বাংলাদেশের অনেক সংকট। নিজেদের মধ্যকার হাজারো সংকট। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ে নাভিশ্বাস। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। ঘুষ-দুর্নীতি-রাহাজানি-হাজারো রকমের সামাজিক সংকট। অর্থনীতির দুরবস্থা। সেই সঙ্গে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো বহির্দেশের চাপিয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা সংকট। সেই যে ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সেই ধারা আজও বহমান এবং মানবিক বোধ থেকে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হলেও আজ সেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন নানামুখী সমস্যা তৈরি করছে। আইনশৃঙ্খলার যেমন অবনতি ঘটাচ্ছে, তেমনি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যুবসমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে দুই পক্ষের গান শুটিং চারদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তারা যেন ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সৃষ্ট অরাজকতা কেবল তাদের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাম্পগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, সারা দেশেই তার প্রভাব পড়ছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই হতাশাজনক খবর প্রচারিত হচ্ছে। তেমনই একটি সংবাদ ‘রাখাইন ঘিরে সংকট বাড়ছে বাংলাদেশে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন বিদ্রোহ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন সে দেশের বিশাল এলাকা এখন তাদেরই দখলে। এদিকে ওই রাজ্য থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে এখনো অবস্থান জানায়নি আরাকান আর্মি। অন্যদিকে শরণার্থী সমস্যা শুরু হওয়ার পর গত প্রায় ৮ বছর ধরে নানা বাহানায় মিয়ানমার রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন ইস্যুতে নতুন সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’ আসলে রাখাইনের রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন সংকটের অবকাশ ঘটাবে না। বরং নিত্যনতুন সংকট সৃষ্টি করে যাবে। রোহিঙ্গারা যত বেশি দিন বাংলাদেশে অবস্থান করবে, বাংলাদেশের সংকট তত বাড়তেই থাকবে। এই সংকট নিরসনে দুটি বিকল্প যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশের ঘাড় থেকে রোহিঙ্গা সংকট নামলেও নামতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আরাকান আর্মির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। আরাকান আর্মি হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে যারা রাখাইন রাজ্যকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এই আরাকান আর্মি ‘কাচিন ইন্ডিপেন্ডেট আর্মি’র (কেআইএ) সহায়তায় ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সামরিক শাখা হিসেবে ২০০৯ সালে গঠিত হয়। তারা যদি সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীন একটি আরাকান রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। দ্বিতীয় বিকল্প হবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে নয়, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যদি তার সদস্যরাষ্ট্রের সাহায্যে বহুপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়।
এ কথা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে, দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান আসবে না। বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা বা প্রতিবেশী দেশগুলোর পক্ষে এমন কোনো শক্ত সম্পর্ক লক্ষ করা যায় না, যার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হবে। কূটনৈতিক দুর্বলতা বা অক্ষমতার কারণে আমাদের শুধু বলে যেতে শুনতে পারা যায়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক দর্শন হলো : ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ এই নীতির ফলেই হয়তো বাংলাদেশকে কেবল দিয়েই যেতে হয়, প্রাপ্তি সম্ভাবনার কথা না ভেবেই। ২০১৭ সাল থেকে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু হলেও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি কেবল আহ্বানই জানিয়ে আসতে দেখছি কোনো ফল পাওয়া যায়নি, পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায় না।
শেষ কথা, যেভাবে রোহিঙ্গা সংকট থেকে বাংলাদেশের সমস্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে এ রোহিঙ্গা সংকট মিলে বাংলাদেশর অস্তিত্ব সংকটই দেখা দেবে। এখন থেকেই তাই সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলতে হবে।