করে না। পেটে রাইফেল ঠেকিয়ে তরুণ হৃদয়কে গুলি করার দৃশ্যে যাদের বোধ নাড়ায় না। তারা তো নিম্নশ্রেণির প্রাণীই, নাকি?
এখন আসি পতিত ফ্যাসিজমের কর্মকাণ্ডকে আড়াল করার ব্যাপারে। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্যাসিস্টদের প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুণ্ডু কাটা হয়েছিল গিলোটিনে। অর্থাৎ বিপ্লবের পর তাৎক্ষণিক তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব থেকে জুলাই বিপ্লব, সময়ের পানি অনেক গড়িয়েছে। প্রকাশ্যে ঝোলানো ও মুণ্ডু কাটাকে এখন মব বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ আমরা সভ্য হয়েছি, সময়ের সঙ্গে বিপ্লবের ধরন এবং বিপ্লব প্রতিক্রিয়ার ধরনও বদলানো স্বাভাবিক। কিন্তু অপরাধীদের বিচারের দাবি না করা এবং অপরাধীদের কর্মকাণ্ডকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা বিপ্লব-বিরুদ্ধ এবং অন্যায়। সংগত তা অপরাধও। যে ‘সফ্ট পাওয়ার’ এসব করছে, তাদের কর্মকাণ্ডও অপরাধ এবং তারাও অপরাধী। সুতরাং, অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় দেওয়াও অপরাধ। যারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের বিস্মৃত হলে চলবে না, প্রকৃতির বিচার বলে একটি কথা আছে। কোনো অপরাধই বিনা দণ্ডে যায় না। যারা মনে করেছিলেন, জগদ্দলের মতন চেপে থাকা ফ্যাসিজম সরবে না, তাদের কিন্তু পালাতে হয়েছে। প্রকৃতি বা ঈশ্বর যা-ই বলুন না কেন, সে ছাড় দেবে, ছেড়ে দেবে না।