আমেরিকা এক মহান দেশ। গণতান্ত্রিক দেশ। শৌর্যে-বীর্যে, সমরশক্তিতে অদ্বিতীয়। দেশের ভেতরে ও বাইরে নজরদারি এবং জাতীয় স্বার্থরক্ষায় তুলনাহীন। সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকা অভিবাসীর দেশ। অভিবাসীদের স্বপ্নপূরণে যেমন আমেরিকা তার বুক পেতে দেয়, অভিবাসীরাও তাদের শ্রম, রক্ত, জীবন দিয়ে আমেরিকাকে তিলোত্তমা করে গড়ে তুলছে। আমেরিকার অর্থনীতি, শান-শওকত, বিশ্বদরবারে তার মান-মর্যাদা, তার অভিভাবকত্ব অর্জনÑসবকিছুর পেছনে কালো-বাদামি-পীত রঙের মানুষদের আছে অতুলনীয় অবদান। আমেরিকাজুড়ে এই যে বিস্ময়জাগানো বিশাল বিশাল ব্রিজ, পাহাড়ের বুক চিরে সুপ্রশস্ত রাস্তা, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, এই যে মাটির বুক চিরে মাইলের পর মাইল সাবওয়ে-সবকিছুতেই লেগে আছে অভিবাসী নানা রঙের মানুষের রক্ত। অভিবাসী ও গণতন্ত্রের সেই মহান আমেরিকা তার মহত্ত্ব, তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হারাতে বসেছে। অভিবাসীর দেশে অভিবাসীরা অবাঞ্ছিত। আমেরিকায় এখন না গণতন্ত্র কাম্য, না অভিবাসীরা কাক্সিক্ষত। আমেরিকার মূল্যবোধ আজ নির্বাসিত। জর্জ ওয়াশিংটন, রুজভেল্ট, আব্রাহাম লিংকনদের বিজয়ের বিরুদ্ধে পরাজয়ের পতাকা আজ মøান, নতমুখী। প্রকৃত একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ হতে গেলে জনবান্ধব একটি সরকার খুব জরুরি। এখনকার সময়ে এটা খুব বেশি অনুভূত হলেও তা দূরাশা।
ঠিকানার ৯ এপ্রিল একই সংখ্যায় উপর-নিচে দুটি খবর আমেরিকায় অভিবাসীদের দুর্ভাগ্য, দুর্ভোগ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম পাতার মাস্টার হেডের ঠিক ডানে উপরের খবরটির শিরোনাম : ‘যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের রায়Ñযুদ্ধকালীন আইন ব্যবহার করে অভিবাসীদের দ্রুত তাড়াতে পারবেন ট্রাম্প’ এবং নিচের খবরটির শিরোনাম : ‘নির্ধারিত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র না ছাড়লে জরিমানা-সম্পত্তি জব্দ’। খবরের অভ্যন্তরে যাওয়ার পূর্বে অভিবাসী সম্পর্কে দুটো কথা বলে নেওয়া দরকার এ কারণে যে, সব অভিবাসীকেই অভিবাসী বলে জায়গা দেওয়ার কথা নিশ্চয় কোনো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলবে না। অভিবাসী হয়েও যারা নিজেদের অপরাধকর্ম থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না, মাদক সেবন করে, রাস্তাঘাটে গুন্ডামি-পান্ডামি করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে, যারা আইন ভঙ্গ করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, তাদেরকে অবশ্যই অভিবাসী দেশ বলে আমেরিকায় জায়গা দেওয়ার কথা কেউ বলবে না। বললেও অন্যায় আবদার বলে তা অগ্রাহ্য করলে আমেরিকাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
কিন্তু বর্তমান সময়ে অপরাধী অভিবাসী মুক্ত করতে গিয়ে আমেরিকার অভিবাসী দর্শনের মূল চেতনাতেই আঘাত হানা হচ্ছে বলে নানাজনের কথা থেকে জানা যাচ্ছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, অবৈধ অভিবাসীর সঙ্গে অনেক গ্রিনকার্ডধারী কিংবা ইমিগ্রেশনে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে গ্রিনকার্ডের জন্য অপেক্ষা করছে, এমন অনেকেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং দেশে গিয়ে আসার পথে বিভিন্ন বিমানবন্দরেও তাদের ঢুকতে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে।
ঠিকানায় প্রকাশিত প্রথম খবরটিতে বলা হচ্ছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি শতাব্দীপ্রাচীন যুদ্ধকালীন আইন ব্যবহারের মাধ্যমে তথাকথিত গ্যাং সদস্যদের দ্রুত বিতাড়নের অনুমতি দিয়েছে। তবে এর প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতা এখনো বজায় রয়েছে। বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল ১৭৯৮ সালের অ্যালিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট নামক আইনের আওতায়। এ আইন যুদ্ধের সময় ‘শত্রু’ দেশগুলোর নাগরিকদের আটক বা বিতাড়নের ক্ষমতা দেয় প্রেসিডেন্টকে।’ দ্বিতীয় শিরোনামের খবরটিতে বলা হয়, ‘প্রত্যাবাসনের আদেশ জারি হওয়ার পর কোনো অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে যেতে ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত প্রতিদিনের জন্য তাকে গুনতে হবে প্রায় এক হাজার ডলার জরিমানা। জরিমানার অর্থ পরিশোধ করা না হলে অভিবাসীদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করবে দেশটির কর্তৃপক্ষ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এমন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।’ এখানে উল্লেখ করা যায়, ১৯৯৬ সালের একটি আইনে এমনতর অভিবাসীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ধারা ছিল। শতাব্দীপ্রাচীন আইন আজ অত্যাধুনিক শতকের অভিবাসীদের ওপর প্রয়োগ কতটা নিয়মনিষ্ঠ হতে পারে, তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। আসলে এ সময়ে এমন একটি পন্থা খুঁজে নেওয়া দরকার, যাতে কঠোরতা প্রদর্শন করা না হয়। আবার দেশের মূল চেতনা এবং স্বার্থও রক্ষা পায়।