১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছে। নিউইয়র্কসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে যেখানে বাঙালি আছেন, সেখানেই তারা বিজয় দিবস উদযাপন করেছেন। বিভিন্ন আলোচনা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য সর্বত্রই বিজয় দিবস উদযাপিত হয় সরকারি ও বেসরকারি আয়োজনে। বিজয় দিবসে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি এবং অত্যন্ত আন্তরিক ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের অতুলনীয় ইতিহাস স্মরণ করেন বাঙালিরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে। আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী পরাজিত হয়। তাদের বীরত্ব বাঙালিদের এনে দেয় স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ছিল বহু আকাক্সিক্ষত। পাকিস্তানের ২৪টি বছর ছিল বাঙালিদের জন্য চরম দুর্ভোগ ও বঞ্চনার কাল।
পাকিস্তানের জিঞ্জির থেকে মুক্তিলাভের জন্য রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন বাঙালিরা। তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন কখনো শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, কখনো মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ। একসময় বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। সেই যুদ্ধে সামরিক নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ আরও অনেকে। শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে জয়ের প্রত্যাশা নিয়ে যোগ দেন লাখ লাখ বাঙালি কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-জনতা।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাঙালিরা জয়ী হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশ লাভ করে বটে, তবে মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর লালসার কাছে দুই লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারান। দেশের ভেতরে যারা ছিলেন, তারা নানাভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীন বাংলায় লক্ষ কোটি মানুষ নির্যাতনের শিকার হলেও মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে ওঠেন বাঙালিদের চোখের মণি, আপন সন্তানের চেয়েও অধিক স্নেহধন্য এবং ভালোবাসায় সিক্ত।
কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্য। শুরু হয়ে গেল ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ হওয়ার প্রতিযোগিতা। সমাজে যারা ‘শিক্ষিত ভদ্রলোক’ বলে পরিচিত, তারা দলে দলে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র সার্টিফিকেট জোগাড় করতে লাগল বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। ছলে-বলে কলে-কৌশলে ‘ভুয়া’রা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় বানিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার জন্য সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। বিগত সরকারগুলো বারবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করে। কিন্তু কীভাবে যেন বারবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েই যেতে থাকে।
অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ শনাক্ত করে তাদের সনদ বাতিল করতে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংবাদটি প্রকাশ পেয়েছে ১৮ ডিসেম্বের সংখ্যা ঠিকানার শেষ পৃষ্ঠায়। সংবাদটির শিরোনাম : দুশ্চিন্তায় নিউইয়র্কের ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা’। ঘাড়ের ওপরে আছে, ‘দোষ স্বীকার করলে ক্ষমা, অন্যথায় জেল-জরিমানা’। এই খবরে ঘুম হারাম হয়ে গেছে নিউইয়র্কে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’দের। তারা দুশ্চিন্তায় ম্রিয়মাণ। তদবিরসহ নানা উপায়ে তালিকায় যেভাবে নাম উঠিয়েছিলেন, একইভাবে জোর তদবির শুরু করে দিয়েছেন নিজেদের নাম টিকিয়ে রাখতে।
কিন্তু বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা যায়, ভুয়া যারা তাদের নাম টিকিয়ে রাখা দূরে থাক, ধরা পড়ে শাস্তির ভয়ে আছেন মহা আতঙ্কে। কেননা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘ভুয়া’দের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ‘ভুয়া’দের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। যারা স্বেচ্ছায় দোষ মেনে নেবে, তাদের বেলায় ছাড় দেওয়া হলেও অন্যরা দোষ স্বীকার না করে পার পাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের কপালে জেল-জরিমানা দুই-ই জোটার সমূহ আশঙ্কা।
শাস্তির কথা থাক-যারা এই ভুয়া সনদ নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চিত করেছেন, তারা কি নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রশ্ন করেননি যে তারা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কতটা অসম্মান করেছেন এবং নিজেদের নৈতিকভাবে কোথায় টেনে নামিয়েছেন? তারা কি সামান্য নীতি-নৈতিকতা নিয়েও জন্মগ্রহণ করেননি। বিবেক কি তাদের কোনো প্রশ্নই করেনি? এ রকম অনৈতিক কাজ তারা করতে পারেন কীভাবে? বাঙালির সর্বোচ্চ বিনিময়ে পাওয়া যে বিজয়, যে স্বাধীনতা, তার সঙ্গে এই ‘ভুয়া’রা কতটা বেইমানি করেছেন, তারা একবারের জন্য হলেও কি ভেবে দেখেছেন? তাদের নীতি-নৈতিকতাহীন এই কাজ জাতি হিসেবেও যে আমাদের জন্য কত গভীর লজ্জার বিষয়, এটা বুঝতে পারলে এ কাজ করতে পারতেন কি না কে জানে। বাঙালি জাতি হিসেবে এ কাজের জন্য ‘ভুয়া’দের কেবল ধিক্কারই জানানো যায়। ছি, ধিক্কার, শত ধিক্কার।