পত্রিকায় প্রকাশ, ধনী দেশের ‘কৃপণতায় বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ক্ষুধা’। খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ঠিকানার ১ জানুয়ারি ২০২৫ এর প্রথম পৃষ্ঠায়। মানবিক অর্থে ধনীদের হওয়ার কথা গরিবের মিত্র। ঘটনা উল্টো। উল্টো হওয়াটাই বাস্তবতা। কেননা গরিব চুষেই ধনীরা ধনী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় তিনি মানুষের, বিশেষভাবে বাঙালিদের এমন কোনো আকাক্সক্ষা, অনুভব, অনুভূতি, স্বপ্ন, আশঙ্কা, মন-মনন নেই, যা তার লেখায় বাঙময় হয়ে ওঠেনি। তার গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, গীতিনাট্য সব সাহিত্যকর্মে মানুষের সব আবেগ-অনুভূতিসহ সব রিপুকে নিয়ে তিনি খেলা করেছেন।
গরিবের প্রতি ধনীদের যে লোভ ও দৃষ্টি তা-ও তার নজর এড়িয়ে যায় না। তাই তো তিনি কী অনায়াসে প্রকাশ করতে পারেন, ‘... এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ কাঙাল উপেন ছিল ধনী রাজার গরিব প্রজা। সম্বল ছিল মাত্র দুই বিঘা জমি। তা-ও রাজার বিষথাবা থেকে রক্ষা পায় না। রাজার জমির দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে সমান করার অভিলাষ পূরণে উপেনের শেষ সহায় দুই বিঘা জমি তার চাই-ই।
একসময় রাজারা কেবল নিজ প্রজাদেরই রক্ত চুষে নিত। নিজেদের রাজ্যের বাইরে তাদের দখলদারি ছিল না। কখনো খায়েশ জেগে উঠলে তাকে অন্য রাজার সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হয়। তাকে পরাজিত করতে পারলেই কেবল কর আদায় করার সুযোগ পেত। আজকের আধুনিক ও সভ্য যুগে সরাসরি ধনীরা গরিবদের রক্ত যত চোষণ করার কথা, তেমন শোনা যায় না। এখন বিশ্ব পরিস্থিতি যেমন পাল্টেছে, তেমনি পাল্টেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক অর্ডার। এখন যে রকম জমিদার ও জমিদারি নেই, তেমনি নেই উপেনের মতো দরিদ্র প্রজা।
এখন বিশ্ব একটি গ্রাম। সেই গ্রামে চলে বিশ্ববাণিজ্যের মোড়ল করপোরেট ওয়ার্ল্ডের মুক্ত অর্থনীতি বাণিজ্যের প্রতিনিধি করপোরেট বেনিয়াদের বুর্জোয়া গোষ্ঠীর হয়ে বৈদেশিক বেনিয়াদের শোষণ। নতুন দুনিয়ার নতুন ব্যবস্থা। ধনী বা বুর্জোয়া সমাজের শাসনব্যবস্থা বা দেশে দেশে গণতন্ত্রের কথা, সবই চলে মানুষের কল্যাণ বা মঙ্গলের নামে। ভুক্তভোগী সবাই জানে, সেসবই গালভরা বুলি। মানুষের কল্যাণ বা মঙ্গল কতটুকু হয় আর এসবের নামে ধোঁকাবাজি বা শোষণ কতটুকু চলে, তা সবাই বুঝতে পারলেও আধুনিক সময়ের শৃঙ্খলা ও সমাজকে রক্ষার নামে যে আইন-কানুন, তা সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় কতটা কাজে লাগে তাও সবার জানা। এ সময়ের দর্শন হচ্ছে, ‘টাকা যার সম্মান ও ক্ষমতা তার।’ আর সব বিত্তের উৎস সাধারণ মানুষের শ্রম, সরকারি সহযোগিতা এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তি। যারা সরকারের ঘনিষ্ঠ বা দলের প্রভাবশালী নেতারাই সাধারণত এই বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে বৈধ-অবৈধ পথে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যান। তাদের কারণেই অর্থনীতিতে ধস নামে। পাচারের নামে দেশকে তারা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
পরিবেশ দূষণ, অতিবৃষ্টি, খরা, দুর্ভিক্ষ, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবকিছুই ঘটে ধনী দেশের অবিবেচক আচরণের জন্য। তারা যেমন অমানবিক আচরণ করেছে মানুষের সঙ্গে, তেমনি অমানবিক আচারণ করেছে প্রকৃতির প্রতি। মানুষ তাদের বিরুদ্ধে ধনীদের আচরণের প্রতিশোধ নিতে না পারলেও প্রকৃতি তার প্রতি বৈরী আচরণের প্রতিশোধ ঠিকই নিচ্ছে বিভিন্ন দুর্যোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এসব দুর্যোগের অন্যতম সুনামি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়। ঠিকানার ১ জানুয়ারি সংখ্যার বিশেষ একটি সংবাদ, ‘ধনী দেশের কৃপণতায় বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ক্ষুধা’। সংবাদটিতে বলা হচ্ছে, ‘সমীকরণটা সহজ, কিন্তু নিষ্ঠুর। একদিকে যখন বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তখন বিশ্বের ধনী দেশগুলো এসব মানুষের জন্য দিন দিন সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে।’
জাতিসংঘ বলছে, ধনী দেশগুলোর এই কৃপণতার কারণে আগামী বছর প্রায় ৩০ কোটি ৭০ লাখ মানুষের ত্রাণ সহায়তা লাগবে। বিপরীতে সহায়তা আসতে পারে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ মানুষের। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে? বিশ্বজুড়ে মানুষের অসহায়ত্ব যাদের কারণে, তারাই কত নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখতে পারে। তাদের এই নিষ্ঠুরতার বলি হবে প্রায় ১২ কোটি মানুষ। তারা খাদ্য সহায়তার বাইরে থেকে জীবন দিয়ে ধনী দেশের কৃপণতার মূল্য মেটাবে। জাতিসংঘ জানায়, ২০২৪ সালে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালাতে ধনী দেশগুলোর কাছে চেয়েছিল ৪ হাজার ৯৬০ কোটি ডলার। বছর শেষে তারা পেয়েছে মাত্র ৪৬ শতাংশের মতো। পরপর দুই বছর জাতিসংঘ ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহায়তার অর্ধেকেরও কম পেয়েছে।
এই যদি হয় অবস্থা, তবে অচিরেই আমাদের এক ভয়ংকর ভাঙনের মুখে দাঁড়াতে হবে এবং সে ভাঙনে শুধু গরিবেরাই ধ্বংস হবে না, ধনী দেশগুলো যাদের কারণে এই ভাঙন, তারাও রক্ষা পাবে না। মনে রাখতে হবে, জনপদে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। কেউ একা একা সুখী হতে পারে না। বিত্ত মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের জন্য প্রয়োজন, তবে খুব বেশি বিত্ত মানুষের জীবনে বোঝা হয়েও দাঁড়াতে পারে।